শিকাগোর লিটল ইটালি থেকে হেঁটে ওয়েস্টার্ন ফরেস্ট পার্ক ট্রেন স্টেশন যেতে লাগে মিনিট দশেক। বøু লাইন ট্রেনে উঠে পড়ি। জ্যাকসন স্টেশনে নেমে হেটে চলে যাই ডাউনটাউন শিকাগোর দিকে। তাপমাত্রা ছ’ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবু বসন্ত এস গেছে। বরফ গলে গিয়ে গাছগাছালির সবুজ শাখা দেখা গেলেই এখানে বসন্ত আসে। কত রং টিউলিপের। সঙ্গে গলা মেলায় আরও মরসুমি ফুলের।
রাস্তা পেরোতেই চোখে পড়ে বড় করে লেখা, ‘স্বামী বিবেকানন্দ ওয়ে’। সেই পথ ধরে গিয়েই রাজকীয় আর্ট ইনিস্টিটিউট অফ শিকাগো। টিকিট কাটাই ছিল আমাদের। গিয়েই দাঁড়ালাম মিউজিয়মের ফুলারটন হলের ফেয়ারে, স্বামীজির প্রতিকৃতি সামনে। ক্যাপশন, ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা। নীচে স্বামীজির স্বাক্ষর। এক বিরল অনুভ‚তির শিকার হলাম। মঞ্চে উঠে ছবি নিতেও বাধা নেই এখানে। এবার মিউজিয়ম ঘুরে দেখার পালা।
ফোটোগ্রাফি থেকে মিনিয়েচার, পেপারওয়েস্ট থেকে আর্কিটেকচার, ইসলামিক আর্ট থেকে টেক্সটাইল, ভারতীয় স্থাপত্য ভাস্কর্যের নমুনা, গনেশ. টেরাকোটা, সেরামিক পটারি- এ সব আছে সেখানে। তারপর আর্ট গ্যালারিতে ইমপ্রেশনিস্ট পেন্টিং থেকে ডেকরেটিভ আর্ট, রেনেসাঁ আর্ট, মর্ডান আর্ট দেখার পালা। আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে গেলাম মিলেনিয়াম পার্কে।
আইভিলতায় বেদনার মতো রানিরঙের টুসটুসে কুঁড়ি। মধ্যে মধ্যে ফুলের ভারে নুয়ে পড়া স্বর্গীয় চেরি বøুসমের রূপ। গোলাপির সঙ্গে মেঘলা আকাশের ধূসর মিশে এক অদ্ভুত মায়াময় বিকেল। সেই বিকেলে আর এক প্রাপ্তি স্ট্যান’স ডোনাট আর গরম কফিতে চুমুক। কফিশপের বাইরে এসে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগে খোলা মুখে। বুঝি, নদীর কাছাকাছি এসেছি। শহরের বুকে চিরে একেঁবেঁকে চলে গেল ছোট্ট শিকাগো নদী। মিশিগান লেকে গিয়ে তার আত্মসমর্পণ। জেড পাথরের মত সবুজ জলে ভাসছে স্টিমার। মাথার উপর সিগাল উড়ছে। সেতুর উপর চলমান। শহর। এগিয়ে চলি লিটল ইটালির দিকে। সন্ধে নামে। আমাদের সঙ্গে ঘরে ফিরেছে বহু মানুষ। কেউ অফিস ফেরত, কেউ স্কুল ফেরত। প্রচুর এশিয়ান পড়–য়া রয়েছে এখানে। আলো জ্বলে ওঠে খাবার দোকানগুলোয়।
জীবনে এখানে শুরু হয় সন্ধেবেলায়, সারাদিনের কাজের শেষে। পরদিন অগডেন অ্যান্ড টেলর বাসস্টপ থেকে রুজভেল্ট এভিনিউ দিয়ে নামলাম গ্র্যান্ড পার্কের ধারে। তুষারপাতের পর মাটিতে এখানে কাঠের কুচির মতো সার দেওয়া হয়। এই বিশেষ ম্যানিওরকে মাল্ধসঢ়;চ বলে। পার্কে মাল্ধসঢ়;চ ফেলার দায়িত্ব বাড়ির মালিকদের। বসন্তে যেন সুন্দর হয় শহর। ফুলে সেজে ওঠে বাগানগুলো!
গ্র্যান্ড পার্ক থেকে লেক মিশিগান দু’মিনিটের হাঁটাপথ। লেকশোর ড্রাইভ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চললাম ফিল্ড ন্যাচারাল হিষ্ট্রি মিউজিয়ম দেশবিদেশের প্রাকৃতিক সংরক্ষণশালার দিকে। তৃণভোজী আপাটোসরাস রেক্স’এর ফসিল যেন জীবন্ত। সাউথ ডাকোটা থেকে নিয়ে আসা অতিকায় টিরেনোসরাসটির নাম সু (ঝঁব)। ফিল্ড মিউজিয়মের করিডোরে ছবি তুলতে বাধা নেই। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি সবুজের জয়গান। আর নানা দেশের গল্প শোনা ঘুরে ঘুরে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের ধর্মীয় দেবী পেলে, আগুনের দেবী। তিনি পাথর গলিয়ে পাহাড় বানান, অরণ্য ধ্বংস করেন।
মাদাম পেলে এখনও এই অঞ্চলের আগ্নেয়গিরির লাভার ¯্রােত স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ করেন, এমনই বিশ্বাস তাদের। পলিনেশিয়ার আদিম
আদিবাসী লাপিতা’দের (খধঢ়রঃধ) সংস্কৃতি, তাদের বানানো পটারির নমুনা দেখা গেল। এবার পাশেই শিকাগো মিউজিয়ম ক্যাম্পাসের জন ডি শেড মিউজিয়মের দিকে পা বাড়াই। শেড মিউজিয়মটি মূলত অ্যাকোয়ারিয়াম। দেশবিদেশের লক্ষাধিক মাছ আর সামুদ্রিক প্রাণীর সমাহার। জলের নীচে প্রবাল দ্বীপের ভাসমান জেলিফিস, সি এনিমোন, স্টারফিশ, সি হর্স, সি ড্রাগন সি আরচি- আরও কত কিছু! আমাদের নাকের ডগায় বিশাল বালুগা তিমি, ডলফিন ডাইভ দিচ্ছে জলের মধ্যে। চলতে চলতে হাজির হই অ্যাম্ফিথিদের তখন খেলা দেখানোর পালা। এরপর আসে সিলমাছ। কত ওলটপালট, কত রঙ্গ তার ট্রেনারের আদেশমতো! একজন বিজ্ঞ পেঁচা হাজির হল। এক নিমেষে উড়ে ভিতরে চলেও গেল! ছোটদের কলরোল ফেটে পড়ল থিয়েটার হল। সঙ্গে আমরাও!
এবার গেলাম চতুর্মাত্রিক অর্থাৎ ফোর-ডি থিয়েটারে, বিশেষ চশমা পরে। সেখানে হরেক রকমের হাঙরের কেরামতি। স্ক্রিনের সব কিছু থ্রিডি। চতুর্থ মাত্রা হল, সিনেমায় স্পেশ্যাল এফেক্ট। কখনও জলের ফোঁটা এসে পড়ছে গায়ে। মনে হচ্ছে, পা ছুঁেয় যাচ্ছে ঢেউ! স্ক্রিনে হাঙর তেড়ে এসে লেজের ঝাপটা দিচ্ছে চোখের সামনে, চেয়ারগুলো কাঁপছে। আবার জলের বুদবুদ আছড়ে পড়ল হঠাৎ! এখানে একবার সিটি পাস কিনে নিলে সব মিউজিয়মে প্রবেশ করা যায়।
পরদিন গেলাম সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি মিউজিয়মে। জ্যাকসন পার্কে গিয়ে প্রথমেই চললাম জাপানি গার্ডেন অফ ফিনিক্সের দিকে। মেঘলা আকাশ আর ঠান্ডার কারণেই হয়তো চেরি বøুসমে ভরে ওঠেনি বাগান। তবে যতটুকু পেলাম তা আমাদের চোখে অনেক! মিউজিয়ম ঘুরে দেখতে দেখতেই মাদার্স ডে ট্রিটের প্ল্যান।
একদা শিকাগোয় আগত ইতালীয়রা আমেরিকার মতো করে নিজেস্ব পিৎজা তৈরি করেছিল। এই ডিপ ডিশ পিৎজা হল ময়দার পাই ক্রাস্টে মাংস,সবজি আর পর্যাপ্ত চিজের পুর। উপরের টপিং সাধারণ পিৎজার মতো।
একবার টিকিট কেটে বাসে উঠলে দু’ঘন্টার মধ্যে সেই বাসে ফ্রি রাইড। গবেষণারত ছেলে- বউ খবর রাখে সেসব সুযোগসুবিধের। পরদিন লাঞ্চ সেরেই বেড়ানোর তোড়জোড় হবে।
সেদিন তাপমাত্র ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে টিউলিপ বিদায় নিতে নিতেই চেরি বøসম ফেটে, পাতায় ভরে যায় গাছ। দিনকয়েকের মধ্যেই সব ফুল ফোটা শেষ। তারপর তাদের ঝরে পড়ার পালা। চেরি ফুলের উৎসব শেষ মানেই বসন্ত গিয়ে গ্রীষ্মের আগমন হল বলে। মেপল পাতায় সবুজ রং দেখতে দেখতে ভাবি আমার দেশের খেজুর গাছের কথা।
খেজুরের মতো মেপল গাছ থেকেও ভারী মিষ্টি রস মেলে। তিন ধরনের মেপল গাছ এখানে। তার মধ্যে হানি মেপল থেকে সিরাপ বার করে প্রসেস করে খাওয়া হয়। বসন্তের শুরুতে ঠান্ডা থাকতে থাকতেই মেপল গাছের কাÐে কাঠের দু’মুখ খোলা নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তার নীচে স্টিলের বাকেট ঝোলে। গরম ওয়াফলের উপর এই মেপল সিরাপ এখানকার
পরিচিত ব্রেকফাস্ট।
এবার দেখলাম ওক গাছের যে ব্যারেলে সিংগল মল্ট হুইস্কি প্রসেসিং হয়, তার মধ্যে মেপল সিরাপ বানানো হচ্ছে। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়! তা ছাড়াও বার্চ, এস্পেন আর ওকের ছড়াছড়ি চারিদিকে। হাজির হলাম উইলিস টাওয়ারে। আগে নাম ছিল সিয়ারস
টাওয়ার। একশো তিনতলার স্কাইডেক পয়েন্টে গিয়ে শিকাগো দেখা আর ছবি তোলার পালা। এলিভেটরের গতিবেগ ১৮.২ মাইল প্রতি ঘন্টায়। আমেরিকা এবং ইউরোপের সর্বোচ্চ টাওয়ার এটি। একশো দশ তলা র্দীঘ আকাশচুম্বী টাওয়ারে উঠেই ঝাঁ করে পৌঁছে যাওয়া উইলিস টাওয়ারের মাথায়! কাচের বাইরে উত্তরদিক জুড়ে লেক মিশিগান আর পশ্চিমে তখন রাত আটটায় সূর্যাস্ত হচ্ছে।
মিশিগান লেকের উপক‚লেই শিকাগো। টাওয়ার আর স্কাইস্ক্র্যাপারের সারি, তার মধ্যে ব্যস্ত জনজীবন। স্কাইডেকের একশো তিন তলা থেকে সূর্যাস্তে চোখ রাখতে রাখতে আমাদের পালা এল। শূন্যে ঝুলে থাকা কাচের ঝুলবারান্দা থেকে পায়ের তলায় শহর দেখলাম। দাঁড়ানোর অনুভ‚তি মাত্র এক মিনিটের। অন্ধকার যত ঘন হতে থাকল ততই শিকাগো আলো-ঝলমলিয়ে উঠল!
মহানাগরিক আকাশেরেখার ফুটফুট করছে নক্ষত্রের মতো আলোর রোশনাই। ইতিহাস বলে, ১৮৭১ এ বিধ্বংসী অগ্নিকাÐে
লÐভÐ হয়ে যায় এই শহর। গ্রেট শিকাগো ফায়ার নামে অভিহিত এই ঘটনায় পুড়ে ছারখার হয়েছিল ডাউনটাউন। আগুন লাগার কারণ কিন্তু খুবই তুচ্ছ।
মিসেস অলিয়ারি নামে এক গোয়ালিনী তার শস্যখেতের কাছে দাঁড়িয়ে গরুর দুধ দুইতে ব্যস্ত ছিল। সেই গরুই নাকি লন্ঠন
উল্টে দেয়। আগুন লেগে যায় শস্যখেতে। তারপর সারা শহওে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভয়ের কথা মনে নিয়ে হেঁটে চলি। হাজির হই অন্ধকার মাঠের মাঝে বিখ্যাত বাকিংহাম ফাউন্টেন দেখতে। এমনিতে শিকাগো
অলিগলি, কানাগলি মোটেই নিরাপদ নয়। যখন তখন গাড়ি থেকে নেমে বন্দুক দেখিয়ে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়
পথচারীকে। তবে রাত ন’টাতেও এই অঞ্চল নাকি নিরাপদ। পরদিন বিকেলে সূর্যস্তের ছিক আগেই হাজির হয়ে যাই নদীর ধারে। নৌকাবিহারে শহরের আর্কিটেকচার ট্যুর না দিলে নাকি জীবন বৃথা! সেই যে ভয়ানক আগুনে তছনছ হয়ে গিয়েছিল কাঠের বাড়িঘর, তারপর নতুন রূপে কংক্রিটের স্থাপত্য পুনর্জন্ম হয় শিকাগোর।
নৌকোর গা ঘেঁষে আমাদের চোখের সামনে দাঁিড়য়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইন্টারন্যাশনাল হোটেল টাওয়ার। শিকাগোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার এই ৪৫০ মিটার লম্বা এবং ৯২ তলার হোটেল।
শিকাগো নাম ‘উইন্ডি সিটি’ এখানকার রাজনীতেবিদদের গরমাগরম বাক্যস্ফুরণই এই নামের কারণ। কিন্তু অনেকে ভাবেন লেক মিশিগানের কনকনে উত্তাল হাওয়ার জন্যই এমন নাম। উঁচু ট্রাম্প টাওয়ারের প্রযুক্তিও বেঁকানো কাচের, হাওয়ায় যাতে আন্দোলিত না হয়। শিকাগোর অন্যতম সিগনেচার স্থাপত্য দুটি পাশাপাশি ৬০ তলার টাওয়ার। ভ্ধুসঢ়;ট্টার শীষের মতো টাওয়ার দুটোকে কর্ন অব টাওয়ার বলে।
এই দুটি হল শিকাগো মেরিনা সিটির প্রথম রেসিডেন্সিয়াল বাড়ি। গাইড জানালেন, শিকাগো আদিম এলগোনিকান রেড
ইন্ডিয়ান ট্রাইবদের ভাষায় ঈযরমধমড় থেকে শিকাগো নামের উৎপত্তি।শব্দটির অর্থ পেঁয়াজের ক্ষেত। সে সময় প্রচুর পেঁয়াজ ফলত এখানে।
নদীর ধারে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ত্রিভুজাকৃতির। সব রিসাইক্লেবল ইকোফ্রেন্ডলি মেটিরিয়ালে নির্মিত। রিভার কটেজগুলি ঠিক যেন পালতোলা ডিঙি নৌকাকৃতির। বহু আগে নদীতে সব আবর্জনা ফেলা হত, তাই নদীমুখো বাড়ির কোনও জানালো থাকত না নদীর দিকে। নদী দূষিত হওয়ার কারণে তখন শিকাগো কলেরাও হত। তবে এইসব রোগকে বহুদিন আমেরিকাবাসী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। জানালেন গাইড।
ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সাকির বানানো মন্টগোমারি বিল্ডিং এল। এরা টুইন টাওয়ারও বানিয়েছিল। এবার নদীর পাড়ে সূর্যাস্তের
মাহেন্দ্রক্ষণ! প্রতিটি কাচের বাড়ির জানলায় আলোর বিচ্ছুরণ। দূর থেকে দেখা গেল নেভি পিয়ারের বিশাল হুইল। শিকাগোর আর একটি জনপ্রিয় ট্যুরিষ্ট স্পট। জুন মাসে এই নেভি পিয়ারে চলবে আতসবাজির খেলা। মাথার উপর ড্রোন, বুঝি নদীর ছবি তুলছে। এবার এল বিশাল পোষ্ট অফিস। নদীর বুক চিরে সমান্তরাল ভাবে ৩৮টি ব্রিজ আছে। এরা যদি এতগুলো সেতুর এত বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে, তবে আমরা পারি না কেন? ফেরার পথে বিখ্যাত জিরাডেলির চকোলেট বুটিকে ঢুকে পড়ে গলা ভিজিয়ে নিই চকোলেট সস ছড়ানো, চকোলেট কুচি দেওয়া আইসক্রিম । বাড়ি ফিরে আপডেট রাখি আমার লগবুকে। রান্নাঘরে দুই ছাত্রছাত্রী বানিয়ে ফেলে ওয়ান-পট পাস্তা। শিকাগোর এক টুকরো ডাইনিং টেবিল তখন সত্যি সত্যিই ইতালীয় সিজনিং এর গন্ধে জমজমাট!