সমুদ্র সৈকত বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কেবল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, কুয়াকাটা কিংবা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের চিত্র। অথচ আমাদের দেশে আরও অনেক অপূর্ব সমুদ্র সৈকত রয়েছে। যার অনেকগুলো এখনও রয়ে গেছে পর্যটকদের অগোচরে। তেমনই এক অসাধারণ সমুদ্র সৈকত হচ্ছে ভোলার তারুয়া সমুদ্র সৈকত।
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে নদীবেষ্টিত গাঙ্গেয় দ্বীপ জেলা ভোলা। দক্ষিণ-পশ্চিমের আকাশে এক বিশেষ রত্নের মতো ছড়িয়ে আছে ভোলার তারুয়া সমুদ্র সৈকত। প্রকৃতি, প্রাণী এবং মানুষ—এই তিনের এক সুমধুর মিলনস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে তারুয়া। যেখানে একদিকে সাগরের তোলপাড়, অন্যদিকে শান্ত নির্জন বনের সমাহার। একপাশে সাদা বালির বিস্তৃতি, আর অন্যদিকে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের গভীরে নানা প্রজাতির অরণ্য।
ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রায় ৪২ থেকে ৪৮ বছর আগে একটি চর জেগে ওঠে, যা আজ তারুয়া সমুদ্র সৈকত নামে পরিচিত। এই সৈকতটি প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ, এবং এর একপাশে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপোসাগর আর অপরপাশে শোভিত বিন্তীর্ণ চারণভূমি, যার শেষ হয়েছে তারুয়া সৈকত সংলগ্ন ম্যানগ্রোভ বনে।একশত পয়ত্রিশ কিলোমিটার পাকা সড়কের পর পনের কিলোমিটার নৌ-পথ পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। তারুয়া সমুদ্র সৈকতের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এখানে আপনি একসাথে সমুদ্রের তাজা বাতাস, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের শীতল ছায়া এবং ভূমিতে চলমান প্রাণীদের এক অদ্ভুত সমাহার উপভোগ করতে পারবেন।
ঢালচরের ৩১ দশমিক ৩১ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২৮ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে সুবিশাল বনাঞ্চল। এর মধ্যে অন্যতম তারুয়া বন। এখানে পরিকল্পিতভাবে বনাঞ্চল শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। এ তারুয়া বনে রয়েছে গেওয়া, গরান, কেওড়া, বাইন, রেইনট্রিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ। বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু ভেতরে গেলেই মনে হবে, এ যেন আরেক ভূবন! সেখানে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিশাল একটি শীতল ছাঁয়া বিশিষ্ট মাঠ। স্থানীয়ভাবে জায়গাটা বরইতলা নামে পরিচিত।
প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে বঙ্গোপসাগরের বুক চিড়ে জেগে ওঠে সবুজের এই এলাকা। জেগে ওঠা ওই এলাকায় মাছ শিকার করতেন স্থানীয় জেলেরা। জেলেরা যখন নদীতে জাল ফেলতেন, তখন তারুয়া নামের শত শত এক প্রকার মাছ উঠে আসতো তাদের জালে। হয়তো সে কারণেই এই এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে তারুয়া। যা এখন সবার কাছে তারুয়া সমুদ্র সৈকত নামে পরিচিত।
তারুয়ার সৈকতে দেখা মিলবে চকচকে সাদা বালু আর লাল কাঁকড়ার মিছিল এবং বেলাভূমিতে কিছু বৈচিত্র্যময় প্রাণী, যেমন হরিণ, বানর, বণ্য মহিষ, শিয়াল, লাল কাকড়া, বন্য বিড়াল এবং অসংখ্য অতিথি পাখি। শীতকালে হাজারো অতিথি পাখি এখানে আশ্রয় নেয়, ফলে এই স্থানটি পাখিপ্রেমীদের জন্য একটি স্বর্গের মতো। পাখিদের কলতান, বনাঞ্চলের শান্ত পরিবেশ, আর সাগরের হালকা শোঁ শোঁ শব্দ—এই সব একত্রিত হয়ে তৈরি করে এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ।
তারুয়া সমুদ্র সৈকতে প্রায় ৩০০ ফুট দীর্ঘ, ল্যান্ডিং ষ্টেশন বানানো হয়েছে যেখানে ট্রলার ও ছোট লঞ্চ ভীড়তে পারবে। এছাড়া সৈকতের বিস্তীর্ণ প্রান্তর-জুড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি ভিন্ন সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।
প্রকৃতির আলো-আঁধারের বাহারি খেলার দেখা মেলে এখানে। তারুয়া সৈকতে দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যের আগমনী বার্তা দেখা যায়। পাশাপাশি সন্ধ্যার আকাশে সিঁড়ি বেয়ে এক পা দু’পা করে রক্তিম সূর্যের সাগরের বুকে হারিয়ে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্যও এখানে দেখতে পাওয়া যায়। পুরো সৈকত লালিমায় ভরে ওঠার সেই অতুলনীয় দৃশ্য পর্যটকদের সম্মোহিত করে রাখে। পর্যটক আর ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে মুগ্ধতার বন্ধনে আবদ্ধ করার যাদুকরী শক্তি রয়েছে চমৎকার তারুয়া সমুদ্র সৈকতের।
তারুয়া সমুদ্র সৈকতে যে অভিজ্ঞতাগুলি চমকে দেওয়ার মতো,সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, মৎসভিযান, কাঁকড়ার মিছিল, এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য। সৈকতের সাদা বালিতে হাঁটার সময় যদি চোখে পড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি, তবে তা যেন এক নতুন পৃথিবীতে ঢুকবার অনুভূতি। গাছের শুকনো গুঁড়ি, মরা গাছের ছায়া, বালি এবং জল—সব মিলিয়ে এখানে আছড়ে পড়া বঙ্গোপসাগরের ঢেউ যেন এক প্রকৃতির গান গায়, যা মনের গভীরে গেঁথে যায়।
তারুয়া সমুদ্র সৈকত সত্যিই এক অনন্য সৌন্দর্যের আধার। এখানে আসলে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যই দেখা যায় না, জীবনের এক নতুন দিগন্তের সাথে পরিচয়ও ঘটে। এখানকার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বর্ণিল আলোকচ্ছটা মোহিত করবে যে কাউকে। চাঁদনি রাতে এ সৈকত যেন জেগে ওঠে। মায়াবী আলোয় যেন প্রকৃতিপ্রেমীরা শিহরন অনুভব করে। শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে একটু সময় বের করে প্রকৃতির এ নিস্তব্ধতা আর শুদ্ধতায় হারিয়ে যেতে পারে এক আত্মপরিতৃপ্তি ঘটায়।