1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
December 19, 2024, 10:53 am

টাঙ্গুয়ার হাওর: যে জলে আকাশ জ্বলে

  • Update Time : Wednesday, February 28, 2024
  • 20 Time View

এক পূর্ণিমা রাতে আমি বাড়ি থেকে কাউকে কিচ্ছু না বলে বের হয়ে গেলাম। এভাবে বের হওয়াটা আমার মত কারো জন্য মনে হয় খুব একটা সহজ কিছু না। সেই জন্মের পর থেকে ঐ রাত পর্যন্ত আমার প্রতিটা পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছুই ছিল আসলে আমার বাবার সাজিয়ে দেয়া। আমার বাবা একজন আর্কিটেক্ট। এই দেশের খুব নাম করা আর্কিটেক্ট। ডিজাইনে উনার অসীম দক্ষতা। উনার ডিজাইনের শিকার উঁচু উঁচু দালানগুলো জানে না ওরা কারা। আমিও জানতাম না, আমি কে। জানতাম না, জীবন কত স্বচ্ছ। কত সহজ, কত বেশি সাধারণ।

সেই পূর্ণিমা রাতে আমি আমাদের প্রাসাদপ্রতীম বাড়িটার মেইন গেট দিয়ে কাউকে কিচ্ছু না বলে রাস্তায় বের হয়ে গেলাম। আমার কাঁধে একটা ব্যাগ। কোথায় যাবো ঠিক করি নাই। আমার অবশ্য তেমন কোন বন্ধু-বান্ধবও নাই। যে কয়জন আছে, ওরাও আমার মতো অস্বাভাবিক রকমের ধনী বা অসম্ভব রকম সফল কোন বাবার সন্তান। ওদের সাথে “তুই” বলাবলির অভ্যাসটাও গড়ে ওঠেনি। এদের বাইরে বন্ধু বলতে শুধু একজনই আছে, ফিরোজ। অভাবী ঘরের ছেলে। অভাবটা অর্থের, আনন্দের না। সময়েরও না। রাস্তায় বের হয়ে কি করব ভাবতেসি, তখন ফিরোজের ফোন, “দোস্ত ৫০০ টা টাকা হবে?”

কমলাপুর স্টেশনে বসে ফিরোজ ভোঁস ভোঁস করে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। আমি তাকায়ে দেখতেসি। আমার হাতে হাওর এক্সপ্রেসের দুইটা টিকেট। আমি জানি না এই ট্রেন কোথায় যায়, কতক্ষণ লাগে। জানতে ইচ্ছাও করছে না। আমার খুব ঘুমঘুম একটা ভাব হচ্ছে। আমার ফোন বন্ধ, আমি জানি আমার মা এখন খুব টেনশন নিয়ে বাসার ফুলের টব গুলায় পানি দিচ্ছেন। আমার বাবা খুব রাগী রাগী মুখে এদিক ওদিক ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নিচ্ছেন। ফাকে ফাকে অবশ্য উনার এসিস্টেন্টকে কোন একটা বিল্ডিং এর ডিজাইন নিয়ে গাইড দিচ্ছেন। আমি যেবার বাবার ইচ্ছায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলাম, সেবার থেকে বাসায় একটা নতুন এলসেশিয়ান কুকুর দেখছি। কুকুরটার গলায় সবসময় একটা কলার লাগানো থাকে। সেই কলারের সাথে একটা চেইন যার শেষ মাথা আমার বাবার হাতের মুঠোয়। বহুবার মাঝরাতে আমি গলায় হাত দিয়ে নিঃশ্বাস আটকে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি।

ঢাকা শহরের বাইরের বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই। ট্রেন থেকে নেমে আমি জানতে পারলাম জায়গাটার নাম মোহনগঞ্জ। আর আমরা যাচ্ছি টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জে। একটা ট্রলারে উঠে আমাদের অন্য কোন এক ডাইমেনশানে ঢোকা শুরু হল। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা হয়ে ট্রলারটা ডানে বাঁক নিতেই আমি অনিচ্ছায় এবং অজান্তে বলে ফেললাম, “হলি শিট, এতো সুন্দর কিভাবে!” ফিরোজ বেশ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকায়ে বলল, “এই আস্তে, এটা হৈ হৈ করার জায়গা না।”

প্রতিটা জিনিসেরই একটা প্রতিবিম্ব থাকে। আকাশের স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব আমি প্রথম দেখলাম এই টাঙ্গুয়ার হাওরে এসে। হাওরের জলে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে শিমুল তুলার মতো ঘন ঘন মেঘ। যেন ওগুলা আকাশে উড়ছে না, হাওরের পানিতে ভাসছে। একটু পরপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ওরা হাওরের জলে ডুবসাঁতার দিচ্ছে। আমি পানিতে তাকিয়েই পানি, আকাশ, পাখি, মেঘ সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীটা আমরা যা দেখি, যেভাবে দেখি, আসলে ঠিক সেরকমই যে, তা না। আরো অনেক রকম। এসব হাবিজাবি ভাবছি, হঠাৎ ঝপাং একটা শব্দ শুনলাম। পিছনে তাকায়ে দেখি ফিরোজ নাই। আমাদের মাঝি মনসুর ভাই, মিনিমাম ৩০ বছরের পান খাওয়া কালো দাঁত বের করে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। পানি থেকে মুখ তুলে ফিরোজ আমাকে বলল, “কোমর পানি, সাতার জানা লাগবে না। লাফ দে ব্যাটা!”

আমার স্পষ্ট মনে আছে, হাওরে যখন সন্ধ্যা নামলো, সেটা বাকি পৃথিবীর সমস্ত সন্ধ্যা থেকে আলাদা। নৌকায় চড়ে আস্তে আস্তে আমরা ঐ সন্ধ্যায় ঢুকে পড়লাম। আস্তে আস্তে একদিকে এক সারি উঁচু পাহাড় কান্না শুরু করলো, আরেকদিকে দূর থেকে এক সারি গাছ মৃদু বাতাসে হাত নেড়ে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলো। মাঝখানের শান্ত জলের বুক চিরে আমাদের নৌকা চলতে লাগলো। ফিরোজকে বললাম, “এবার দিয়ে ক’বার হলো এখানে?” নৌকার সামনে আরাম করে গামছা বিছায়ে ছেলেটা সিগারেট টেনে যাচ্ছিল।। হাতের চারটা আঙ্গুল তাক করে দেখাল আমাকে। চোখেমুখে প্রচণ্ড রকমের প্রশান্তি। সূর্য ডুবু ডুবু করছে। নৌকাটা কিছুক্ষণের জন্যে থামলো। হারিকেন জ্বালানো হবে। আমি মনসুর মাঝির দিকে তাকালাম। এরপর ফিরোজকে দেখলাম। প্রথম জন পেটের দায়ে প্রতিদিন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে নৌকা চালায়। দ্বিতীয় জন অগোছালো অভাবী ঘরের বেকার ছেলে, তবুও বহু দূর থেকে বারবার এখানে আসে। দুজনের চেহারায় একটাই মিল। এদের দু’জনের মুখেই প্রশান্তি। সেই সন্ধ্যায় আমি প্রথম জানতে পারলাম, এত কিছু থাকার পরেও আমি কেন এতো অভাবী।

রাত নেমে আসলো। মাথার উপরে চতুর্দশী চাঁদ। টাঙ্গুয়ার হাওরের কোন একটা জায়গায় আছে আমাদের নৌকাটা ভাসছে। ছলাৎ ছলাৎ পানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। ফকফকে জোছনা হাওরের পানি আমার ছোট বোনের রুপার পায়েলের মত চিকচিক করছে। খেয়াল হলো, সেই কখন থেকে আমরা ভেসে চলেছি। বলব কি না ভেবে ভেবে শেষমেশ সাহস করে ফিরোজকে বললাম, “আমার সাতাশ বছরের জীবনে এরকম মূহুর্ত কখনো আসবে ভাবি নাই।” বলে কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগবে ভেবেছিলাম। লাগে নাই।

সন্ধ্যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে ভেসে থাকা নৌকা আর সামনে হাঁস পাখি, স্থান: তাহিরপুর, সুনামগঞ্জ, ফটোগ্রাফার: মোয়াজ্জেম মোস্তাকিম

হ্যা আমি সেদিন ভর দুপুরে পকেটে মোবাইল মানিব্যাগ নিয়েই ফিরোজের ডাকে পানিতে লাফ দিয়েছিলাম। হ্যা আমি সে রাতে এক প্লেট ডাল ভাত আর ডিমভাজি হ্যারিকেনের আলোয় পেট ভরে খেয়েছিলাম। আমি আমার সারা জীবনে এতো তৃপ্তি নিয়ে খাই নাই। সে রাতে আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। হ্যা সেই রাতে, সেই চাঁদের আলোয়, সেই নৈশব্দে।

আমার বাবার খুব সমুদ্র দেখার শখ। বাবার হাত ধরে আমার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে সাগর দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এবং প্রতিবারই আমার নিজেকে মেহমান মনে হয়েছে। সাগর খুব অহংকারী। সাগর তার বুকে আকাশ কে জায়গা দেয় না। সাগরে কোন প্রতিবিম্ব তৈরি হয় না। সমুদ্র আমাকে আপ্যায়ন করেই বিদায় দিয়েছে। কখনো থেকে যেতে বলে নাই। কখনো ঐ ৫ তারা হোটেলের রিজার্ভ বিচের নোনা পানিতে নিজেকে খুঁজে পাই নাই। কে জানে, হারিয়ে গেছি, সেটাও হয়তো ভুলে গেছি!

পাটাতনে শুয়ে লক্ষ লক্ষ তারার দিকে তাকায়ে আছি। দূরে কোন এক মাঝি হাঁক ছেড়ে শাহ আব্দুল করিমের গান ধরলেন,

“আমি কুলহারা কলংকিনী, আমারে কেউ ছোওইয়ো না গো স্বজনী…”

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com