সব পেয়েছির দেশ তাইল্যান্ড। ল্যান্ড অফ স্মাইলস। হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানার নাম তাইল্যান্ড। এই দেশটায় এলে অন্তত কিছুদিনের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক চিন্তাগুলো সরিয়ে রাখাই যায়। সমুদ্রের বুকে রয়েছে কয়েকটা দ্বীপ, যেগুলো তৈরি করেছে, ফি ফি দ্বীপপুঞ্জ।
একদল মানুষকে নিয়ে জাহাজ সি এঞ্জেল পাড়ি দিল দ্বীপের দিকে। ফুকেত থেকে ফি ফি পৌঁছতে ঘণ্টাদুয়েক সময় লাগে। পোর্ট হোল গিয়ে দেখা যাচ্ছে মূল ভূখণ্ড অনেকটা পিছনে চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ডেক-এ যাওয়ার অনুমতি পেলাম আমরা। নীল আকাশ আর নীল সাগর মিলেমিশে একাকার, শুধু রয়েছে মাঝখানে সূক্ষ্ম দিগন্ত রেখা। জাহাজের পাশ দিয়ে দু’-চারটে স্পিডবোট চলে যাচ্ছে। মাথার উপর বেশ চড়া রোদ। জোরালো নোনা হাওয়া সূর্যের তাপ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ডেক-এ মানুষের ভিড় বাড়ছে। সারা ডেক জুড়ে গদি আঁটা সোফা। একটি মেয়ে থার্মোকলের বাক্সে বিয়ার নিয়ে এল, মিউজ়িক সিস্টেমে গানও চালিয়ে দিল। ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা মানুষজন বরফ শীতল বিয়ার কেনার জন্য জড়ো হচ্ছে। বিদেশিরা গানের তালে তালে শরীর দোলাচ্ছে।
জাহাজ যত এগোতে লাগল, জলের মধ্যে থেকে ভেসে উঠল পাহাড়। বহু দূর থেকে পাহাড়গুলোর রং মনে হচ্ছে নীল। যত এগিয়ে এল, নীল রং পালটে গেল কালো রঙের দুর্গের মতো পাহাড়ে, যার গায়ে সবুজ গাছ-গাছালির ছোপ। জলের মাঝখান থেকে যেন জেগে উঠেছে নারায়ণ শীলা।
ফি ফি তে দুটো দ্বীপ আছে, ফি ফি-লে এবং ফি ফি-ডন। ফি ফি-লে মানুষের বসবাসের যোগ্য নয়। ফি ফি-ডন তার সৌন্দর্যের জন্য প্রচুর পর্যটককে টেনে আনছে। পাহাড় ঘেরা এই দ্বীপ ঘিরে রেখেছে সাদা বালি আর পান্না রঙের জল। ফি ফি-লে আর ফি ফি-ডনের মধ্যে দূরত্ব মোটে দেড় কিলোমিটার। জাহাজ লে কে পাশ কাটিয়ে ডনের দিকে এগিয়ে চলল। লে-র পাহাড়গুলোর ভিতর দিয়ে যাওয়া জলের অলিগলি পথের মধ্যে নানা রঙের নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্পিডবোট জলের উপর ছায়াপথ তৈরি করে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কালো পাহাড়কে পিছনে রেখে সামনের স্পিডবোট দেখতে লাগে যেন একটা ছোট মুক্তোদানা। জাহাজ এসে ভিড়ল ফি ফি দ্বীপের টনসাই বে-তে।
আরও দু’-তিনটে জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, দু’-চারটে বোটও আসছে, আবার কোনওটা দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বোট স্টেশনে প্রচুর লোকজনের ভিড়। এগিয়ে চললাম জেটি ঘাটের ব্রিজ ধরে। মাথার ওপর চড়া রোদ্দুর। ব্রিজের দুধারে জলের উপর বাঁধা লং টেল বোট। জেটটির ওপর খুব ভিড়। কিন্তু মানুষজনের কোনও তাড়া নেই, অলস গতিতে যাচ্ছে। কেউ ঢুকছে, কেউ বা বেরোচ্ছে বোটে করে আশেপাশের দ্বীপে ঘুরতে যাবে বলে। নৌকাগুলোর নাম টেলবোট, কারণ এদের একটা প্রান্ত উপরের দিকে উঠে গিয়েছে ল্যাজের মতো। প্রখর রোদ্দুর মাথার উপর, রং-বেরঙের টুপি মাথায় সকলের। চারিদিকে শুধু পশ্চিম দুনিয়ার মানুষ ভর্তি। নারী-পুরুষ সকলেই বেশ স্বল্প পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা প্রায় সকলেই এসেছে যেসব দেশ থেকে, সেগুলো কয়েক ফুট বরফের তলায় থাকে শীতকালে, যেমন রাশিয়া, আমেরিকা বা ইউরোপে। সূর্যের তাপ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই যেন সূর্যের আলোয় স্নান করে সব শৈত্য পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে।
এত ভিড়ের মধ্যেও কিন্তু দ্বীপটা ঝকঝক করছে! এই জায়গাটা মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই দূর, এখানে পা রাখতে গিয়ে মনে হয় সময় থমকে গিয়েছে। কোনও তাড়া নেই। এখানে কোনও মোটরচালিত গাড়ি নেই, তাই রাস্তাও নেই, আছে শুধু ফুটপাথ। শুধু পায়ে হেঁটে যাওয়ার পথ। কংক্রিটের চওড়া পথ সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। পথের দু’দিকে সারি দিয়ে দোকান। ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে ঠেলাগাড়ি। সেগুলোকে রাস্তার একপাশে কাত করে রাখা আছে। এ দেশে চুরির ভয় নেই। একটা জিনিস ফেলে রেখে গেলে আবার সেখানে এসেই সেটা পাওয়া যায়।
দু’পাশের দোকানে কতরকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে, পোশাক আসাক, সুভেনির, ব্যাগ, সাঁতারের পোশাক, খাবার জিনিস। জায়গা অনুযায়ী প্রকৃতিও নিজেকে সাজিয়ে নেয়। এই গরমে এখানে পাওয়া যাচ্ছে নানা রকম রসালো ফল। এখানকার আম প্রায় আধ হাত লম্বা। ডাব, নারকেল আর নারকেল দিয়ে খাবারের কতরকম ফের। নারকেল শাঁসের তৈরি কেক ও পাওয়া যায়। দোকানে বিক্রি হচ্ছে বরফ ঠান্ডা ডাবের জল, ভিতরে মোটা শাঁস। অনেক দোকানই এখানে বাড়ি লাগোয়া। বাঁশের বেড়া দিয়ে সামনে একটু ঘিরে দেওয়া হয়েছে। ছোট্ট বোর্ডে এ লেখা আছে ফ্রি ওয়াইফাই।
একটি দোকানে আনারস বিক্রি হচ্ছে,অন্যান্য ফলও পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ির বারান্দায় দোকানি বসেছে পসরা নিয়ে। কয়েকটা বেতের সোফা ও টেবিল পাতা। টেবিলে এর নীচে ছোট্ট জলের চৌবাচ্চা মতো, সেখানে শালুক ফুল ফুটে আছে। এই গরমে কী শীতল শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ! বয়স্ক সাহেব-মেম হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল আইসক্রিম নেবে বলে। দোকানির একটু সময় লাগছে কারণ শাঁস ওয়ালা ডাব বাটির মতো করে কেটে, তার মধ্যে দেওয়া হবে।
ফি ফি-র এই জায়গাটার নাম টনসাই ভিলেজ। কংক্রিটের রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চলছি। পাঁচিলের উপর থেকে গাছ, তাতে ঝুলছে অর্কিড ফুল। ছায়া ঘেরা পথ শেষ হতেই সামনেই এসে পড়ল পাহাড় আর সাদা বালু দিয়ে ঘেরা আসমানি নীল সাগর। একধরনের রঙিন লম্বা সরু নৌকা বিচের উপর উলটো করে রাখা আছে। পুরোটাই যেন ঝাঁ চকচকে পিকচার পোস্ট কার্ডের ছবি।
অনেক লম্বা বিচ, পরিষ্কার বালি, কোথায় এতটুকু ময়লা নেই। জল কাচের মতো স্বচ্ছ। কতরকমের বোট ঘুরে বেড়াচ্ছে জলের উপর। সমুদ্র সৈকত যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু হয়েছে গাছ-গাছালির রাজ্য। এই গাছ-গাছালির ভিতর থেকে উঁকি মারছে বাড়ি ঘর, এগুলোর বেশিরভাগটাই হোটেল। এখানে অনেকগুলো বিলাসবহুল হোটেল আছে।
টনসাই-বে থেকে একটা রাস্তা টনসাই ভিলেজের দিকে আর একটা দক্ষিণে ও আর একটা পশ্চিমদিকে চলে গিয়েছে।
ফি ফি দ্বীপে অনেকগুলো বিচ আছে। তার মধ্যে লং বিচের আবহাওয়া সব সময়ই ভাল। তবে শীতকালে আরও ভাল লাগে জায়গাটা। সন্ধ্যা নামে ধীর-মন্থর গতিতে। পর্যটকদের একটা বড় অংশ ফিরে গিয়েছে ফুকেতে সন্ধে নামার আগেই। সমুদ্র সৈকতের সেই ভিড় আর নেই। জেটি ঘাটের ব্যস্ততাও অনেক স্তিমিত। প্রকৃতি ছেড়ে মানুষ মেতে ওঠে অন্য নেশায়। শুরু হয় নৈশজীবন। সকালের বন্ধ থাকা নাইটক্লাবগুলো প্রাণ পায়। অন্ধকার হয়ে গেলেও দ্বীপ কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ে না। লাস্যময়ী হয়ে জেগে থাকে। পান্না রঙের জল তখন ধূসর রঙের লাগে।
ফি ফি-লে মানুষের বসবাসের অযোগ্য। এখানে একমাত্র মায়া-বে তেই টুরিস্টরা যেতে পারেন। স্বচ্ছ নীল জল, মিহি বালি, সবুজ সুন্দর গাছগাছালি,আর দুর্গের মতো ঘিরে থাকা গাছপালা আর শ্যাওলা ধরা শিলাখণ্ড। অনেক লং টেলবোট এখানে যাত্রী নিয়ে এসেছে। কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে সকলে আবার ফি ফি তে ফিরে আসে। ফি ফি-লে পাহাড়ের গায়ে একদম নীচের দিকে একটা গুহা আছে। সেটার বিপজ্জনক অবস্থার জন্য কোনও যাত্রীকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বলা হয়, কোনও এক সময় বিপদগ্রস্ত জাহাজের নাবিকরা এখানে আশ্রয় নিত।
ফি ফি-ডনের ভিউ পয়েন্ট থেকে পুরো দ্বীপটা দেখা যায়। জায়গাটা সামান্য একটু উঁচু পাহাড়ের উপর। সুন্দর পথ দিয়ে আধঘণ্টা হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। পথে থেমে থেমে যেতে বেশ ভালই লাগে। উপর থেকে দ্বীপটাকে দেখতে লাগে ইংরেজির এইচ অক্ষরের মতো। একদিকে টনসাই-বে, অন্যদিকে ডালুম-বে আর মাঝখানের জায়গাটা টনসাই ভিলেজ। ভিউ পয়েন্টে আছে খাবারের দোকান, সুন্দর বসার জায়গা, এমনকী হ্যামকও ভাড়া পাওয়া যায়।
ফি ফি দ্বীপপুঞ্জের আর একটা দ্বীপ ব্যাম্বু দ্বীপ। এই দ্বীপটি ৭০০ মিটার লম্বা ও ৬০০ মিটার চওড়া। সাদা বালি লেসের মতো ঘিরে রেখেছে গাছ-গাছালির এই দ্বীপকে। এই সবুজ দ্বীপে কেউ রাত কাটায় না।
ফিফি দ্বীপের অপ্রতিরোধ্য সৌন্দর্য ফেলে বেরিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হয়। বিধাতা কী অকৃপণভাবে সাজিয়েছেন এই দ্বীপকে! রঙের সাংঘাতিক বৈচিত্র। মন চায় না ছেড়ে আসতে। ফুকেত ফেরার ফেরিতে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে আবার সময়ের হিসেব শুরু করতে হয়। ফি ফি-তে প্রতিদিন অগুনতি মানুষ যাচ্ছে। দ্বীপ কারওর কথা মনে রাখে না, সে নিজেকে প্রতিনিয়ত সাজিয়ে তুলছে, আর আমাদের মুগ্ধ করছে। তাই দ্বীপ আমাদের ভুললেও আমরা কিন্তু তাকে কিছুতেই ভুলতে পারি না।