1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪০ অপরাহ্ন

কাপাডোসিয়ায় বেলুন ভ্রমণ

  • আপডেট সময় শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

‘বেলুন চড়ে চল চলে যাই রূপকথারই রাজ্যে’— গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা মান্না দে-র গানের এই লাইন ছোটবেলা থেকেই মনকে বেশ নাড়া দিতো। তাই এবার তুরস্কে যাওয়ার আগে ঠিক করলাম, কাপাডোসিয়ায় বেলুন চড়ার সুযোগ হাতছাড়া করব না। তুরস্কের আনাতোলিয়া প্রদেশের একটি ঐতিহাসিক স্থান কাপাডোসিয়া। অনেকের মতে পার্সিয়ান শব্দ ‘কাটপাটুকা’, অর্থাৎ সুন্দর ঘোড়াদের স্থান এই নাম থেকে কাপাডোসিয়া নামের উৎপত্তি। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫) বর্ণনায় কাপাডোসিয়ার উল্লেখ আছে। পার্সিয়ানদের পরে নানা সময়ে রোমান, গ্রিক ইত্যাদি শাসকের অধীনে থেকে ১০৭১ সালে কাপাডোসিয়া তুরস্কের অধীনে আসে। ইতিহাস তো লোকে মূলত বইয়ে পড়ে, মিউজ়িয়ামে দ্যাখে; কিন্তু আকাশ থেকে ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার এই সুযোগ তো সত্যিই বিরল।

ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট থেকে টার্কিশ এয়ারলাইনসের ডোমেস্টিক উড়ানে চেপে নেভশেহির এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে গাড়িতে এলাম গোরেমে ভ্যালি কেভ হোটেল। পর দিন স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটায় বেলুন সফরের জন্য যখন আমাদের গাড়ি এল, তখন বাইরে বেশ শীত শীত ভাব। বেলুন কোম্পানির তরফ থেকে একটা রেস্টুরেন্টে আমাদের টার্কিশ কফি ও কুকি খাওয়ানো হল। তখনও আকাশের গা থেকে কালি মোছেনি। কফি পর্বের শেষে গাড়িতে আবার মিনিট দশেক চলার পর আমাদের নামিয়ে দিল একটা বিশাল এবড়োখেবড়ো মাঠের মধ্যে।

অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে, দেখি চতুর্দিকে আঁধার চিরে যেন শয়ে শয়ে ড্রাগন প্রবল শব্দে হাঁ করে করে ভলকে ভলকে আগুন ঝরাচ্ছে! খুব ভাল করে তাকিয়ে দেখি দূরে নেতিয়ে পড়ে আছে বিশালকায় সব বেলুন। লেজের দিকে লাগানো একটা যন্ত্র থেকে আগুন বের করে, সেই গরম হাওয়া বেলুনগুলোর পেটে ভরা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ ওই রুক্ষ প্রান্তরে জেগে আছে ছোট ছোট কাঁটাঝোপ। আধো অন্ধকারে যত দূর চোখ যায়, তত দূর অবধি যেন ধরিত্রীর বুক ফাটিয়ে, তিরের ফলার মতো মাথা তুলে আছে লাখো লাখো কৌণিক টিলা। তারই ফাঁকে ফাঁকে সমতলভূমিতে ধীরে ধীরে প্রাণবায়ু ফিরে পাচ্ছে শত শত বেলুন, যাদের একটিতে আমরাও অন্য সকলের মতো আকাশে উড়ব।

তখনও সূর্যোদয় হয়নি। বস্তুত বেলুনের পেটে চেপে আকাশ থেকে সূর্যোদয় দেখাও কাপাডোসিয়ার অন্যতম আকর্ষণ। তাই সময় বুঝেই পেট ফোলা বেলুন উড়ান দেবে। বেলুন ডাগরডোগর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই চতুর্দিকের ছোট ছোট পাহাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে আলোর ফলা এসে ঠিকরে পড়তে লাগল টিলাগুলোর মাথার উপরে। যেন এক অদৃশ্য শক্তির জাদুতে এই রুক্ষ মৃত নগরীতে সুদূর অতীতে পড়ে থাকা কোনও জীবাশ্ম থেকে শয়ে শয়ে ডাইনোসরের মতো বিপুলাকৃতি প্রাণী ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে।

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে-না কাটতেই দেখি আমাদের বেলুন গা ঝেড়ে পেট ভরে গরম হাওয়া খেয়ে সওয়ারি নিতে প্রস্তুত। হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে পড়লাম আমাদের বেলুনের সঙ্গে লাগানো বাস্কেটে। সব মিলিয়ে জনাপনেরো মানুষ। সব শেষে উঠলেন বেলুনের পাইলট। তিনি তুর্কি হলেও, ইংরেজি বলতে পারেন। প্রথমেই পরিহাস করে বললেন, এটি তাঁর প্রথম বেলুন যাত্রা। তাই আমরা সকলে যেন নাড়াচড়া কম করি! আর বেলুন যদি আদৌ মাটিতে নামে, তা হলে যেন আমরা হাঁটু মুড়ে সেই ধাক্কা সামলে নিই। আমিও ঠাট্টা করে তাঁকে বললাম, যদি আমরা আকাশেই থেকে যাই! তিনিও কম রসিক নন। চট করে বলে উঠলেন, ‘‘মাটিতে না নামলে পেমেন্ট দেবে না যে!’’

বেলুন সোজা আকাশে উঠে পড়ল। মাঝে মাঝে কো পাইলট একটা দড়ি টেনে প্রবল শব্দে বেলুনে গরম হাওয়া ভরে ভরে দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে দেখা গেল, আমাদের চার পাশে আরও শত শত বেলুন উড়ে এসেছে। তাদের সকলের গঠন এক, কিন্তু বিচিত্র তাদের রং। অনেক বেলুনে কোম্পানির নামও লেখা রয়েছে।

বিশ্বকর্মা পুজোয় আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি বা শ্যামা পুজোয় ফানুসের দৃশ্য মনে আসবেই। তফাত শুধু আকারে এবং উচ্চতায়। মাটি থেকে তিন হাজার ফুট উপরে ওঠা বেলুনের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়! বেলুন যত উপরে উঠছে, ততই নীচের ল্যান্ডস্কেপ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। যে টিলাগুলিকে রাতের ফিকে অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারিনি, দেখা গেল সেগুলো সব দরজা-জানালার মতো খোপ কাটা বাড়ি ! পরে জেনেছি ওগুলোকে বলে ফেয়ারি চিমনি। যুগ যুগ ধরে অগ্নুৎপাতের ফলে শিলাখণ্ড জমে জমে ওই কৌণিক টিলার মতো আকার পেয়েছে। ভিন্ন ধর্ম ও মতের মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মূলত খৃষ্টানরা ওই টিলাগুলির মধ্যে বাসস্থান ও ধর্মস্থান তৈরি করেছিল। এটা যে ঐতিহাসিক সত্য, তার প্রমাণ আছে কেম্যাকলি ও দেরিনকুয়ু অঞ্চলের পাতালনগরীগুলিতে। সেগুলি কাপাডোসিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। তৎক্ষণাৎ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের হোটেলের বিচিত্র গঠনশৈলী।

গতকাল হোটেলে দেরি করে চেক ইন করে পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবতেই পারিনি। এখন বোঝা গেল যে, আমাদের হোটেলটাও ওখানকার অনেক হোটেলের মতো ওইরকম একটি টিলা কেটে তৈরি করা। সূর্যদেব তাঁর সময় মতো পূর্বাকাশ লাল করে উঠলেন। মাটি থেকে তিন হাজার ফুট উপরে ভাসমান অবস্থায় আমরা সবিতাকে বরণ করলাম। ধীরে ধীরে ঝলমলে আকাশে যেন বেলুনের মেলা বসে গেল! আকাশ জুড়ে সুপ্তোত্থিত সূর্যের রংবাজি আর নীচে মাইলের পর মাইল জুড়ে রিক্ত ধরিত্রীতে ছোট-বড় টিলার গায়ে ধারালো রোদ্দুর পড়ে তরবারির মতো ঝলসে উঠছে! কিছু ক্ষণের মধ্যেই নীচের সাদাকালো ছবি যেন রঙিন হয়ে উঠল। অনেক উপর থেকে পিঁপড়ের সারির মতো কিছু গাড়ি বেলুনের গতিপথ ধরে বেলুনগুলিকে ধাওয়া করছে মনে হলো। পরে বোঝা গেল, সত্যিই ওই গাড়িগুলি চুপসানো বেলুনগুলি বহন করে নিয়ে এসেছিল। হাওয়ার গতিতে গা ভাসিয়ে উচ্ছন্নে যেতে চাওয়া বেলুন-পাইলট, তাঁর হাতের কেরামতিতে নিয়ন্ত্রণ করে যেখানে নামাবেন, সেখান অবধি গাড়িগুলোকে বেলুনগুলো ধাওয়া করে করে যেতে হবে। বেলুন মাটিতে নামলে, তাকে পাটে পাটে গুছিয়ে গাড়িতে তুলে, সেই গাড়িগুলি আবার রওনা দেবে গ্রামের দিকে।
এভাবেই কখন আড়াই ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, বুঝতেই পারিনি। পাইলটের নিপুণ হাতে বেলুনের নিরাপদ অবতরণ ঘটল একটি ফাঁকা জমিতে। আন্দাজে বোঝা গেল, আমরা যেখান থেকে বেলুনে চেপেছিলাম, সেখান থেকে এই জায়গাটা অন্তত চার-পাঁচ কিলোমিটার দূর হবে। প্রত্যেক বেলুন যাত্রীকে দেওয়া হল একটি করে শংসাপত্র। বেলুন চাপার উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে ওটাও এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস! এই শংসাপত্র আমাদের সাহসিকতার স্মারক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com