ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে উঠা হাজার দ্বীপের দেশ মালদ্বীপ। উপর থেকে দেখলে মনে হয় নীল সমুদ্রের বুকে এক টুকরো উন্মুক্ত অ্যাকুরিয়াম। স্বচ্ছ নীল জলে বেবি ডলফিনরা দল বেঁধে মনের আনন্দে ভেসে বেড়ায়। স্টিংরে হেলে দুলে কোমল নৃত্য ছন্দে সমুদ্রের বুকে তাদের আধিপত্য জানান দেয়। এখানেই শেষ নয়, অসংখ্য প্রাণীদের আনাগোনায় মুখরিত এই অ্যাকুরিয়াম।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ সাগরের বুকে ভর করে একটি দেশ আগলে রেখেছে তার ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অর্থনীতিসহ সব কিছু।
বছর জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ২০২০ সালে এটি বিশ্বের ১ নম্বর পর্যটন স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশটির আয়ের প্রায় ৭০ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকেই। দ্বীপগুলোকে ঘিরেই মানুষের জীবন জীবিকা, হাসি কান্নার উত্থান পতন ঘটে। পর্যটকদের চাহিদার জন্য গড়ে উঠেছে কয়েকটি কৃত্রিম দ্বীপ। এরমধ্যে হুলুমালে, থিলাইফুশি, ফারো আইল্যান্ড অন্যতম। দেখলে অবশ্য বোঝার মুশকিল কোনটা কৃত্রিম দ্বীপ আর কোনটা প্রাকৃতিক।
পূর্ব প্রস্তুতি
মালদ্বীপ টুরিস্ট ফ্রেন্ডলি একটি দেশ। ভিসা এবং ইমিগ্রেশনের জটিলতাও কম। বাংলাদেশের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা, অগ্রিম ভিসা নিতে হয় না।এয়ারপোর্টে চেক ইন করে রিটার্ন এয়ার টিকেট, হোটেল বুকিং কনফার্মেশন, ডিপার্চার ইমোগা রেজিস্ট্রেশন, সঙ্গে কভিড ভ্যাক্সিন সার্টিফিকেট থাকলেই হয়। কোনো ভিসা ফি লাগে না।
ঢাকা থেকে ভেলানা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যেতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। গিয়ে একটু দর-দাম করে ডলার রুফাইয়াতে কনভার্ট করে নিলে ভালো। ডলারেও পেমেন্ট করা যায় তবে রুফাইয়াতে করলে সুবিধা বেশি। খরচও কমে আসে। ১ ডলারে প্রায় ১৭ রুফাইয়া, সেন্টারে কনভার্ট করলে ভালো রেট পাওয়া যায়। আরেকটা বিষয় ডলার কেনার সময় নতুন ডলার না কিনলে সমস্যায়। রেট কম হয় আর অনেক আগের ডলার হলে মানি এক্সচেঞ্জ একসেপ্ট করে না। তখন ব্যাংকে গিয়ে ভাঙ্গাতে হয়।
পাখির চোখে মালদ্বীপ
প্রায় সব দেশেই ল্যান্ডিং করার সময় আমরা বিমানের জানালা দিয়ে উঁকি দিই। মালদ্বীপের ভেলেনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ডিংয়ের সময়ের অভিজ্ঞতা ভয়ংকর সুন্দর। জানালা দিয়ে তাকালে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য আকাশে ভেসে বেড়ানো মুক্ত বিহঙ্গ মনে হতেই পারে। নীচে যতদূর চোখ যায়; চোখে পড়বে অপ্রতিরোধ্য স্পিড বোর্ডে নীল জলের বুক চিরে সফেদ রেখা এঁকে দেওয়ার মিতালী ছন্দ। নিজের অজান্তে মুখ ফুটে বলে উঠলাম, মালদ্বীপ আসার সিদ্ধান্তটা ভালো ছিল।
কী করি আজ ভেবে না পাই…
বিমানবন্দর থেকে নেমে হোটেলে যাই। এরপর পরিকল্পনা শুরু করলাম কি কি দেখব, কোন কোন এক্টিভিটি করব। সাবমেরিন ডাইভ, স্কুবা, স্নরকেলিং, ডলফিন ওয়াচিং, লোকাল আইল্যান্ড ভিজিটিং, স্যান্ড বিচ বাদেও লোকালদের মত ঘুরে ঘুরে মালদ্বীপ এক্সপ্লোর করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ইচ্ছা সংবরণ করা আসলেই মুশকিল। ফলাফল হিসেবে এই লেখার উৎপত্তি।
টুপ করে সমুদ্রে ডুব
দেখলাম মালে, হুলুমালে, ভিলিঙ্গিলি, হিমাফুশি। প্রথম অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয় সাবমেরিন ডাইভের মধ্যে দিয়ে। মালে এয়ারপোর্টের কাছে ১ নং জে টি ঘাট থেকে স্পিড বোট দিয়ে সাবমেরিন এর কাছে যেতে হয়, সেখান থেকে সাবমেরিনে করে টুপ করে সমুদ্রে ডুব। সব মিলিয়ে ঘণ্টা খানেকের মত সাবমেরিন নিয়ে ডুবে ছিলাম।
সাধারণত একটি সাবমেরিনে ২০-২৫ জনের মত বসার জায়গা থাকে। সবাই আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বিস্ময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে রহস্যময় সমুদ্র জগতটাকে। বিরল প্রজাতির প্রাণী চোখের সামনে হেঁটে বেড়ানোর দেখতে দেখতে কখন সময় চলে গেল টেরও পাইনি। যদিও শান্তির আবেশে আমার ঘুম চলে আসছিল, অনেক কষ্টে ঘুম আটকে রেখেছিলাম, সমুদ্রের নীচে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন দেখাবে! শেষ করে ফেরার পথে ভিলিঙ্গিলি ঢুঁ মেরে পরের দিনের জন্য স্কুবা কনফার্ম করে হোটেলে ফিরি। সাবমেরিন ডাইভে পানিতে নামলেও ভিজতে পারিনি।
পরদিন সকালে উঠে লোকাল ফেরি ধরে চলে গেলাম ভিলিঙ্গিলি লোকাল আইল্যান্ড। ছোট্ট একটা লোকাল আইল্যান্ড। এখানের বাচ্চারা ফেরি পার হয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসে-যায়। বড় বাজার করতে হলেও ফেরি পার হতে হয়। ফেরি পার হতে জনপ্রতি লাগে ৩ রুফাইয়া। ছোট খাটো বাজারের জন্য আছে সুপার শপ, খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত জায়গা। আছে পার্ক। কিছুক্ষণ পর পর আছে দোলনা।যেখানে শুয়ে বসে চোখ বন্ধ করে মুহূর্তে চলে যাওয়ায় যায় হাজার মাইল দূরে কোনো কাঙ্ক্ষিত জায়গায়।
সব মিলিয়ে ভিলিঙ্গিলি আইল্যান্ড কল্পনার জগতের মত সাজানো সুন্দর। স্কুবারের জন্য ভিলিঙ্গিলি যথেষ্ট ভালো বলতেই হবে। ইন্সট্রাক্টর অসাধারণ ছিলেন। প্রথম ১ ঘণ্টা থিওরি শেখালেন। এরপর বুক সমান পানিতে ৩০ মিনিটের মত প্র্যাকটিস করতে করতে কখন যে ৯-১২ মিটার নিচে চলে গেলাম, ফিরে এলাম ২৯ মিনিট পর। সমুদ্রের নিচে কেমন কেটেছে, কি কি দেখেছি সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অল্প কথায় শেষ হবে না, রেখে দিলাম আরেক দিন গল্প করার জন্য। ভিলিঙ্গিলিকে বাই বলতে গিয়েও মনে হচ্ছিল আবার দেখা হবে, হয়তো হবে।
মালে থেকে হুলুমালে ট্যাক্সিতে ৭৫ রুফাইয়া। পাবলিক বাসে প্রিপেইড কার্ড সিস্টেম, তবে টুরিস্টদের জন্য টিকেট সিস্টেম। জনপ্রতি ১০ রুফাইয়া। দোতলা এসি বাসে করে হুলুমালে ফিরলাম। পরের দিনের জন্য রেখে দিলাম স্নরকেলিং, ডলফিন ওয়াচিং, স্যান্ড বিচ, লোকাল আইল্যান্ড ভিজিট।
স্নরকেলিংয়ের গল্প এখানে না করলেই নয়। পুরো দিনের প্যাকেজ জন প্রতি ৫০ ডলার। আমাদের গ্রুপে ১১ জন ছিল, সবাই ভিন্ন ভিন্ন দেশের। সবাই মিলে সারাদিন বোটে ঘুরে ঘুরে গানে গানে ডলফিনের নাচের ঢং রঙ দেখে, স্যান্ড বীচে রোদে পুড়ে জলে ভিজে কাটিয়েছে। দুপুরে হিমাফুশি লোকাল আইল্যান্ডে খেয়ে চলে গেলাম ফিশ ব্যাংকে। স্নরকেলিং এবং স্কুবারের জন্য বেশিরভাগ পর্যটকরা এখানেই আসে। কারণ এখানে মাছের মিলন মেলা বসে। এক সঙ্গে এতো মাছ আর সামুদ্রিক প্রাণী আর কোথাও বোধহয় দেখা যায় না।
ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন রঙের কোরাল রিফ ফিস, ক্লাউন ফিস আরো কত শত নাম না জানা মাছ আলতো করে গাঁ ছুঁয়ে দিয়ে চলে যায়। ৪/৫ হাত দূরত্বে স্টিং রে মুচকি হেসে হেটে যায়। এভাবে অনন্ত কাল কেটে গেলেও মনে হবে মাত্র কয়েক মিনিট ছিলাম। তবে স্নোরকেলিংয়ের সময় ডাইভিং মাস্ক ভাল করে চেক করে না নেওয়ার কারণে একটু পর পর চোখে পানি ঢুকে যাচ্ছিল। সারাদিন রোদে শুকিয়ে জলে ভিজে চমৎকার একটি দিন শেষে হোটেলে ফিরলাম।
পরিষ্কার শহর, নেই ধুলাবালি
মালদ্বীপ শহর বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন, ধুলাবালি নেই বললেই চলে। স্কুটির সংখ্যা অনেক, তবে কম মানুষের মাথায় হেলমেট ছিল। গাড়িগুলো হর্ন বাজায় না, নিজ দায়িত্বে থেমে গিয়ে অন্যকে আগে যেতে দেয়। রাতের শহরও বেশ সুন্দর, রাস্তার পাশে ফুটপাতের চেয়ার টেবিল পাতানো, সন্ধ্যার পরে লোকজন এখানে বসে চায়ের আড্ডা দেয়। গল্প করে, খায়। স্থানীয় খাবারের মধ্যে মাছ বেশ জনপ্রিয়। অনেক ধরণের মাছের সুপ পাওয়া যায়। তবে এখানে ব্রেকফাস্ট টিস্যুর মত পাতলা রুটি খেয়েছি। খাবারের দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্টে অনেক বাংলাদেশীরা কাজ করে।
একটু খানি শপিং..
মালদ্বীপ থেকে ফেরার সময় বাসার মানুষের জন্য শপিং করার মত কিছুই পেলাম না। তবে কয়েক প্যাকেট নারিকেলের গুড়া কিনেছে। মালদ্বীপের নিজস্ব বলতে আছে সাগর আর মাছ। সঙ্গে আশপাশের প্রকৃতি। বাকি সব কিছুই আকাশ পথে বা জলপথে অন্য দেশ থেকে আসে। সেজন্য দামও কয়েকগুণ বেশি। তবে কিছু শামুক, ঝিনুক কুঁড়িয়ে এনেছি ভাই-বোনদের জন্য।
ব্যাস। ট্যুর শেষ! চোখ বন্ধ করলে এখনো বারবার মনের মধ্যে উঁকি দেয় সেই শান্ত শীতল ছোট্ট ভিলিঙ্গিলি আইল্যান্ড।