ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সুইজারল্যান্ড। পাহাড়, পর্বত, লেক, ভ্যালি এবং এ্যালপাইন বনাঞ্চল ঘেরা এই দেশটিকে সৃষ্টিকর্তা যেন সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন। ছবির মতো সুন্দর দেশটি দেখে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হবেন যেকেউ।
সুইজারল্যান্ডের অপূর্ব সুন্দর ছোট একটি শহর ইন্টারলাকেন। লেক ব্রেইঞ্জ আর লেক থুনের নীল জলরাশির লেকের মধ্যবর্তী জায়গায় আর সুইস আল্পসের পাদদেশের উপত্যাকায় এটি অবস্থিত। যারা সুইজারল্যান্ডে ভ্রমণ করতে যায়, ইন্টারলাকেনের নাম শোনেনি এমন কেউ নেই৷ কারণ সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাউন্টেন এক্টিভিটিজের জন্য এই জায়গায় আসতেই হবে।
ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু পর্বতচূড়া উংফ্রোসহ (jungfrugh) এই অঞ্চলেই রয়েছে সুইজারল্যান্ডের আকর্ষণীয় বেশ কিছু পর্বতচূড়া আর অপূর্বসুন্দর গ্রিন্ডেলওয়ার্ল্ড, মুরেন, গ্রিম্মেলওয়ার্ল্ড, ওয়েজেন, লওটারব্রাননসহ বেশকিছু গ্রাম। ইন্টারলাকেনে দুইটি মেইন ট্রেন স্টেশন আছে, ইন্টারলাকেন ওস্ট (ওএসটি) আর ইন্টারলাকেন ওয়েস্ট। ইন্টারলাকেনের পরিচিতি নিয়ে অন্যতম একটা ব্যাপার হলো, এই জায়গাটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো ইয়াশ চোপড়ার ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েংগে’ সিনেমার মাধ্যমে। ডিডিএলজিতে কাজলের যেখান থেকে ট্রেইন মিস হয়ে যায়, ওইটাই ছিল ইন্টারলাকেন ওস্ট স্টেশন। তাই এই জায়গাটি বলিউডপ্রেমীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এমনকি এখানে ইয়াশ চোপড়ার একটা স্ট্যাচুও বানিয়ে রেখেছে সুইজারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ।
এখানে হোটেলের চেয়ে এয়ারবিএনবি অনেক বেশি পপুলার, আর কিছুটা দামীও বটে। কারণ কিচেন সুবিধা থাকায় সবাই এয়ারবিএনবি প্রেফার করে। আর এমন ছোট ছোট কাঠের পুতুল বাড়ির মত বাড়িগুলোতে থাকার লোভ কেই বা সামলাতে পারে। আমাদের এয়ারবিএনবি এর হোস্ট আমাদের জন্য সেল্ফ চেক ইন এর ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। ছবিতে মার্ক করে ঘরের চাবিটা কোথায় রেখেছে পুরো ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেয় ইনবক্স করে। আমরা ইন্টারলাকেনে পৌছানোর পর সেই ঘরের চাবি খুঁজে পাওয়ার মিশন ছিল আমাদের জন্য ট্রেজার হান্টিং এর মতো। আমরা অতি উৎসাহে ক্লু দেখে দেখে চাবি খুঁজে বের করি, ব্যাপারটা খুবই উপভোগ্য ছিল। ইন্টেরিয়র এর ছবি আর রিভিউ দেখে বুক করা এয়ারবিএনবি যে আমার ছোটবেলায় পুতুল খেলার সময় কল্পনায় দেখা বাড়ির মত হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ছোট কাঠের দোতলা সুইস চ্যালেট। নিচের তলায় একপাশে আমাদের রুমটি বাড়ির বাইরে দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করা।
হোস্টের সাথে আমাদের দেখা না হলেও ঘরে ঢুকেই দেখতে পাই প্রতিটা জায়গায় তার হাতের ছোয়া, কোনো কিছু নতুন করে জানার প্রয়োজন নেই, যেদিকে তাকাই সুন্দর করে আন্তরিকতার সাথে ইন্সট্রাকশন লিখে রাখা আর এত কিউট ঘর দেখে আমি তো তখন আবেগে ভাসছি। পুরাই একটা পুতুলের ঘর, সবকিছু ছোট ছোট, আর এত এত কিউট। বোঝাই যাচ্ছে সুইস লোকেরা পুরা চকলেট চকলেট টাইপ। এত কিউট মানুষ ক্যামনে হয়? আমি সত্যি অবাক।
প্রথম দিনে বিকেলে ফ্রেশ হয়ে বের হওয়ার সময় দেখা হয়ে যায় আমাদের হোস্টের বউ আর ছোট পিচ্চি মেয়ের সাথে। পিচ্চি এত এত কিউট, সে মুহুর্তেই আমাদের ফ্যান হয়ে যায়, সেও আমাদের সাথে ঘুরতে যাবে। পরে তার সাথে সেল্ফি তুলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমরা ঘুরতে বের হয়ে পড়ি। স্টেশন থেকে বাসে আসায় প্রথমবার তেমনকিছু টের না পেলেও, রাস্তায় বের হয়ে মনে হলো একটা ভূতুরে শহরে এসে পড়েছি। সুন্দর সাজানো গোছানো কাঠের বাড়ি, প্রতি বাড়ির পার্কিং জোনে দুই-তিনটা করে গাড়ি রাখা, ১০-১৫ মিনিট পর পর শুধু রাস্তা দিয়ে দুই একটা বাস, প্রাইভেট কার যাচ্ছে, শুধু নেই কোনো মানুষ। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে শহরের সব মানুষ উধাও হয়ে গেছে, পিনপতন নিরবতা। দূরে পাহাড়ের চুড়া থেকে প্যারাগ্লাইডিং করে কিছু ট্রাভেলার শুধু নিচে নামছে, যারা ইন্টারলাকেনেই ল্যান্ড করবে। অদ্ভুত জায়গা, আমি চিৎকার করে করে কথা বলি, কেউ নেই শোনার। বাংলায় চিৎকার করে করে কথা বলতে থাকি, দুই একজন শুনলেও কিছুই বুঝবেনা।
ঘুরেফিরে ফেরার সময় ইন্টারলাকেন ওস্ট স্টেশনে যখন এসে পৌঁছাই, তখন রাত ৮টা বাজে। আগে থেকেই জানা ছিল ৮টার সময় ওদের সুপারসপ, দোকানপাঠ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ মানে বন্ধ, পুরাই বন্ধ। শুধু সময় মেনে স্টপেজগুলোতে বাস আসবে, আর দুই একটা বার খোলা, হোটেল হোস্টেল এগুলোতে আলো জ্বলছে শুধু। স্টেশন থেকে আমাদের বাসায় ফিরতে বাসে ৩ মিনিট আর হেঁটে ৮-১০ মিনিট সময় লাগে। আমরা সিদ্ধান্ত নেই হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরবো। সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল, তা বুঝতে পারি স্টেশন থেকে দুই মিনিট হেঁটে আবাসিক এলাকায় ঢোকার পর। রাত তখন ৮.১৫ মিনিট এর মত। একটা মানুষ নেই, নেই মানে নেই, একদমই নেই। শুধু রাস্তায় মৃদু আলোর ল্যাম্পপোস্ট। দুইজনে গল্প করতে করতে আগাচ্ছি, আর পুরোদমে পা চালাচ্ছি, অনেকক্ষণ পর দুই একটা গাড়ি শুধু সাই করে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। আর আকাশের চাঁদটা আমাদেরকে পাহাড়া দিতে দিতে সাথে সাথে চলছে। ভয়ও পাচ্ছি, সময়টা দুজন বেশ উপভোগও করছি।
আমাদের দেশে এমন নিরিবিলি জায়গায় তবুও ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যায়, এখানে তাও নেই, স্তব্ধ এক জায়গা। একটা ১৪-১৫ বছরের ছেলে সাইকেল নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলে তাকে দেখে বুঝতে পারলাম, এখানকার জীবনযাত্রা এমনি। এর মধ্যে আবার মাঝে মাঝে কোনো বাসার সামনে পা রাখতেই হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠছে, মানে সেন্সর লাগানো, কী যে একটা অবস্থা। ভালো কথা দুজনে স্তব্ধ রাস্তায় হেঁটে চলছি, হঠাৎ দূরের কোনো গির্জা থেকে ঘণ্টার ঢং ঢং আওয়াজ। মনে হচ্ছিলো পুরা হরর সিনেমার কোনো সেট। যাক সামনে আগাতে আগাতে আমাদের বাসার কাছাকাছি এসে হোটেল, বারের আলো দেখতে পেয়ে মনে শান্তি পেলাম। মেইন রোড থেকে বাসায় ঢুকতে দুই মিনিটের রাস্তা, এটুকু যেতে ঘুটঘুটে অন্ধকার, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে আগাচ্ছি, কিন্তু বাসাগুলোর সামনে দিয়ে যেতেই সেন্সর লাগানো লাইটগুলো জ্বলে উঠছে, মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ একজন আমাদের সাথে সাথে যাচ্ছে, আর আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, অশরীরি ব্যাপার স্যাপার।
পরের দিন সারাদিন ঘুরে আগে আগেই বাসায় ফিরে আসলাম। আসার সময় সুপারশপ থেকে কিছু জিনিস কিনে নিলাম। আজকে আমাদের পিকনিক আর মুভি নাইট। উনার খুব শখ হলো খিচুড়ি খাবে। আমি কিছু চাল ডাল নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকে। ইন্টারলাকেনের সুপারশপে অনেক খুজেও মরিচ পেলাম না। ঝাল বলতে যে কিছু আছে এদের মনে হয় জানা নেই। এক চিমটি লবণ আর এক টেবিল চামচ তেলের জন্য পুরা এক কেজি লবণ আর হাফ লিটার সানফ্লাওয়ার অয়েল কিনতে হলো, তারপরও শখ বলে কথা। রান্না করতে চেয়েছি, করেই ছাড়বো। আলহামদুলিল্লাহ হলুদ ছাড়া খিচুড়ি, ডিম ভাজা, নুডুলস বেশ তৃপ্তি নিয়েই খাওয়া হলো।
ইন্টারলাকেনের শেষ রাত্রে বিছানায় শুয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতেই দেখি, বিছানা থেকে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে, আহা কী সুন্দর মুহুর্ত। কিন্তু চাঁদও যে এত ভয়ংকর হয় তা ওই রাতে বুঝেছি। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না চাঁদের দিকে, পর্দাটা নামিয়ে দিলাম। পুরাই ভূতের নাটক সিনেমায় হাহাকার সুরের ব্যাকগ্রাউন্ড সং দিয়ে যেভাবে মেঘের উপর দিয়ে চাঁদ দেখা যায় ঠিক তেমন লাগছিল। মনে হচ্ছিলো আজ রাতে অভিশপ্ত আত্মারা সব নেমে আসবে মাটিতে। কী ভয়ংকর রে বাবা।
মাঝরাতে হঠাৎ করে ভূতের স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠি। ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। বুঝতে পারি স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু আমার আর ঘুম আসেনা, চারিদিকে স্তব্ধ নিরবতা। আয়াতুল কুরছি পড়ে ওর গায়ে নিজের গায়ে ফুঁ দেই। আর ভাবতে থাকি ‘আচ্ছা ভূতের স্বপ্ন কেন দেখলাম? আচ্ছা এখানে আসার পর আশেপাশের বাড়িগুলোতে একটা মানুষ দেখিনি। আমাদের এই বাড়ির হোস্টের সাথেও দেখা হয়নি। এমন কী হতে পারে, এটা একটা ভুতুড়ে বাড়ি?’ তখন আবার নিজেকে শান্তনা দেই ‘নাহ, আমাদের তো হোস্টের বউ মেয়ের সাথে দেখা হলো, আবার পিচ্চির সাথে ছবিও তুল্লাম, সো ওরা আসল মানুষ, ভূত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, ভূত হলে ছবি উঠতো না’। আমার আর ঘুম আসেনা, কখন সকাল হবে। মোবাইলে নেট চালু করে গুগলে সার্চ দেই ‘হরর স্পট এট ইন্টারলাকেন’, তেমন কিছু পাইনা, ভয় একটু কমে আসে, বুঝতে পারি ঘুমানোর আগে চাঁদটা দেখে একটু মনে ভয় ঢুকেছিল, তাই এমন স্বপ্ন দেখেছি।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। আলহামদুলিল্লাহ, রাতটা পার হয়েছে। সকালে উঠে নিজেই হাসতে থাকি ভয় পেয়েছিলাম বলে। কিন্তু আসলেই রাতটা অনেক বেশি ভয়ের ছিল। কিন্তু ইন্টারলাকেন আমার এত বেশি ভালো লেগেছে, বলার মত না। সুইজারল্যান্ড গেলে সিটিতে না থেকে বশ্যই এমন ছোট শহরগুলোতে থাকা উচিত, তাহলে আসল সুইস লাইফস্টাইল বোঝা যাবে, আর সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য অনেক বেশি উপভোগ করা যাবে।
নুরুন্নাহার সুমি