1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

মেঘ–পাহাড়ের রাজ্য স্নোডনিয়া ভ্রমণ

  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪
মেঘ–পাহাড়ের রাজ্য স্নোডনিয়া ভ্রমণ
ছয়–সাত ঘণ্টার যাত্রাপথে, আরও কয়েকবার যাত্রাবিরতি নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছি এ রকমই আরেকটা সার্ভিস সেন্টারে। মোটরওয়ের পাশে ঘণ্টাখানেক পরপর এসব সার্ভিস সেন্টার থাকে। এখানে পেট্রোল স্টেশনের পাশাপাশি ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, বার্গার কিং, সাবওয়ে, কস্তা কফি ছাড়া মিনি সুপারমার্কেট, প্লে জোন, যাত্রীদের ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থাও থাকে। বাচ্চাদের পছন্দ আলাদা হওয়ায়, দুপুরে একেকজন একেক খাবার নিয়েছে। আমি নিলাম কেএফসির একটা বড়সড় বাকেট আর কফি। সময় বাঁচানোর জন্য আমরা গাড়িতেই খেয়ে নিলাম।

ইংল্যান্ডে গ্রীষ্মকাল প্রায় শেষ হওয়ার পথে। শীত আসি আসি করেও আসছে না। আবহাওয়া এখন খুবই চমৎকার। ঝকঝকে উজ্জ্বল রোদের সঙ্গে হালকা হিমের আভাস। দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। যেদিকে দৃষ্টি যায়, মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা রঙিন ক্যানভাস। লন্ডন থেকে বের হলেই হাইওয়ের দুপাশের চেহারা বদলে যেতে থাকে। হাইওয়ের দুপাশে কখনো সবুজ বন, কখনো–বা বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর যাত্রাপথের দৃশ্য যে কারও চোখ জুড়িয়ে দেবে। সৃষ্টিকর্তা ওয়েলসকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সম্পদ উজাড় করে দিয়েছেন। বেশ কটি শহর পার হয়ে আমরা গন্তব্য স্নোডনিয়ার দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ততই চোখধাঁধানো সৌন্দর্য আমাদের পাগল করে দিচ্ছিল। এক পাশে গাঢ় নীল জলরাশি, আর আরেক পাশে আকাশছোঁয়া সবুজ পাহাড়ের সারির মধ্যে মসৃণ আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ। মাঝেমধ্যেই সবুজ পাহাড়ের গায়ে দেখা মিলছে সুউচ্চ প্রাচীন দুর্গ আর প্রাসাদের। আর মেঘের ফাঁক গলে বারবারই উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল রবিমামা।

পাথরযুগ, ব্রোঞ্জযুগ ও লৌহযুগ পার করে হাজার বছর ধরে এখানে বসতি গড়ে তুলেছেন ল্যান্ডাডনোর অধিবাসীরা। ল্যান্ডাডনোতে চুনাপাথরের ল্যান্ডএন্ড সোজা সমুদ্রে গিয়ে নেমেছে। যেন সমুদ্র এসে সকাল–বিকেল চুমু খাচ্ছে গ্রেট অম্ব্রের পায়ে, যা নাবিকদের কাছে ‘গ্রেট অম্ব্রে’ আর ভূমিদস্যুদের কাছে পরিচিত ছিল ‘ক্রেউডিন পেনিনসুলা’ নামে।

পড়ন্ত বিকেলে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্যে। গাড়ি থেকে বাক্সপেটরা নামিয়ে কোনোরকমে রুমে রেখেই আমরা ছুটলাম ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ পিয়ার বা জাহাজঘাট দেখতে। ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পিয়ারের গায়ে। আমাদের দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল সমুদ্রের একঝলক হিমেল হাওয়া। পছন্দমতো ডোনাট, হট চকলেট আর আইসক্রিম খেয়ে সবাই চাঙা হয়ে নিলাম। আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল আরেকটি বন্ধু–পরিবার। সবাই মিলে হালাল খাবারের রেস্টুরেন্ট খুঁজতে বের হলাম। ছোট্ট ছিমছাম ট্যুরিস্ট টাউন। পরিচ্ছন্ন রাস্তার দুই পাশে বাহারি ফুলের সমাহার। সন্ধ্যা সাতটায় বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলেও পাব আর বারগুলোর উপচে পড়া ভিড় বাইরের ফুটপাতে এসে জটলার আকার ধারণ করেছে।

রুমে এসে জানালা খুলে দিতেই একরাশ মুগ্ধতা আমাকে আবিষ্ট করে ফেলল। চোখের সামনে যেন রাতের বালামোরি দেখছি। আলোর সারিকে মনে হচ্ছে বুঝি সমুদ্রের গলায় হীরার মালা দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আমাদের রুমটা সমুদ্রমুখী হওয়ায় হু হু করে এসে ঢুকছে নেশা ধরানো হাওয়া। তীরে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দে মনে হচ্ছে যেন, আমি দাঁড়িয়ে আছি মাঝসমুদ্রে জাহাজের ডেকে আর দূর থেকে তীরের আলো উপভোগ করছি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম জানালার সামনে। জানালা খোলা থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে, তাই জানালা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলাম একরাশ ভালো লাগা নিয়ে।

যে হোটেলে আমরা ছিলাম, সেটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। মূলত ১৮৫৫ সালে একটি বাথহাউস বা ‘স্নানাগার’ তৈরি করে, স্নানাগারের নিচে ল্যান্ডাডনো পিয়ার বানানো হয়। কিন্তু ১৮৫৯ সালে উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক ঝড় রয়েল কার্টারের আঘাতে বাথহাউস এবং পিয়ারের মারাত্মক ক্ষতি হয়। পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে বাথহাউস ও কম্লেক্সের পুনর্গঠন করা হয় স্থপতি জেমস ফ্রান্সিস ডয়েলের নকশায়। ১৯০২ সালে এটি ‘গ্র্যান্ড হোটেল’ নামে চালু হয়। বর্তমানে গ্র্যান্ড হোটেল ‘ব্রিটানিয়া হোটেল’ এর মালিকানাধীন। ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে গ্র্যান্ড হোটেল পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।

দ্বিতীয় দিন

হঠাৎ জানালায় টকটক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। পর্দা সরাতেই চোখ ধাঁধিয়ে দিল ভোরের সোনালি আলো। আসলে আমার ঘুম ভাঙিয়েছে এক সুদর্শন সিগাল। বড় বড় চোখ মেলে যেন বলতে চাইছে, ‘এত ঘুমাচ্ছ কেন? বেড়িয়ে পড়ো। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখো দুচোখ মেলে আর প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করো প্রাণ ভরে।’ জানালা খুলে দিতেই সিগালটি উড়ে গিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দিল আর হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল সমুদ্রের বার্তা নিয়ে আসা মিষ্টি হিমেল হাওয়া। শব্দ করে তীরে আছড়ে পড়ছে নরম রোদে ঝিকমিক করা ছোট ছোট ঢেউ আর খাবারের খোঁজে ওড়াউড়ি করছে একঝাঁক সিগাল।

প্রথমে গেলাম গ্রেট অরমের বিখ্যাত ক্যাবল কারে। ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ডের দীর্ঘতম যাত্রীবাহী ক্যাবল কার চালু করা হয়। হ্যাপিভ্যালি থেকে যাত্রা শুরু করে ৬৭৯ ফুট উঁচুতে গ্রেট অরমের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছায়। ৯ মিনিটের এই অভিযাত্রায় ক্যাবল কার থেকে ল্যান্ডাডনো বে, লিটিল অরমে, আবহাওয়া ভালো থাকলে এমনকি দূরের আয়ারল্যান্ডের অবয়ব চোখে পড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে হ্যাপিভ্যালির সাজানো বাগানের মায়াময় সৌন্দর্য। আবহাওয়া খারাপ থাকায় এক ক্যাবল কারে দুইজনের বেশি উঠতে দেওয়া হয়নি। আমার ছেলে তার বাবাকে ছাড়া উঠবে না, তাই আমি উঠলাম আরেক ভাবির সঙ্গে। কয়েক মিনিট পরই শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া। মাথার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছিল পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। মাঝেমধ্যেই উড়ে এসে কুয়াশার মতো ঝাপটা মারছিল আমাদের চোখেমুখে। যতই ওপরে উঠছিলাম, ততই ঠান্ডা বাড়ছিল। সংক্ষিপ্ত ডাত্রা শেষ করে আমরা গ্রেট ওরমের সামিটে পৌঁছালাম। মেঘ কেটে আবার ঝকঝকে রোদের দেখা মিলল। ল্যান্ডাডনোর এক পাশে আইরিশ সি, আর আরেক পাশে কনভি নদীর মোহনা। পাহাড়ের চূড়া থেকে আইরিশ সির অনেকটাই চোখে পড়ছে। নিচের নীল জলরাশি দিগন্তে আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। এক পাশে দেখা যাচ্ছে উইন্ডমিলের সারি। ল্যান্ডাডনো বে-তে ওয়াটার স্কিয়িং অনেক জনপ্রিয়। দুরবিন দিয়ে দেখলাম দূরের আয়ারল্যান্ড।

এখানে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল আরও দুটি বন্ধু–পরিবার। সবাই মিলে ঘুরে দেখলাম, ছবি তুললাম। দেখলাম, কিছু পাহাড়ি ছাগল লাফিয়ে লাফিয়ে খাড়া পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। দূরের আরেকটা পাহাড়ের গায়ে পাথর সাজিয়ে নাম লিখে গিয়েছে অনেক অভিযাত্রী। গ্রেট অরমের চূড়ার বিশুদ্ধ বায়ুতে নিশ্বাস নিলাম বুক ভরে। পাহাড়ি নির্জনতা আর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এ রকম পাহাড়চূড়ায় এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি হলে মন্দ হতো না। খুঁজে পেতে একটা ছোট্ট ক্যাফে পেলাম। সবাই মিলে চিজ পেস্ট্রি, আইসক্রিম, হট চকলেট আর কফি খেলাম। ক্যাফের বারিস্তা এক কিশোর। এতগুলো অর্ডার নিতে গিয়ে বেচারা একেবারে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। কেউ খাবে লাতে, কেউ ক্যাপাচিনো, কেউবা হট চকলেট। কেউ দুই চামচ চিনি, কেউবা এক চামচ আবার কেউ চিনি ছাড়া শুধুই ব্ল্যাক কফি। এতগুলো অর্ডার দেখে ছেলটির মা আর ছোট বোন এসে কাজে লেগে গেল। পরে কথায় কথায় জানলাম, হলিডেতে দুই ভাই–বোন মাকে ক্যাফেতে সাহায্য করে থাকে। এ সময় তাদের কাজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কিছু উপার্জনও হয়। এবার ফেরার পালা। আবারও ক্যাবল কারে ফিরে এলাম হ্যাপিভ্যালিতে।

এরপর রওনা হলাম স্নোডন মাউন্টেইন রেলের উদ্দেশে। ক্লগয়েন স্টেশনের বাইরের দোকান থেকে স্যান্ডউইচ, গরম গরম ফিশ অ্যান্ড চিপস, ওয়ালশ কেক আর কফি দিয়ে দুপুরের সংক্ষিপ্ত খাবার সেরে চড়ে বসলাম রেলগাড়িতে। আগেই বলে রাখি, রেলের টিকিট আগে থেকে অনলাইনে কেটে না রাখলে পাওয়া মুশকিল। আর আমাদের মতো বড়সড় দলের জন্য তো বটেই। আমাদের কিছু টিকিটসংকট থাকায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রথমে যাবে ছোট বাচ্চা আর মেয়েরা। পরেরবার যাবে বাকি বাচ্চারা, একজন যাবে তাদের অভিভাবক হিসেবে। তরুণ আর বড়রা গেল আরেক অ্যাডভেঞ্চারে।

বিসমিল্লাহ বলে চড়ে বসলাম স্নোডন মাউন্টেইন রেলে। ঝমঝম শব্দে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের রেলগাড়ির রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু হলো। একটু একটু করে ওপরে উঠছে আর পাল্টে যাচ্ছে রেললাইনের পাশের দৃশ্যপট। প্রথমে ঝরনা, পাহাড়ি প্রপাত আর আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারি। একটু পরই খাড়া উঁচু পাহাড়। স্নোডন মাউন্টেইন হলো ট্র্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। এটি যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড়চূড়া। স্নোডন মাউন্টেইন রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশ দিয়েই স্নোডন মাউন্টেইন সামিটে ওঠার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাস্তাটি রয়েছে। ট্রেনের যাত্রাপথে ক্ষণে ক্ষণেই দেখা মিলছে ট্র্যাকারদের।

পিঠে ব্যাকপ্যাক আর হাতে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে উঠছে নানান বয়সের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় নারী–পুরুষ। এ সময় আমাদের এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ভাই আর ভাবি তাঁদের বিবাহবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে হেঁটে স্নোডন মাউন্টেইন সামিটে ওঠেন। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা হেঁটে তাঁরা সোজা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছান।

পাহাড়ের গায়ে চোখে পড়েছে অনেক ভেড়া। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল, লম্বা লেজের ছাগল। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করতে বুঝলাম, এগুলো ছাগল নয়, ভেড়া। গ্রীষ্মকালে ভেড়ার লোম চেঁছে ফেলার কারণে হঠাৎ করে ছাগল ভেবে ভুল করেছিলাম। টুক করে আমাদের ট্রেন ঢুকে পড়ল মেঘের রাজ্যে। ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো চারদিক। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ড্রাইভার ঘোষণা দিয়ে ট্রেন থামিয়ে দিলেন। জানালার বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আস্ত মেঘ এসে আমাদের ঢেকে ফেলেছে। হাত বাড়িয়ে মেঘ ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই হাত ভিজে গেল। ঝোড়ো বাতাস এসে মেঘ উড়িয়ে নিতেই আবার রেলগাড়ি চলা শুরু করল। ধীরে ধীরে আমরা চূড়ায় চলে এলাম। এখানে আধঘণ্টা সময় দেওয়া হলো। তারপর আবার ট্রেন নিচে নেমে যাবে।

কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ, ট্রেন থেকে নামতেই ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। হুড়মুড় করে সবাই কামরার ভেতর আশ্রয় নিলাম। নির্ধারিত সময়ে আবার চলতে শুরু করল মাউন্টেইন ট্রেন। এবার নিচের দিকে। ফেরার পথে স্নোডন মাউন্টেইনের সৌন্দর্য কিছুটা উপভোগ করতে পারলাম। মেঘ–কুয়াশা কেটে গিয়ে চারদিক ঝকঝকে হয়ে গেল। বৃষ্টিস্নাত সবুজ পাহাড়চূড়ায় মেঘের আনাগোনা আর দূরের হ্রদে আলোর প্রতিফলন এককথায় অসাধারণ। মনে হচ্ছে, সবুজ পাহাড়ি গিরিখাতে বড়সড় একটা আয়না বসানো হয়েছে। সত্যি স্নোডন মাউন্টেইনে আসা সার্থক হয়েছে। মাঝপথে এসে আরেকটা ট্রেন অতিক্রম করলাম। ওটা ওপরে উঠছে।

পাহাড়, ঝরনা দেখতে দেখতে আমরা ফিরে এলাম ক্লগয়েন স্টেশনে। এবার সবাই মিলে লেকের পাশটা দেখতে গেলাম।

১৮৮১ সালে বন্ধ হয়ে কিছু যাওয়া কপারখনির চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে স্নোডনিয়ায়। বুনো গাছগাছালি আর আইভিলতার ভেতর থেকে উঁকি দেয় খনির ব্যবহৃত রেললাইন, চিমনি কল–কবজার কঙ্কাল। নিস্তব্ধতায় কান পাতলে বুঝি এখনো শোনা যাবে খনির শ্রমিকদের হইচই আর কর্মব্যস্ত কোলাহল। আমরা ঘুরতে ঘুরতে এমনই একটা খনি এলাকায় চলে আসি। পাশেই একটা বিশাল হ্রদ। শেষ বিকেলের হেলে পড়া সূর্য নীল আকাশে আবির ছড়াচ্ছে। থইথই পানির জলাধার দেখে আমার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের কথা খুব মনে পড়েছে। চাইলে এখানে বসে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যাবে। বড়সড় একটা পাথরের ওপর অনেকটা সময় চুপ করে বসে ছিলাম। বারবার আমাকে অতীতে নিয়ে যাচ্ছিল গাঢ় নীল পানিতে রুপালি আলোর ঝিলিক। এরই মধ্যে আমার ছেলে জাহিন অতি উৎসাহে জুতাসহ পানিতে নামায় বাস্তবে ফিরে আসতে বাধ্য হই। এরপর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আবার ফিরে আসি গ্র্যান্ড হোটেলে।

আমাদের সঙ্গের আরও দুটি পরিবার উঠেছিল গ্র্যান্ড হোটেল থেকে কিছুটা দূরে এক ক্যারাভান পার্কে। পরিবারসহ ছুটি কাটানোর জন্য যুক্তরাজ্যে ক্যারাভান পার্ক খুব জনপ্রিয়। বিশাল এলাকাজুড়ে এসব ক্যারাভান থাকে। ক্যারাভানের ভেতর ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাটের সব ধরনের আধুনিক সুযোগ–সুবিধা থাকে। এ ছাড়া পার্কের ভেতর রেস্টুরেন্ট, সুইমিং পুল, হলরুম ছাড়া থাকে বাচ্চাদের খেলার বন্দোবস্তও। রাতে এ রকমই একটা ক্যারাভান পার্কে গেলাম। আমরা চাইনিজ আর ইতালিয়ান খাবারদাবার নিয়ে গেলাম আর ওনারা আমাদের আপ্যায়ন করলেন খিচুড়ি আর ডিমভাজি দিয়ে।

মেঘ–পাহাড়ের রাজ্য স্নোডনিয়া ভ্রমণ
বৃষ্টিভেজা রাতে খানাপিনা যেমন জমল, তেমনি দারুণ একটা আড্ডাও হয়ে গেল। আর সব শেষে ছিল চা। ফেরার পথে এলাম সমুদ্রের পাশঘেঁষা রাস্তা দিয়ে। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির পাশে স্বপ্নিল আলোকমালায় সজ্জিত সমুদ্রতীর। হোটেলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে আবার শুরু হলো আড্ডা। দফায় দফায় চা, কফির সঙ্গে স্ন্যাকস। যাচ্ছি, যাব করে করে ভোরের আলো দেখা দেওয়ার পর সবাই যার যার রুমে গেলাম ঘুমাতে।

পরের দিন সকালে যথারীতি হোটেলের ব্রেকফাস্ট হলে সবাই একসঙ্গে নাশতা করে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা গেলাম পোর্টমেরিওন ভিলেজে। এখানে এসে মনে হলো, আমরা বুঝি ইতালির কোনো গ্রামে এসে পড়েছি। ইতালির গ্রামের আদলে স্যার ক্লাউ উইলিয়াম-এলিস ১৯২৫ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে এটি তৈরি করেছেন। ভিলেজে যাওয়ার পথে প্রথমেই আমাদের অভিবাদন জানায় দুই পাশের বাহারি রডোডেনড্রন। এরপর থেকে শুরু হয়েছে হাইড্রেঞ্জার সারি। সাদা, বেগুনি, নীল, আকাশি, হালকা গাঢ় নানান ধরনের গোলাপি হাইড্রেঞ্জার অসাধারণ রঙে রাঙানো স্বপ্নপুরীর পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে যেতে যেতে টিকিট কেটে যেন আরেক স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করলাম।

কিছুক্ষণ আগেই ঝমঝম বৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি থেকে নামতেই গায়ে পরশ বুলিয়ে দিল হালকা হিমেল হাওয়া। ভেজা পথ ধরে হেঁটে ভেতরে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঠিক শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো সাজানো একটা গ্রাম। প্যাস্তাল-ক্যান্ডি রঙে রাঙানো আঠারো শতকের ভূমধ্যসাগরীয় স্থাপত্যশৈলীতে সাজানো পুরো পোর্টমেরিওন। পিয়াজ্জা বা মূল প্লাজা যেটি, তা মূলত একটি নৈসর্গিক বাগান। বাচ্চারা দল বেঁধে ঢুকে গেল বনে। বাচ্চারা না থাকায় তাদের ছাড়াই আমরা যে যার মতো করে ছবি তুললাম। মনোমুগ্ধকর এই বাগানকে কেন্দ্র করে চারপাশে সাদা আর নীল রং করা স্থাপনা রয়েছে, যেখানে গেলে গ্রিসের দ্বীপ সান্তোরিনি বলে ভ্রম হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। বিস্তৃত বনভূমি, হোটেল, ঐতিহাসিক কটেজ, উপহারসামগ্রীর দোকান, স্পা আর কয়েকটি খাবারের দোকান রয়েছে। দুপুরে আমরা ইতালিয়ান খাবারের স্বাদ নিলাম।

উপহারসামগ্রীর দোকান সামনে পেলে যা হয় আর কী! সবাই মিলে দুহাত ভরে কিনলাম বিখ্যাত বোটানিক ডিজাইনের পোর্টমেরিওন সিরামিকের সামগ্রী। কফি আর আইসক্রিম খেয়ে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম।

ওয়েলসে এলে কখনো একটা জিনিস বাদ দেবেন না। সেটা হলো ঐতিহ্যবাহী ক্রিম–টি। এটা শুধু বিকেলের চা–নাশতাই নয়, ক্ল্যাসিক ক্রিম–টি হলো ওয়েলসের ঐতিহ্য। মূলত ক্রিম–টি ডেভনশায়ার ক্রিম–টি এবং করনিশ ক্রিম–টি নামে বেশি পরিচিত। যা কিনা পরিবেশন করা হয় স্কোন, ক্রিম, জ্যাম আর বাটারসহযোগে। স্নোডনিয়া ক্রিম–টি আস্বাদনের জন্য আদর্শ জায়গা।

মেঘ–পাহাড়ের রাজ্য স্নোডনিয়া ভ্রমণ

স্নোডনিয়া নামটি এসেছে স্নোডন পাহাড়ের নামানুসারে। ৩৫৬০ ফুট উচ্চতার স্নোডন ওয়েলসের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। স্থানীয় ওয়েলস নাম এইরি। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি স্নোডনিয়া ন্যাশনাল পার্কটি বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গঠিত। এতে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পার্বত্য এলাকা। রয়েছে ঝরনা ও জলাভূমি। ন্যাশনাল পার্কের সীমানার ভেতর কৃষিকাজেরও অনুমতি রয়েছে। তাই মাঝেমধ্যেই ভেড়ার পাল চোখে পড়ে। স্নোডনিয়া হলো বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল এবং বিশেষ কিছু উদ্ভিদের স্বর্গরাজ্য। বিরল প্রজাতির পেরগ্রিন ফ্যালকন ও বুনো কোটোন্যাসটার শুধু গ্রেট অরমেই পাওয়া যায়। যাঁরা গাড়ি চালাতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য স্নোডনিয়া ন্যাশনাল পার্ক এককথায় আদর্শ।

রোমাঞ্চকর পাহাড়ি আঁকাবাঁকা মসৃণ পথে হঠাৎ করেই মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এমনকি কাজ করছিল না গাড়ির জিপিএসও। একই পোস্টকোড অনুসরণ করলেও, একেক গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে। তবে এটা কোনো ভুতুড়ে কাণ্ড নয়। দুই পাশে উঁচু পাহাড় থাকায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করেনি। আর পুরো স্নোডনিয়া ন্যাশনাল পার্কের একই পোস্ট কোড। আমরা সামনের গাড়ি অনুসরণ করে এগোতে থাকলাম। পুরো স্বপ্ন উপত্যকার ভেতর দিয়ে মসৃণ পিচঢালা পথ। কোথাও আবার সর্পিল আঁকাবাঁকা, কিন্তু একবারের জন্যও কোনো ঝাঁকুনি লাগেনি। মাইলের পর মাইল ডানে–বামে যেদিকে চোখ যায়, শুধু সবুজের সমারোহ। সারা দিনে বেশ কয়েকবারই বৃষ্টি হয়েছে। তাই আরও উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে দুপাশের গাঢ় সবুজ। চলতি পথে হঠাৎ চোখে পড়ল বিশাল রংধনু। বেশ কিছু ট্রেকার চোখে পড়ল। তাঁরা হেঁটে হেঁটে ন্যাশনাল পার্ক দেখছেন।

লন্ডনে প্রতি সপ্তাহেই সবার সঙ্গে দেখা–আড্ডা হওয়ার পরও এবার হলিডেতে গিয়ে কী করে যেন সবার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। করোনাকালে দীর্ঘ বিধিনিষেধের দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির পর যা ছিল সবার জন্য বাড়তি পাওয়া। বিশালায়তন স্নোডনিয়ার খুব সামান্য অংশবিশেষ ঘুরে দেখেছি। স্নোডনিয়ায় এলে আগে থেকে পরিকল্পনা করে হাতে একটু সময় নিয়ে আসাটাই ভালো। এটা উল্লেখ না করলেই নয়, আমাদের এক করিতকর্মা ভাই রাত জেগে দর্শনীয় স্থানগুলোর টিকিট করেছেন বলে আমরা অল্প সময়ে অনেক কিছু দেখতে পেরেছি। তারপরও স্নোডনিয়া থেকে ফিরে এসেছি একটা বিশাল অতৃপ্তি নিয়ে। মনে হয়েছে, এ বিশাল রত্নভান্ডারের সিকিভাগও দেখা হলো না। কত কিছুই না অজানা থেকে গেল। তাই, আবার হারিয়ে যেতে চাই প্রাকৃতিক স্বর্গরাজ্য স্নোডনিয়া ন্যাশনাল পার্কের ভুল পোস্টকোডে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com