সমুদ্র আর বালুকাবেলায় নির্জনতার মায়াবী আহ্বান উপেক্ষা করা যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর জন্যই কঠিন। এমন অসীম নৈস্বর্গের সঙ্গে যদি যুক্ত হয় হাজার বছরের পুরনো প্রবাল, তবে সেই হাতছানি যেন মুহুর্মুহু স্পন্দনে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্বদক্ষিণের বিন্দু ছেঁড়া দ্বীপ নিয়ে এমনটা বলা হলে, তা মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না। সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা এই এক টুকরো স্বর্গে ঢেউয়ের শব্দে শোনা যায় নিরবতার ঐকতান। চলুন, জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়ার উপায় এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
বঙ্গোপসাগরের বুকে প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত ছোট্ট এই দ্বীপপুঞ্জ সেন্টমার্টিন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে এর অবস্থান চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজারের অন্তর্গত টেকনাফ উপজেলায়; ইউনিয়নের নাম সেন্টমার্টিন। এখানে রয়েছে ১০০ থেকে ৫ বর্গমিটারের ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ।
ছেঁড়া দ্বীপের নামকরণ ও ইতিহাস
স্থানীয়দের কাছে এর নাম ‘ছেঁড়াদিয়া’; কেউ কেউ বলেন ‘সিরাদিয়া’, যেটি এর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূল সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কিছুটা ‘ছেঁড়া’ বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এমন নামকরণ।
২০০০ সালের শেষের দিকে দ্বীপটির অস্তিত্ব প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। নব্বইয়ের দশকে এখানে পাওয়া গিয়েছিল ৬৬ প্রজাতির প্রবাল ও জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব, যার মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ১০টি প্রজাতি।
ঢাকা থেকে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার উপায়
প্রথমেই যাত্রা করতে হবে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে টেকনাফ; তারপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেন্টমার্টিন হয়ে ছেঁড়া দ্বীপ। সরাসরি টেকনাফ পৌঁছার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাসে যাতায়াত। রাজধানীর সায়েদাবাদ, কলাবাগান, ফকিরাপুলে টেকনাফের বাস পাওয়া যায়। যেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা। কমলাপুর থেকে ট্রেনে করে কক্সবাজার পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বিকল্প হিসেবে বিমানে করেও কক্সবাজার পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে।
টেকনাফে পৌঁছে প্রথম কাজ হচ্ছে সি-ট্রাক বা জাহাজের টিকেট কাটা। টেকনাফের জাহাজঘাট থেকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে সেন্টমার্টিনের জাহাজ ছাড়ে। ফিরতি ট্রিপ রওনা হয় বিকাল ৩টা থেকে সাড়ের ৩টা নাগাদ। সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই রুটিনটি অবশ্যই যথাযথভাবে মেনে চলা জরুরি।
সেন্টমার্টিনের জেটি থেকে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার জন্য রয়েছে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও স্পিডবোট। তবে ভাটার সময় পানি নেমে গেলে মোটরসাইকেল বা বাইসাইকেল ভাড়া নিয়েও রওনা হওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে অনন্য অভিজ্ঞতা নিতে অনেকে পায়ে হেঁটেও ছেঁড়া দ্বীপ চলে যান। এভাবে হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাইসাইকেল কিংবা মোটরসাইকেলগুলো ছেঁড়া দ্বীপে সরাসরি প্রবেশ করতে পারে না। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে ছেঁড়া দ্বীপ সংলগ্ন পয়েন্টে নির্ধারিত ফি দিয়ে সাইকেল রাখতে হয়। তারপর সেখান থেকে শুরু হয় পায়ে হাঁটা পথ।
ছেঁড়া দ্বীপ ভ্রমণে কি কি দেখবেন
প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা এই জনবসতিহীন দ্বীপের প্রধান বাসিন্দা শামুক, ঝিনুক ও কাকড়া। স্বচ্ছ পানির নিচে কদাচিৎ চোখে পড়ে রঙিন মাছ। একদিকে লোনা জলে সিক্ত প্রবালের বিস্তীর্ণ সৈকত, অন্যদিকে ঝোপঝাড় ও উঁচু পাম গাছের সমারোহ। এর সঙ্গে সারি সারি নারকেল গাছ আকাশ রঙা পানির পটভূমিতে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করে। সামুদ্রিক হাওয়ায় বিস্ময়কর নীলিমা আর সূর্যাস্তের রঙিন মিতালী যেকোনো ভ্রমণচারির হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করে ফেলতে যথেষ্ট।
পূর্ণিমার রাতে অনেক রোমাঞ্চ সন্ধানীরা এখানে চলে আসে ক্যাম্পিং করতে। ছোট ছোট প্রবালদ্বীপগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় পায়ে হেঁটেই পুরো দ্বীপাঞ্চলটি ঘুরে দেখা যায়। এই আদিম পরিবেশকে অবিস্মরণীয় রাখতে ছবি তোলার লোভ কেউই সামলাতে পারেন না। নিদেনপক্ষে, এটি দেশের সবথেকে আকর্ষণীয় ছবি তোলার স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে দ্বীপের দক্ষিণ পাশের জলরাশি অনেকটা স্বচ্ছ; আর তাই অনেক বেশি আকাশ রঙের। সমুদ্রের ঢেউ এদিকটায় বেশ শান্ত; তবে ছন্দময়।
ছেঁড়া দ্বীপসহ সেন্টমার্টিনের আশপাশের দ্বীপাঞ্চলে কেওড়া গাছের ঘনত্ব চোখে পড়ার মতো। এই গাছগুলো শুধু দ্বীপের সৌন্দর্য্যই বাড়ায় না, বরং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাকৃতিক দূর্গে রূপ নেয়।
কখন ছেঁড়া দ্বীপ ঘুরতে যাবেন
শীতকাল হচ্ছে এই দ্বীপ ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কেননা এ সময় সাগর অন্যান্য মৌসুমের থেকে যথেষ্ট শান্ত থাকে। এ মৌসুমের পুরোটাই তথা নভেম্বর থেকে এপ্রিলের শুরু অব্দি টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল করে। এরই ধারাবাহিকতায় নভেম্বর থেকে যতদিন গড়াতে থাকে পর্যটকদের ভিড় ততটাই বাড়তে থাকে। শীতে এই দ্বীপের আরও একটি আকর্ষণ হচ্ছে অতিথি পাখিদের ভিড়, যা নিঃসন্দেহে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
উষ্ণ ও বৃষ্টিপাতের মৌসুমগুলোতে এখানকার আবহাওয়া থাকে সংকটময়। সঙ্গত কারণেই বন্ধ থাকে জাহাজ চলাচল। তবে ট্রলারগুলোর যাতায়াত অব্যাহত থাকে। এগুলোতে ভ্রমণ করা গেলেও তা খুব একটা নিরাপদ নয়।
সেন্টমার্টিন থেকে স্পীডবোট কিংবা ট্রলারে করে ছেঁড়া দ্বীপসহ পুরো দ্বীপাঞ্চলটি একদিনেই ঘুরে আসা যায়। যারা দিনে গিয়ে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছেন— তাদের খুব সকালে চলে যেতে হবে ছেঁড়া দ্বীপে। যথাসম্ভব সকাল ৮টার আগেই দ্বীপে থাকা উত্তম। অপরদিকে যারা থাকার পরিকল্পনা করছেন তারা দুপুর ১২টা নাগাদ রওনা হবেন। কেননা ১২টার পর থেকে জোয়ার কমতে থাকায় পানির নিচ থেকে জেগে উঠতে শুরু করে কোরালগুলো।
ছেঁড়া দ্বীপে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
মূল দ্বীপ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এখানে খাবার এবং আবাসিক হোটেল কোনোটাই গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে জোয়ারের সময় বেশিরভাগ জায়গাই পানির নিচে তলিয়ে যায়। এখানকার খাবারের জায়গা বলতে স্থানীয় ডাব ও তরমুজ বিক্রেতা আর ২ থেকে ৩টি চায়ের দোকান। তাই এখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় কিছু খেতে হলে খাবার সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে।
একমাত্র বিকল্প হলো সেন্টমার্টিনে ফিরে গিয়ে খাওয়া। সেখানে থাকা-খাওয়ার প্রচুর ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ হোটেলেই পাওয়া যাবে কোরাল, গল্দা চিংড়ি, ইলিশ, রূপচাঁদা, সুন্দরী পোয়া ও কালাচাঁদার মতো সামুদ্রিক মাছ। সেন্টমার্টিনে বেশ কিছু উন্নতমানের হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে। এগুলোতে রাত্রিযাপনের জন্য খরচ পড়তে পারে ন্যূনতম ১ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ছেঁড়া দ্বীপে ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা
– ছেঁড়া দ্বীপে প্রবেশের আগে অবশ্যই স্থানীয় লোকজন বা হোটেল থেকে জোয়ার-ভাটার সময়টা ভালভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
– কোরাল বা প্রবাল তুলে সঙ্গে করে নিয়ে আসা উচিত নয়।
– পানিতে পা ডুবিয়ে হাটার ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। কেননা ধারালো কোরালে লেগে পা কেটে যেতে পারে। এক্ষেত্রে হাঁটার সুবিধার্থে কেড্স পড়ে নেওয়া যেতে পারে।
– একই কারণে পানিতে সাঁতার কাটার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। খুব বেশি গভীরে না যেয়ে সৈকতের কাছাকাছি থাকাটাই উত্তম।
– ভ্রমণ খরচ কমানোর জন্য ছুটির দিন বাদে অন্যান্য দিনগুলোতে যাওয়া যেতে পারে।
– দ্বীপের যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না। সঙ্গে খাবার নিয়ে গেলে তার উচ্ছিষ্ট বা মোড়ক সঙ্গে করে নিয়ে ফিরতে হবে।
ছেঁড়া দ্বীপ ভ্রমণ মানেই বিস্ময়কর এক দ্বীপপুঞ্জের মাঝে হারিয়ে যাওয়া। প্রবাল ঘেরা এই নৈসর্গের সান্নিধ্য প্রাণভরে উপভোগ করতে হলে পুরো সেন্টমার্টিন ট্যুরটাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে যেতে হবে। বিশেষত সকাল ৯টার আধঘণ্টা আগেই হাজির হয়ে যেতে হবে টেকনাফের জাহাজঘাটিতে। আর ফেরার সময় প্রস্তুত থাকতে হবে দুপুর ৩টার আগেই। পাশাপাশি সংযুক্ত দ্বীপগুলো পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখা যেতে পারে।