নিস, ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি শহর। ফ্রেঞ্চ রিভেয়েরার প্রভিন্স-আল্পেস-কোট ডি’আজুর অঞ্চল এবং ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে শহরটি। শহরটির পাশেই ইতালির তুরিন এবং স্পেনের বার্সেলোনা। নিস থেকে এক দিনেই তিনটি দেশ এবং দেশের বেশ কয়েকটি শহর ঘোরাফেরার এক চমৎকার সুযোগ রয়েছে। আমার ২০২৩ সালের বিশ্ব ভ্রমণের শুরুতে রয়েছে ক্যানেরি আইল্যান্ড, স্পেন, লন্ডন, জার্মান, তুরস্ক। সবে ফ্রান্সের নিস ঘুরে এলাম। বাকি রইল কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মায়ামি এবং স্পেন, যা সত্বর শেষ করব বলে আশা করছি। যেতে যেতে পথে লিখেছি অতীতের ভ্রমণের ওপর।
এবারের ভ্রমণ কিছুটা ভিন্ন অন্যবারের তুলনায়। আমাদের মেয়ে জেসিকা জেনেছে আমি আর মারিয়া (জেসিকার মা) নিসে যাব ছুটিতে। জেসিকা বলল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই। আমরা একটু অবাক হলেও বললাম ঠিক আছে যাবে। জেসিকা এআর বিএনবি ভাড়া করেছে (এটি একটি অভিনব হোটেল ব্যবস্থা, যেখানে বাণিজ্যিক হোটেলগুলোর তুলনায় স্বল্পমূল্যে অতিথিরা থাকতে পারেন। এ এয়ার বিএনবির মালিক যে কেউই হতে পারে নিজস্ব একটা বাড়ি থাকলে। অথবা এয়ার বিএনবির জন্য অনুমতিসহকারে বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে কেউই এই ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে।
অনেকটা উবার ব্যবসার মতো। অর্থাৎ একটা গাড়ি থাকলে যেমন উবার ব্যবসা করা যায়, একটা বাড়ি থাকলে তেমনি যে কেউই এয়ার বিএনবি ব্যবসা করতে পারেন)। নিস শহরের মাঝখানে ফ্রেন্স পরিবারের একটি বিলাসবহুল বাসা (দুটি বেডরুম, কিচেন, বাথরুমসহ রান্নার সুযোগ আছে)। ভাবলাম ভালোই হবে পর্যটকদের খাবার না খেয়ে এখানেই মাঝেমধ্যে রান্না করা যাবে। আমার ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। মেয়ে বলল, এখানে এসেছ ছুটিতে, রান্নাবান্নার চিন্তা মাথা থেকে দূর করো। সারা দিন একসঙ্গে ঘুরব, সাগরে গোসল করব, খিদে লাগলে বাইরে খেয়ে নেব, বুঝেছ? আমার কিছু বলার আগেই মেয়ের মা বললেন ঠিক আছে তুমি যেটা বলবে, সেটাই হবে।
আমাদের মেয়ে ১৬ বছর অবধি এলিট স্পোর্টসে সময় দিয়েছে। সারা বিশ্বে টেনিস ট্যুরে অংশগ্রহণ করেছে। বিশ্বের কোথায় কীভাবে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হয়, সেটা সে জানে। শুধু সুইডেন নয়, বিশ্বের সেরাদের তালিকায় থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ টেনিস ছেড়ে ঝটপট করে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই ফাইন্যান্সে চাকরি করছে দুই বছর ধরে। ভাবতে পারিনি যে এ বয়সে সে মা–বাবার সঙ্গে ভ্রমণে যাবে, স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা হিসেবে আমরা বিষয়টি আনন্দের সঙ্গে নিয়েছি। জেসিকা আমাদের ভ্রমণ প্রদর্শক হিসেবে নিস ভ্রমণ পরিচালনা করছে। কোথায় যেতে হবে, কী খেতে হবে—সব বিষয়ে গুরুদায়িত্ব পালন করলেও আমরা কী পছন্দ করি, সে বিষয়গুলোর দিকেও খেয়াল রাখছে সারাক্ষণ। মনে হচ্ছে মেয়ে আমাদের দায়ভার নিতে প্রস্তুত।
যাহোক, গ্রিক জাতি আনুমানিক ৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নিস শহরটি প্রতিষ্ঠা করে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা শহরটি দখল করে নেয় এবং এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। দশম শতকে প্রোভঁস, পরে ১৩৩৮ সালেই শহরটি সাভোয়াত কাউন্টদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ১৮৬০ সালে শহরটিকে ফ্রান্সের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। দৃষ্টিনন্দন পর্বতবেষ্টিত নিস শহরের জলবায়ু আরামদায়ক। এটি ফরাসি রিভিয়েরা অঞ্চলের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রায় চার লাখ অধিবাসী বাস করে।
নিস শহরের সামনে বয়ে চলেছে ভূমধ্যসাগর। সারা দিন হাঁটলেও পথ শেষ হবে না। অতীতে হাজারো অসুস্থ মানুষ নিস সমুদ্রসৈকতের পাড় দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছে এখনো ব্যস্ত জীবনের স্বস্তি ফেরাতে মূলত বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এখানে আসে। ভূমধ্যসাগরের লবণাক্ত পানিতে লবণের পরিমাণ এত বেশি যে সারা দিন ভেসে থাকা অসম্ভব কিছু নয়।
যাহোক, যে জায়গাগুলো ভ্রমণ করেছি, তার মধ্যে ছিল কান (Cannes)।
কান নিস থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয়, ট্রেনে করে গেলাম সেখানে মূলত সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে। কান সমুদ্রসৈকতের বালু সাদা ঝকঝকে, তারপর বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক আকর্ষণ। প্রতিবছর এখানে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে থাকে। এবার ৭৬তম আসরের সমাপনী অনুষ্ঠান হয় গত ২৭ মে। বিভিন্ন দেশের মানুষ ও জীবনযাপনের সংস্কৃতি উপস্থাপনের একটি উপলক্ষ হলো কান চলচ্চিত্র উৎসব। এটা অনেকটা ঠিক ফুটবল বিশ্বকাপ ও টেনিস গ্র্যান্ড স্লামের মতো।
আমার পরিবারের সবাই বিশ্বভ্রমণ করে নানা কারণে। ছেলেমেয়ে টেনিসের সুবাদে, আমি এবং মারিয়া কাজের সুবাদে, সে ক্ষেত্রে আমরা সবাই চেষ্টা করি ট্যুরিস্টের পাশাপাশি এক্সপ্লোরিষ্ট হতে।
ভ্রমণের তৃতীয় দিনে বেরিয়ে পড়লাম নিসের অদূরে একটি চমৎকার গ্রামে। ইজে (Eze) গ্রাম হলো ফ্রান্সের কোট ডি’আজুরের একটি মনোমুগ্ধকর গ্রাম, যেখানে রয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর বাগান। এর অনন্য অবস্থান এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে, ইজে গ্রাম প্রত্যেকের জন্য কিছু অফার করে—বহিরাঙ্গন কার্যকলাপ এবং কেনাকাটার সুযোগ থেকে শুরু করে বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে যুক্ত প্রাচীন ল্যান্ডমার্কগুলো অন্বেষণ করা।
আমরা যা–ই খুঁজি না কেন, ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত এ মায়াবী মধ্যযুগীয় গ্রামে তার সবকিছুই কমবেশি এখানে আছে! গ্রামটির রাস্তায় হাঁটার সময়, সব স্থাপত্য এবং শিল্প খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ভুল হয়নি। এখানে কিছু ঐতিহ্যবাহী ফ্রেঞ্চ বিল্ডিং রয়েছে, যার প্রতিটিতে একটি সুন্দর অভ্যন্তরীণ নকশা রয়েছে, যা অবাক করে দিয়েছে আমাদের। ইজের দর্শন অবশ্যই পর্যটকদের অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত করে চলছে।
ইজে গ্রাম পরিদর্শন করার সময় আমি কী ধরনের বাগানের অভিজ্ঞতা চাই, সেটা অর্জন করতে পেরেছি।
ইজে ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত একটি মনোরম গ্রাম, যেখানে শতাব্দীর ইতিহাস, ভূমধ্যসাগরের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য এবং অন্বেষণের জন্য যথেষ্ট। ইজে গ্রাম সত্যিই সব ধরনের ভ্রমণকারীদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় গন্তব্য।
আপনি বিশ্রাম বা দুঃসাহসিক কাজ খুঁজছেন? আপনি এই গ্রামে সেটা পাবেন! তাই আর অপেক্ষা করবেন না, আসুন এবং নিজের জন্য ইজের সৌন্দর্য উপভোগ করুন। আমি অবাক হয়েছি দেখে কীভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২৯ মিটার ওপরে এত চমৎকার করে এত সুন্দর একটি গ্রাম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে শত শত বছর আগে, শুধু জলদস্যুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। নিস থেকে মোনাকোর দূরত্ব খুব কাছে হলেও মোনাকো নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি স্টেট।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং একটি স্বাধীন স্টেট। কারণ, মোনাকো স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৯৯৩ সালের ২৮ মে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
এটি পশ্চিম ইউরোপের একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ দেশ। সাংবিধানিক নাম প্রিন্সিপালিটি অব মোনাকো। দাপ্তরিক ভাষা ফ্রেঞ্চ। এর তিন দিকে ফ্রান্স আর অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর। ইতালির খুব কাছাকাছি। মুদ্রা ইউরো। গড় আয়ু প্রায় ৮৯ বছরের বেশি। মোনাকোতে বিশ্বের সব দেশের মানুষ বসবাস করে। রাজধানী মন্টে কার্লো, যা মূলত ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত।
প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন, প্রাইভেট ও সরকারি ব্যাংকিং খাত (ফরেন কোম্পানি রিজার্ভ)। মোনাকোতে বিশ্বের অনেক নামীদামি আন্তর্জাতিক ব্যাংক রয়েছে, যারা তাদের গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষা করে। এখানে প্রতিবছর প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন পর্যটক আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর বসে মন্টে কার্লোতে।
মোনাকো কখনো তাদের আধিবাসীদের ওপর ট্যাক্স আরোপ করে না। মোনাকো একটি দেশ, যেখানে কোনো কৃষি বা গ্রাম নেই। দেশটির পুরো অংশই শহর। মোনাকো একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র।
আপনি খুব সহজেই তিন মাস থাকতে পারবেন। কিন্তু তিন মাসের বেশি থাকতে হলে অবশ্যই আপনাকে দীর্ঘমেয়াদি ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। তবে ইউরোপের অনেক দেশের মানুষ লং টার্ম ভিসা নিয়ে এখানে বসবাস করেন। আর যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি ভিসার জন্য আবেদন করে থাকেন, তাঁদের রেসিডেন্স কার্ড প্রদান করা হয়। আর এভাবে প্রথমে ১ বছর এবং পরে ৩ বছর ও পরিশেষে ১০ বছরের রেসিডেন্স কার্ড প্রদান করা হয়, যা নবায়নযোগ্য।
যেহেতু মোনাকো ফ্রান্সের অভিভাবকত্বকে মেনে চলে, তাই ফ্রান্স এম্বাসিতে ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। নিস ভ্রমণে শুধু গোসল নয়, ঘুরেছি এবং এক্সপ্লোর করেছি, সঙ্গে সবাই একসঙ্গে একটি সুন্দর সময় পরস্পর পরস্পরকে দিতে পেরেছি। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে বলে আমি মনে করি। আপনিও আপনার পরিবারকে নিয়ে বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, সে বিষয়ে জানুন এবং অন্যকে জানার সুযোগ করে দিন তেমনটি আশা করি। তবে হ্যাঁ, ভ্রমণে যেমন রয়েছে আনন্দ, ঠিক তেমনি রয়েছে বিষাদ। আমার লেখায় নিঃসন্দেহে ফুটে উঠেছে আনন্দ, তবে একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে বেশ! বিষয়টি হলো ফ্রেন্স জাতিরও সমস্যা রয়েছে নানা বিষয়ে, তবে এদের যে মুখ্য খাবার যেমন ফ্রেন্স বাগেট বা রুটি, এ খাবারটির দাম ঠিক বলতে গেলে ৩০ বছর আগের মতোই রয়ে গেছে, যেখানে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া অথচ রুটির দামের খুব একটা মূল্য বাড়েনি। কারণ কী জানেন? এরা জনগণের পেটে আঘাত করে না। সুইডেনেও একই ঘটনা লক্ষ করি। দুধের দাম কখনো বাড়াবে না, যত সমস্যাই হোক না কেন। আমরা বাংলাদেশিরা তো ভাতে–মাছে বাঙালি কিন্তু ভাত এবং মাছ—এ দুটি খাবারের দাম কি স্থিতিশীলতার মধ্যে থাকে বা আছে? এ সহজ জিনিসটা যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা সম্ভব, তাহলে কী হবে জনগণের—বিষয়টি কি আমরা কখনো ভাবি!