1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৫ পূর্বাহ্ন

অচেনা চেন্নাই

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৪

একই শহরে প্রচুর মসজিদ, মন্দির আর গির্জা যে একসঙ্গে থাকতে পারে, তা চেন্নাই না এলে জানতাম না। আমি যখন চেন্নাইয়ের মাটিতে পা রেখেছি তখন সূর্য ডুবুডবু। আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিতে এসেছেন একজন চালক, মোস্তফা। হোটেল পর্যন্ত তার সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে এলাম। আর চলার এ পথটুকুতে চোখে পড়ল প্রচুর মন্দির, বেশ কিছু বড় মসজিদ আর গির্জা।

ট্র্যাফিক ব্যবস্থা অনেকটা ঢাকার মতোই। পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল যেসব মোড়ে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা আর গাড়িগুলো হুড়োহুড়ি করছিল, সেসব মোড়ে। তবে মূল শহরের প্রায় প্রতিটা মোড় চৌরাস্তার মোড়। প্রায় সব রাস্তাই সোজা। চোখে পড়ল মেট্রোরেল। ফ্লাইওভারগুলোও ঢাকার মতো। তবে কলকাতায় যেমন সবাই ট্র্যাফিক নিয়ম খুব মেনে চলে, এখানে তেমনটা কম।

চেন্নাইতে আমার প্রথম দিনটাই ছিল অশুভ। সকালে হোটেলে নাস্তা করার সময় খবর দেখলাম, নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চ এর আল-নূর মসজিদে মর্মান্তিক হামলা হয়েছে জুমার সময়। আমাদের ক্রিকেট টিম অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে!

আমার কাজ ছিল শহর থেকে ৪০ কি.মি. দূরে একটা টাওয়ার টেস্টিং স্টেশনে। আমাদের দলে একজন জাপানি, আমরা তিনজন বাংলাদেশি। তারা আমার ক্লায়েন্ট। আমার দায়িত্ব তাদের টেস্ট স্টেশনে নিয়ে যাওয়া এবং আমাদের তৈরি টাওয়ারের কিছু লোড টেস্ট করা (টাওয়ারের ডিজাইন, লোড নেবার ক্ষমতা ও ম্যাটেরিয়াল সংক্রান্ত)। গাড়ি আগেই ভাড়া করা ছিল। আমরা যে এলাকায় (কাঞ্চিপুরাম) যাচ্ছিলাম সেটা কিছু অনুন্নত। শিল্প এলাকা এবং জনবসতি কম। দুপুরে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের মেনুতে পাপড়, নারকেল, টমেটো, ডাল ইত্যাদি নিরামিষ।

অনেকগুলো পদ, তবে স্বাদে তেমন বৈচিত্র্য নেই। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা খাবার ততটা পছন্দ করলেন না নারকেলের আধিক্যের জন্য। আমার ভালোই লাগলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে টেস্টে টাওয়ারের কিছু অংশ ফেল করলো। আমরা ক্রেনে করে প্রায় ১২০ ফিট ওপরে উঠলাম ময়নাতদন্ত করতে। সেই টেকনিক্যাল আলোচনায় যাব না।

গোটা সফরে একটা জিনিস বারবার উপলব্ধি করেছি, সেটা হলো যোগাযোগ। বিভিন্ন কারণে কখনো বাংলাদেশে, কখনো ভারতের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। আমার সঙ্গে একটা ভারতীয় সিম ছিল, কিন্তু গত কয়েক মাসে সেটায় ব্যালেন্স রিচার্জ না করায় ডিঅ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেছে। ভীষণ সমস্যা হয়েছে আমার সাথে কোনো ভারতীয় সিম না থাকায়। (এমন কি ওষুধ বা কাপড় কেনার সময়ও ওরা মোবাইল ফোন নম্বর চায়!)

অচেনা চেন্নাই

ভাষাগত সমস্যা এখানে সাংঘাতিক। আমি যে চার তারকা হোটেলে ছিলাম, সেখানে সবাই ভালো ইংরেজি জানে, হিন্দিও জানে। কিন্তু যখন হোটেলের আশপাশে ঘুরতে বের হলাম, দেখলাম এরা না জানে হিন্দি, না জানে ইংরেজি। ইশারা আর দুয়েকটা ইংরেজি শব্দ দিয়ে কাজ চালাতে হয়। হোটেলের কাছেই এগমোর রেলস্টেশন। ছোট স্টেশন। তার পেছনেই মেট্রোরেল স্টেশন। যেটা ভালো লাগলো, সেটা হলো মেট্রোরেলের যাত্রীরা যদি বাইক নিয়ে আসে, তারা সারাদিনের জন্য এখানে বাইক পার্কিং করতে পারবে। আমার মনে হয় না ঢাকার মেট্রোরেল এই সুবিধা দিতে পারবে। আসলে চেন্নাই ঢাকার মতো ঘনবসতি পূর্ণ নয়। এখানকার রাস্তাগুলো সুপরিকল্পিত। বিদ্যুতের লাইন গেছে মাটির নিচ দিয়ে।

চেন্নাইয়ের বড় বৈশিষ্ট্যের কথাই বলা হয়নি। হাসপাতাল। প্রচুর বড় বড় হাসপাতাল ছড়িয়ে রয়েছে গোটা চেন্নাইজুড়ে। আমার ধারণা এদের সবচেয়ে বড় কাস্টমার সেগমেন্ট হলো বাংলাদেশ। এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করলাম ইচ্ছে করে। আমার বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশেও উন্নত চিকিৎসা সেবা আছে। তাই জানতে চাইছিলাম, কেন মানুষ এত কষ্ট করে এত দূর আসেন।

যা জানা গেলো, তার সারসংক্ষেপ হলো, বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসার খরচ এত বেশি যে, তার চেয়ে কম খরচে মানুষ চেন্নাই, ভেলোর, মাদ্রাজ, বেঙ্গালোর – এসব জায়গায় ছুটে আসছেন। মেডিকেল ভিসা নিয়ে কেউ আসছেন, কেউ টুরিস্ট ভিসা নিয়ে। ভারতের ইমিগ্রেশন আবার খুব ঝামেলা করে যখন ধরতে পারে যে, কেউ টুরিস্ট ভিসা নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছে।

মেডিকেল অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবেও ভিসা পাওয়া যায়, তবে স্বল্পমেয়াদি। রোগীর সাথী হিসেবে এসে অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিশেষ করে, মেডিকেল চেকআপটা করাতে কেউ বাদ রাখেন না। আমারও একবার ইচ্ছা হলো একটা চেক আপ করিয়ে যাই, বয়স তো চল্লিশে পা রাখতে চলেছে। সে সময় বা সুযোগ হলো না। চলতি পথে বিভিন্ন হাসপাতাল দেখছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম, সবাই যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। জানি না, আমাকে কোনোদিন নিজের বা পরিবারের চিকিৎসা নিতে এখানেই আসতে হবে কি না…। আল্লাহ যেন সেই পরিস্থিতিতে না ফেলেন।

অচেনা চেন্নাই

টাওয়ার টেস্ট যেহেতু অসফল, আমাদের থাকার মেয়াদ তাই কমানো দরকার ছিল। টিকিট বদলাতে গিয়ে পড়লাম আরেক সংকটে। বোয়িং ৭৩৭ আগামী মে মাস পর্যন্ত ‘গ্রাউন্ডেড’ করায় আমরা প্রায় সব এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট বদলে দিতে হচ্ছে। বোয়িং এর যাত্রীদের অন্য বিমানে সিট দিতে গিয়ে আমার টিকিট একদিন পিছিয়ে দিলো স্পাইস জেট। অথচ আমি চাইছি দ্রুত ফিরতে। আমার ক্লায়েন্টদের টিকিটও পিছিয়ে দিয়েছিল স্পাইস জেট। অনেক চেষ্টায় আমরা ২ দিন আগের টিকিট পেলাম, তবে এয়ার ইন্ডিয়ায় এবং বেশ চড়া মূল্যে। এই এয়ারলাইন্সগুলো একেবারে ডাকাত!

চেন্নাই পর্যটনের জন্য বিখ্যাত নয়। তবে মেরিনা বিচের নাম শুনেছিলাম। সেটাই আমার জাপানি ক্লায়েন্ট কুশি সাহেবকে নিয়ে দেখতে গেলাম। যেহেতু পথ চিনি না, ভাষাও বুঝি না, তাই হোটেল থেকে অটো ভাড়া করে গেলাম। গিয়ে দেখি হেঁটেই আসা যেত। আধঘণ্টার হাঁটা পথ, অটো আমাদের ঘুরিয়ে ঘারিয়ে দেড়শ রূপী খসিয়ে নিয়ে এলো। বিচ দেখে কুশি সাহেব বেশ খুশি।

এমনিতেই টাওয়ার নিয়ে আমাদের দু’জনেরই মন খারাপ ছিল (কারণ, প্রজেক্টটা বেশ পিছিয়ে যাবে টাওয়ারের ডিজাইন বদলে আবার টেস্ট করাতে হবে বলে। মেরিনা বিচ কক্সবাজারের কাছে নস্যি। তবে এর ঢাল বেশ খাড়া। আমরা সূর্যাস্তের আগে গিয়েছিলাম। ও মা! সূর্য তো পেছনে ডোবে, সমুদ্রে শুধু সূর্য উদয় হয়। যা হোক, খোলা হাওয়ায় ঘোরাঘুরি হলো, কেনাকাটা হলো। সামুদ্রিক মাছে মসলা মাখিয়ে রাখা ছিল, বললেই ভেজে দেবে। দেখে রুচি হলো না। ভুট্টাপোড়া , ফলের রস, সমুচা, পানিপুরী – এসব বেশ বিক্রি হচ্ছে।

রোববারটা কোনো কাজ হলো না। সোমবার একটু কাজে বের হলাম। আর শহর থেকে দূরে আরেকটা দারুণ বিচ আবিষ্কার করলাম পথ থেকে। কোবলাং বিচ। দারুণ সুন্দর! যেমন নীল জলরাশি, তেমন ঢেউ। আর আছে বড় বড় প্রবাল। ফেরার পথে স্নেক পার্ক দেখার ইচ্ছে পোষণ করলেন আমার ক্লায়েন্টরা। সাপ আর কুমির দেখে কী বিনোদন জানি না, তবে তাদের সাথে আমিও কিছু দেখে নিলাম। সন্ধ্যা অবধি বিগ বাজারে কেনাকাটা করলেন তারা। আমি সঙ্গ দিতে দিতে কিনলাম কিছু কিছু। শপিংমলটার নাম এক্সপ্রেস অ্যাভিনিউ। আমাদের বসুন্ধরা শপিং মলের মতোই। সিনেপ্লেক্স দেখে অবশ্য আমাদের সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি দেখার শখ হয়নি।

সব মিলিয়ে একটা গোছানো শহর চেন্নাই। একটা রিপোর্ট জোগাড় করতে এক আবাসিক এলাকায় ঢুকে মফস্বলের পরিবেশ পেলাম। এক সহকর্মীর জন্য কিছু ওষুধ কিনব বলে ফেরার আগের রাতে হোটেলের আশপাশে ঘুরতে ঘুরতে বেশ খানিকটা ঘোরা হয়ে গেলো। অনেক রাস্তাই খুব নোংরা। আমাদের মালিবাগ/খিলগাঁওয়ের মতো।

সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল এলাকার বিদঘুটে সব নাম। বেশিরভাগই দাঁত ভাঙা। আর শহরের বাস সার্ভিস বেশ ভালো। সব বাস দেখতে এক রকম। রুট নম্বর দেখে উঠে পড়লেই হলো। বাস স্টপেজগুলোতে লেখা আছে ওখানে কোন কোন রুটের বাস থামবে। প্রচুর বাস, কেউ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে না। কারণ একটা বাস যেতে না যেতেই আরেকটা আসছে। তবে রুট নম্বর দেখে বোঝার উপায় নেই কোন বাস কোন এলাকায় যাবে। স্থানীয় না হলে বাসে চড়ে ভুল জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঢাকায় এমন বাস সার্ভিস চালু এখন সময়ের দাবি।

লুঙ্গি পরে মোটরসাইকেল চালানো, হেলমেট না পরা, চারজন একসাথে চড়া – এসব এখনও চেন্নাইয়ের সংস্কৃতি। তবে প্রায়ই চোখে পড়ল ফুটপাথে হেলমেট আর সানগ্লাসের হকার। মোড়ে মোড়ে হেলমেট পরার সাইনবোর্ডও চোখে পড়ার মতো। আরেকটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল অনেক জায়গায়। Don’t drink and drive. Fast Driving can be your last driving- কথাটাও লেখা দেখলাম অনেক মোড়ে মোড়ে।

শাহরুখ খানের ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ যখন দেখেছিলাম, তখন কল্পনাতেও আসেনি এই শহরে একদিন আসব। ছোটখাট নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছি। চেন্নাই নিয়ে এই পুরো লেখাটা লিখলাম আকাশে বসে। চেন্নাই থেকে কলকাতা ২ ঘণ্টার আকাশপথ। যদিও মেঘ দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে, কিন্তু মেঘের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে বিমানের জানালা দিয়ে অসীম নীলাকাশ দেখতে ভালো লাগে না, বুকের ভেতর কেমন যেন খাঁ খাঁ করে। হাত দিয়ে মেঘ স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে…

কাজী মনজুর করিম মিতুল

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com