শ্রীলঙ্কাকে বলা হয় ‘ভারত মহাসাগরের মুক্তা’। দেশটি ভ্রমণে গেলে এই উপমাকে মোটেও বাড়াবাড়ি বলে মনে হবে না। প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরা দেশটি এশিয়ার অন্যতম সুন্দর দেশ এবং সারা বছরই বিশ্বের অসংখ্য পর্যটক দেশটি ভ্রমণে যান।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস সাময়িকী ফোর্বস এ বছর বিশ্বের যে ২৩টি স্থানকে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেখানে শ্রীলঙ্কার নামও আছে। দেশটিতে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য যেমন উপভোগ করা যাবে, তেমনি সাগর পাড়ে বসে বিস্তৃত উপকূলও দেখতে পারবেন।
রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকেরা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের জন্য শ্রীলঙ্কার ঘন জঙ্গলেও যেতে পারবেন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, শ্রীলঙ্কার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে-
কলম্বো
এটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় শহর ও দেশটির নির্বাহী ও বিচারিক রাজধানী। শহরটি যেন ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক প্রদর্শনীকেন্দ্র, যা সব পর্যটকের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
কলম্বোর স্থাপত্যকলায় এর ডাচ, পর্তুগিজ ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ছাপ রয়েছে। ডাচ জাদুঘর এবং স্বাধীনতা চত্বরে গেলে দেশটির ঔপনিবেশিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন। কলম্বোর জাতীয় জাদুঘরে গেলেও দেশটির সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
দেশের ধর্মীয় বৈচিত্র্য দেখার জন্য জামে উল-আলফার মসজিদ, গঙ্গারাময় মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির এবং হিন্দু মন্দির ঘুরে দেখতে পারেন। কলম্বোর ঐতিহাসিক ডাচ হাসপাতাল, পোর্ট কলম্বো এলাকা ঘুরে দেখতে ভুলবেন না। শহরে খাওয়ার জায়গার কোনো অভাব নেই। মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব থেকে শুরু করে হিলটন’স কারি লিফ, দ্য লাগুন রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পারেন। স্থানীয় খাবারের স্বাদ পেতে যেতে পারেন পেত্তাহ মার্কেটে।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে উঁচু ভবন কলম্বো লোটাস টাওয়ার। ৩৫০ মিটার উঁচু এই টাওয়ার থেকে পুরো কলম্বোর নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বেইরা লেকে নৌকাভ্রমণ করতে পারেন অথবা সময় থাকলে শহরের সবচেয়ে বড় পার্ক বিহারামহাদেবী পার্কেও একটু ঢুঁ মারতে পারেন।
ক্যান্ডি
দ্বীপ রাষ্ট্রটির অন্যতম সুন্দর শহর হচ্ছে ক্যান্ডি। চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত এই শহরটিতে অসংখ্য চা বাগান আছে। এখানে আছে ‘টেম্পল অব টুথ’, যেখানে বুদ্ধের দাঁতের অংশবিশেষ সংরক্ষিত আছে। তাই এটি বৌদ্ধদের জন্য একটি পবিত্র স্থান।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় উৎসব এসালা পেরাহেরা প্রতি বছরের আগস্টে ক্যান্ডিতেই অনুষ্ঠিত হয়। ক্যান্ডিয়ান মুসলিম হোটেল, ক্যান্ডি হাউজ কিংবা বালাজি দোসাই রেস্টুরেন্টে স্থানীয় খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।
ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ শ্রী দালাদা মালিগাওয়া এবং শ্রী মহা বোধি দেখার মাধ্যমে ক্যান্ডি-দর্শন শুরু করতে পারেন।
ক্যান্ডির রাজাদের সম্পর্কে জানতে পারবেন ক্যান্ডি জাতীয় জাদুঘর এবং ক্যান্ডি রয়্যাল প্যালেসে গেলে। শ্রীলঙ্কার ঔপনিবেশিক ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ থাকলে ব্রিটিশ গ্যারিসন সেমিটারি এবং কমনওয়েলথ ওয়ার সেমিটারিতে যেতে পারেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও ক্যান্ডি অতুলনীয়। ক্যান্ডির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সেরা স্থান হচ্ছে উদায়াত্তাকেলে স্যাংচুয়ারি এবং রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন।
শ্রীলংকার চা-সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে যেতে হবে সিলন টি মিউজিয়ামে।
সিগিরিয়া
সিগিরিয়া নামের ওই স্থানটি ১৮০ মিটার উঁচু এক বিশাল পাথরখণ্ডের চূড়ায় অবস্থিত। অনেকে জায়গাটিকে ‘মেঘের প্রাসাদ’ নামে ডাকেন। পাথর বেয়ে সিগিরিয়াতে উঠতে ও নামতে অনেক সময় লাগে ঠিকই, তবে উপর থেকে যে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন, তাতে এ কষ্টকে স্বার্থক মনে হবে। সিগিরিয়া ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
এ ছাড়া আরও দেখতে পারেন পিডুরাঙ্গালা রয়্যাল কেভ টেম্পল, প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, বিশালাকার পিডুরাঙ্গালা পাথরখণ্ড এবং রয়্যাল কেভ টেম্পল- যেটি আরেকটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। বণ্য এশিয়ান হাতি দেখতে চাইলে ও জিপ সাফারি উপভোগ করতে হলে মিনেরিয়া ন্যাশনাল পার্কে যেতে পারেন।
অনুরাধাপুরা
অনুরাধাপুরা শ্রীলঙ্কার উত্তর প্রদেশের একটি পুরানো শহর, যা তার প্রাচীন এবং আধুনিক চরিত্র দিয়ে যে কাউকে অবাক এবং মুগ্ধ করবে।
অনুরাধাপুরার গোড়াপত্তন হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। কথিত আছে বোধি গাছ কেটে এই শহরটি তৈরি করা হয়েছে। এই বোধি গাছের নিচে বসেই গৌতম বুদ্ধ জ্ঞাণ অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী ১৩০০ বছর পর্যন্ত এ শহরটির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল।
এটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য।
এই শহরটি একটি প্রত্নতাত্বিক বিস্ময়। এতিহাসিক শহরটিতে শ্রী মহা বোধি গাছের দেখা মিলবে। এ ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের আরও বেশি কিছু পবিত্র স্থান আছে শহরটিতে। বন্যপ্রাণীপ্রেমীরা শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের উইলপাত্তু জাতীয় উদ্যানে যেতে পারেন। ভাগ্য সহায় থাকলে শ্রীলঙ্কান চিতাবাঘও আপনার চোখে পড়তে পারে।
গল
শ্রীলঙ্কার ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তন হয়েছিল যেসব শহরে, সেগুলোর মধ্যে গল অন্যতম। গল ফোর্ট এখন ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। শহরের সর্বত্র ইউরোপীয় স্থাপত্যকলার উপস্থিতি সহজেই চোখে পড়বে।
এই শহরটি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিল পর্তুগিজরা। পরবর্তীতে ডাচ ও ব্রিটিশদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ ছিল। বন্দর শহরটি বর্তমানে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ প্রদেশের রাজধানী। সাগরের পাড়ে তৈরি ঐতিহাসিক গল লাইটহাউজ এবং গল দুর্গ উপভোগ করতে পারেন। দুর্গের মধ্যে মেরিটাইম জাদুঘর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রদর্শনীগুলো দেখতে পারেন।
নুয়ারা এলিয়া
স্থানীয়ভাবে ‘লিটল ইংল্যান্ড’ নামে পরিচিত শহরটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এবং মানুষ মূলত শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে যায়। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ১২৮ ফিট উঁচুতে অবস্থিত।
শহরটিকে প্রকৃতির স্বর্গ বলা যেতে পারে। এখানে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে হর্টন প্লেইনস ন্যাশনাল পার্ক, পেড্রো টি স্টেট, মুন প্লেইন, গ্রেগরি লেক, গালওয়ে’স ল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক, ইত্যাদি।
রামের স্ত্রীকে রাবণ এখানেই লুকিয়ে রেখেছিল। সীতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানে এখন একটি মন্দির আছে। রাবণের হাতে বন্দি অবস্থায় সীতা এখানেই তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিল।
জাফনা
এক সময় প্রাচীন তামিল রাজ্যের রাজধানী জাফনা বর্তমানে শ্রীলঙ্কার উত্তর প্রদেশের রাজধানী। উপকূলীয় শহরটির সমুদ্রসৈকত পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তামিল ও শ্রীলঙ্কান-উভয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখা যাবে এই শহরে।
শহরটি এক সময় ডাচ ও পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। ফোর্ট জাফনায় গেলে সেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। ১৬১৯ সালে পর্তুগিজরা প্রথম এই দুর্গটি তৈরি করেছিল। ৪০ বছর পরে ডাচরা এটির সংস্কার করেছিল।
শহরটি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে হলে জাফনা পাবলিক লাইব্রেরি ও জাফনা প্রত্নতাত্বিক জাদুঘরে যেতে পারেন।
এই শহরটিতে প্রচুর প্রাচীন মন্দির আছে। এগুলোর মধ্যে নাল্লুর কান্দাস্বামী মন্দির, কেরিমালাই নাগুলস্বামী মন্দির, নাগাদ্বীপা মন্দির, নাগাপুষানী আম্মান মন্দির অন্যতম।
বাংলাদেশ থেকে কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য শীলঙ্কা অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়। তবে সেজন্য ভ্রমণের শুরুর আগে ইলেক্ট্রনিক ট্রাভেল অথোরাইজেশন বা ইটিএ সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশ থেকে ২১ ডলার দিয়ে ইটিএ কেনা যায়। পাসপোর্টের মেয়াদ অন্তত ৬ মাস থাকতে হবে। অন অ্যারাইভাল ভিসা দিয়ে আপনি ৩০ দিন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করতে পারবেন।
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি শ্রীলঙ্কার বিমান আছে। বিমানে যেতে চাইলে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা, এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, ভিস্তারা, জেট এয়ারওয়েজ, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, মালিন্দ এয়ার, শ্রীলংকান এয়ারওয়েজসহ আরও অন্যান্য এয়ারলাইন্সগুলোতে ঢাকা থেকে শ্রীলঙ্কায় যেতে পারবেন। টিকিটের মূল্য সময় অনুযায়ী ৪০-৬৫ হাজার টাকার মধ্যে হতে পারে।
প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ঢাকার শ্রীলঙ্কান হাইকমিশনে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর: ০২-২২২২৯৬৩৫৩, অথবা ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।
তথ্যসূত্র:ট্রাভেল প্লাস লেজারস, ফোর্বস, কলম্বো গেজেটস
Leave a Reply