খুব ভোরে ঘুম ভেঙে হোম স্টে’র বারান্দায় দাঁড়াতেই খানিকটা মন খারাপ হয়ে গেল। কাঞ্চন দা’ ঢেকে আছেন বিশাল মেঘ খণ্ডের আড়ালে। গত রাতে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে দার্জিলিং যেন একরকম চুপসে আছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাও যে বিমুখ করলেন না, প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া আকাশের বুক চিরে মাত্র ১ মিনিটের জন্য উঁকি দিলেন কাঞ্চন দা। ঠিকরে পড়া স্বর্ণালী রং আর মায়াবী লাল আভা তখন পুরো আকাশ জুড়ে। বৃথা গেল না শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে ঠিক করা এই হোম স্টে প্ল্যান।
পূর্বে দার্জিলিং ছিল প্রাচীন গোর্খা রাজধানী। পরে সিকিমের মহারাজা ব্রিটিশদের এই দার্জিলিং উপহার করেন। মূলত দার্জিলিংয়ের জনপ্রিয়তার ভীত শুরু হয় ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন সময় উপভোগের মধ্য দিয়ে। অপরূপ দার্জিলিংয়ের প্রায় প্রতিটি স্থাপনা জুড়েই ব্রিটিশদের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য ঘুম স্টেশন। আগের দিনের ড্রাইভার সাইফুল ভাইকে ১৫০০ রুপির বিনিময়ে ঠিক করে রেখেছিলাম পরদিনের সাইটসিয়িং এর জন্য। মিষ্টি রোদ শরীরে মেখে আমরা ঘুম রেলস্টেশন পৌঁছাই সকাল ৯টার দিকে।
ঘুম ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। এটি ২,২৫৮ মিটার অর্থাৎ প্রায় ৭,৪০৮ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। দার্জিলিং থেকে ঘুমের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত বিখ্যাত টয় ট্রেনটির দেখাও মিললো খানিক পর। ‘ম্যায় হু না’ মুভিতে বলিউড বাদশা শাহরুখ খানের অনবদ্য এন্ট্রির দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দিলো এক ঝটকায়। কী সুন্দর টয় ট্রেন! ঘুম রেলওয়ে প্লাটফর্মের অপর পাশে ঘুম মিউজিয়াম। কিছু সময় কাটিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বাতাসিয়া লুপ।
ঘুম স্টেশন থেকে বাতাসিয়া লুপের দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। পাহাড়ের চড়াই পথে টয় ট্রেনের যাত্রাকে সাবলীল করার জন্য ১৯১৯ সালে বাতাসিয়া লুপ গড়ে তোলা হয়। দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৃত্তাকার ভিউ আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা এখান থেকে অপরূপ রুপে ধরা দেয়। বাতাসিয়ায় রয়েছে বহু রকমের গাছে সাজানো বিশাল মনোরম বাগান।
লুপের কেন্দ্রে আছে একটি যুদ্ধ স্মৃতিস্মারক। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত গোর্খা শহিদ বীর সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৫ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। মোবাইলে কিছু স্থিরচিত্র ধারণ আর লুপের হকার থেকে শীতের মাফলার কিনে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হিমালয়ান জুলজি পার্ক আর মাউন্টেইনারিং ইনস্টিটিউট।
১৯৫৮ সালের ১৪ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ গভর্নমেন্টের শিক্ষা বিভাগের হিমালয়ান প্রাণীজগত অধ্যয়ন ও সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে দার্জিলিংয়ের বার্চহিল পাড়ায় এই চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়। তুষার, চিতা, পান্ডাস, গোরাল (পর্বত ছাগল), সাইবেরিয়ান চিতাবাঘসহ অসংখ্য বিপন্নপ্রায় প্রাণীর অবস্থান রয়েছে এই চিড়িয়াখানাতে। শোনা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে পার্কটি পরিদর্শনের পর পদ্মজা নাইডুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে পার্কটির নতুন নামকরণ করা হয়। পার্কটির পাশেই মাউন্টেইনারিং ইনস্টিটিউট এর অবস্থান।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পর্বতারোহণকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৫৪ সালের এটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এখানে রয়েছে পৃথিবীর প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তামিলরকের স্মৃতিস্তম্ভ। তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি’র মাউন্ট এভারেস্টে প্রথম আরোহণ এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সম্মানিত প্রচেষ্টা হিসেবে স্থাপন করতেই মূলত স্মৃতিস্তম্ভের সৃষ্টি। এখানে পর্বতারোহণের কোর্স সম্পন্ন ও নিয়মিত এডভেঞ্চারের ব্যবস্থাও রয়েছে। জানা যায় অন্ধদেরও এই ধরনের কোর্স করার সুযোগ আছে। হিমালয়ান জুলজি পাক আর মাউন্টেইনারিং ইনস্টিটিউট পরিদর্শন শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জাপানিজ ট্যাম্পল আর পীস প্যাগোডা।
১৯৭২ সালে জাপানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নিচিদাতসু ফুজির তত্ত্বাবধায়নে মূলত এই প্যাগোডা নির্মিত হয়েছিল । মহাত্মা গান্ধির অহিংসা দর্শন থেকে প্রভাবিত হয়ে তিনি প্রেম ও মানবতা প্রচার করতেই মূলত এই শান্তি প্যাগোডা গড়ে তোলেন। ১৯৯২ সালে দার্জিলিংয়ে প্যাগোডাটির উদ্বোধন করা হয়। প্যাগোডার পাশেই রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির যেটা জাপানিজ ট্যাম্পল নামে সকলের কাছে পরিচিত। মন্দিরে বুদ্ধের মূর্তি ছাড়াও লাগানো আছে নিচিদাতসু ফুজির ছবি। প্রবেশমূল্য বিহীন এই স্থানটির চারপাশ অজস্র ফুল গাছে সাজানো।
জাপানের নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী নির্মিত এই সৌধটির দৈর্ঘ্য ২৮.৫ মিটার এবং ব্যাসার্ধ ২৩ মিটার। বুদ্ধের জীবনকাহিনির ওপর ভিত্তি করে বানানো অলংকরণ, মন্দিরে স্থাপিত রাজকীয় সিংহের ভাস্কর্য, গৌতম বুদ্ধের চার অবতারের মূর্তি, চারদিকে সবুজ আর দূরে তুষারধবল পাহাড় যেন সুন্দরের অন্যতম তীথস্থান এই জায়গা। প্রায় মিনিট ত্রিশেক এখানে কাটিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রোপওয়ের দিক। কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়ায় রোপওয়ের টিকেট মিললো না। সিদ্ধান্ত নিলাম রক গার্ডেন যাওয়ার।
রক গার্ডেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি নিয়ে রওয়ানা দিতেই আকাশ ভেঙে নামলো বৃষ্টি। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত বৃষ্টি সাথে পুরো রাস্তা সাদা শিলায় আচ্ছন্ন। সাথে থাকা পরিবার আর ড্রাইভার সাইফুল ভাই একমত হলেন, পাহাড়ি রাস্তায় পিচ্ছিলতা বাড়ার কারণে রক গার্ডেন যাত্রা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। গন্তব্যস্থান বাদ তাই আর সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলাম রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যদি দিনের শেষ টিকিট হিসেবে বিকেল তিনটের টয় ট্রেন পাওয়া যায়!
এখানেও কপাল খারাপ, রেলওয়ে কাউন্টারের কাঁচের কাউন্টারের উপর বড় বড় অক্ষরে সাটানো- ‘আজকের দিনের সকল টয় ট্রেনের টিকিট অলরেডি সোল্ড!’ এমন পোড়া কপালও হয়! সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে আর কোথাও যাব না। বিকেল-সন্ধ্যা কাটাবো ম্যাল রোডের হোপে’র কফি, স্ট্রিট ফুড আর অগোছালো সময় যাপনে। ঠিক যখনটায় আমাদের দেশে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পারদ উঠছিলো তখন শৈল শহরের রানী’র কোলজুড়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা- রাতের আকাশ জুড়ে একটানা বয়ে চললো শিলাবৃষ্টি সাথে প্রায় ১০- ১২ ডিগ্রির ঠান্ডা।
মল রোডের রেস্টুরেন্টে ইফতার সেরে রাত ৮টার দিকে হোম স্টে’র বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কাপ গরম চা’য়ের সাথে বৃষ্টি শেষের রাতের দার্জিলিং শহর উপভোগ। অপূর্ব তার রূপ। আমাদের আগামী দিনের গন্তব্য লামাহাট্টা ইকো পার্ক, রক গার্ডেন, সেন্ট পল্স স্কুল, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট।