সে দিনের চমক আরও বাকি ছিল। ফেরার সময়ে আমরা গিয়েছিলাম জিমবারান। বিচ জুড়ে সার দিয়ে কাফে-রেস্তরাঁ। বিকেলের মোলায়েম হাওয়ায় পানীয় আর স্ন্যাকস নিয়ে বসলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায়… সুবিধে মতো বসে পড়লাম। একশো মিটারের মধ্যেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে। জিমবারানের কাছেই ডেনপাসার বিমানবন্দর। বিমান ওঠা-নামার দৃশ্য ভারী সুন্দর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন আলতো করে জল ছুঁয়েই গুটি গুটি এগিয়ে গেল প্লেনটা।
বালির সঙ্গে ধর্ম-সংস্কৃতিতে আমাদের দেশের অনেক মিল। কৃষ্ণ, গণেশ, কার্তিক, হনুমান বািলরও আরাধ্য দেবতা। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র দেব-দেবীর মূর্তি ছড়ানো। হিন্দু ধর্ম প্রাধান্য পেলেও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরাও আছেন। রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রদের বীরগাথা স্থানীয়দের মুখে মুখে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, আমাদের পুরাণের সঙ্গে অনেকটাই মিল। কুটা যাওয়ার রাস্তায় একটি বিরাট স্থাপত্য চোখে পড়ে। যুদ্ধরত দুই চরিত্র। একজন রথের উপরে বসে, আর একজন শূন্য থেকে তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত। রথের উপরে বসে থাকা চরিত্রটি কর্ণ। আক্রমণ করছে ঘটোৎকচ। আমাদের কাছে ঘটোৎকচ পূজিত না হলেও, ইন্দোনেশিয়ায় তাকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়।
বালিতে যেখানে-সেখানে হনুমান। উবুদ মাঙ্কি টেম্পল বালির মাস্ট ভিজ়িট স্পট। অদ্ভুত এর স্থাপত্য। পাথর কেটে তৈরি স্ট্রাকচারের সঙ্গে সবুজের সমারোহ। মাঙ্কি টেম্পল যেন জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। হনুমানরাই রাজা-প্রজা সব।
এশিয়ার সূর্যোদয়ের দেশ যদি জাপানকে বলা হয়, বালি তা হলে সূর্যাস্তের জন্য প্রসিদ্ধ। উলুওয়াতু টেম্পল গিয়েছিলাম সানসেটের ঠিক আগেই। সমুদ্র থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের কোলে তৈরি ওই মন্দির থেকে সূর্যাস্ত না দেখলে বেড়ানোটা সত্যিই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সেখানেই একটি জায়গায় বালির প্রসিদ্ধ কেক্যাক ডান্স হয়। তবে আমরা তা দেখিনি। সেই নাচের মাঝে আমার মেয়ে নিজের অ্যাক্টিভিটি দেখাতে পারে, এমন সম্ভাবনা খুবই জোরালো ছিল কিনা!
বালির কিন্তামানি আগ্নেয়গিরি অন্যতম টুরিস্ট স্পট। ভোররাতে ট্রেক করে এখানে এসে অনেকে সানরাইজ় দেখেন। বালিতে কিছু অসাধারণ ওয়াটারফল আছে। রয়েছে অসংখ্য মন্দির। ধর্মীয় কারণে না হলেও, স্থাপত্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই সেগুলি দেখা যায়। তানহা লো টেম্পল সে রকমই একটি দ্রষ্টব্য। পার থেকে খানিক দূরে জলের মধ্যে এই মন্দির। পায়ে হেঁটে জল পেরিয়ে যেতে হবে। আমরা গিয়েছিলাম ভাটার সময়ে। মন্দির থেকে ভিউ অসাধারণ। ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশি আছড়ে পড়ছে মন্দিরের গায়ে। ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সে ছবি মনে বন্দি করে রাখার।
কোথাও গিয়ে স্থানীয় খাবার খাওয়াই দস্তুর। নাসি গোরেং, বালি নাসি— ভারতীয় জিভেও দিব্যি মানানসই। আসলে এদের প্রধান খাদ্য ভাত। বাঁশ বা কলাপাতার টুকরিতে তা পরিবেশন করে। কলা দিয়ে তৈরি এক রকমের ডেজ়ার্ট বেশ উপভোগ্য।
তবে সবচেয়ে ভাল লাগার মুহূর্ত বিচের ধারে নৈশভোজ। পারের উপরে আছড়ে পড়ছে তরঙ্গরাশি। সেই গমগমে শব্দও চার দিকের নৈঃশব্দ্য কাটাতে পারছে না। ক্যান্ডল লিট ডিনারের আদর্শ পরিবেশ। মেয়েকে মোবাইলে মগ্ন করে ওই সময়টুকু শুধু আমাদের নিজেদের।
দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায়