উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রত্যেকটি রাজ্য- ই অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। উজাড় করা অপার্থিব রূপ।এই রূপের হাতছানি অস্বীকার করা যায় না। পরতে পরতে ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের ছোঁয়া। আলাদা আলাদা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবলে আমাকে দ্যাখ,ওবলে আমাকে দ্যাখ। ছোটবয়সে এই পাহাড়ি কন্যার সঙ্গে পরিচয় হয় শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদারে ‘ আর কোন খানে’ নামক একটি বইয়ের মাধ্যমে,। তখন আমার বয়স ১২, একটা স্বপ্নময়তার জগৎ উন্মোচিত হয়েছিল,তারপর কলেজের অর্নাসের পাঠ্য বিষয় রবীন্দ্রনাথের ‘ শেষের কবিতার’ র মাধ্যমে খুব সহজেই শিলং সম্পর্কে ভালো লাগা জন্মালো। দীর্ঘ কর্মজীবনে কাজের ব্যস্ততার কারণে ভুলে যেতে বসেছিলাম অপরূপা সুন্দরী শিলং কে। কৈশোর ও যৌবনে মেঘ ও ফুলের দেশে যাওয়ার একটা স্বপ্ন দেখতাম। মাঝে মাঝে আমাকে তাড়িত করতো।
বহুদিনের অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার একটা সুযোগ পেলাম। আমার কর্মজীবনের প্রথম দিকের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অন্যতম ছিল ডাঃ সৌমিক সেনগুপ্ত।ওর একটি ফোন পেলাম, ফোনে জানাল বর্তমানে এম,ডি করে গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে আছে, পরে শুনলাম স্হায়ীভাবে আসামে বসবাস করছে।এই দুর্লভ সুযোগ পেয়ে ২০১৬ সালের এক শীতের সকালে কোলকাতা বিমান বন্দর থেকে আকাশ পথে পাড়ি দিলাম গৌহাটিতে,সময় লাগলো ২ঘন্টার মতোই,সফর সঙ্গী বসিরহাটের সায়ন্তন কুমার ও বিরাটির বোম্বা। সময়টা অক্টোবরের শেষ দিকে, আসামে নেমে কোন ঠাণ্ডার আমেজ পেলাম না। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সৌমিকের বাড়িতে চলে গেলাম। অসাধারণ আপ্যায়নে আপ্যায়িত হলাম। দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম এবং শিলং-এর জন্য একটি শেয়ারিং টাটাসুমু গাড়িতে উঠে পড়লাম তিন জন।
গুয়াহাটি থেকে আঁকাবাঁকা স্বপ্নের পাহাড়ি পথ ধরে চলেছি শিলং -এর অভিমুখে আমরা তিনমূর্তি। দু’পাশে পাইন-ফারের অপরূপ যুগলবন্দী।মন কেড়ে নেওয়া মাতাল রূপ। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ইতস্তত বাসা বেঁধেছে ভবঘুরে মেঘের দল। কখনো বা দূর থেকে ভেসে আসছে সুরেলা কন্ঠের গানের কলি। রঙবেরঙের পোষাক পরে ব্যস্ত পায়ে ছন্দবদ্ধভাবে হেঁটে চলেছে পাহাড়ি কন্যারা। মেঘালয়ে আজও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বহমান। পরিবারের সমস্ত কিছুই সামলাতে সিদ্ধহস্ত এখানকার নারীসমাজ। এ-এক অন্যভুবন। মেয়েরা মেঘালয়ের অন্দরমহল’ ও বহির্মহলের প্রধান স্হপতি।
গুয়াহাটি থেকে দূরত্ব মাত্র ১০৩ কিমি। রাস্তা একেবারে মসৃন। গাড়ি চলছে বিভিন্ন ধরনের জনপদের হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে। দুপুর পেরিয়ে জোড়াবাটে পৌঁছলাম। মূল রাস্তা এখানে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। একদিকে আপার অসম আর একদিকে শিলং। জোড়াবাট শেষ, আমরা মেঘালয়ে পা রাখলাম। এই সময়ে হৃদয়জুড়ে কবিগুরুর আবির্ভাব ঘটল। ৩৪ বছর আগে সিলেবাসে ছিল রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কাব্যধর্মী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। বহুবার পড়লেও আশ মিটতো না।মন অন্য জগতে চলে যেত -ই। সুযোগ পেয়ে আজ চর্মচক্ষু দিয়ে উপভোগ করতে এসেছি। এ যেন মেঘ-পিওনের দেশে এলাম।মনে পড়ল সেই বহুচর্চিত পংত্তি। যা কোনদিনও পুরানো হয় না।
“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/ আমরা দু’জন চলতি হাওয়ার পন্হী”—- ‘শেষের কবিতা’, যার শুরু থেকেই সমাপ্তিজুড়ে শিলংয়ের মায়ামাখানো পথ, পাহাড়, রঙবেরঙের পাহাড়ি ফুল,,ঝরনা, নিসর্গ,মেঘদূতের কল্পলোকের অলকাপুরী।এই স্বপ্নিল উপত্যকাকে এবার বাস্তবে ছুঁয়ে দেখবো বলেই এগিয়ে চলেছি।এ-এক স্বপ্নের সফর।
ড্রাইভারের সঙ্গে পরিচয় হলো ও ঘনিষ্ট হলাম অল্প সময়ের মধ্যেই। দেড় ঘন্টায় পৌঁছলাম নংপোতে। একটি অসাধারণ পাহাড়ি জনপদ।একটু বিরতি। আমরা তৃপ্তি সহকারে সুগন্ধি যুক্ত চা পান করলাম আর কিছু ফল খেলাম। আনারসের স্বাদ অতুলনীয় লাগলো। আবার পথ চলা শুরু। কিছুক্ষন সোজা রাস্তায় চললাম, তার পর শুরু হলো কিছু বাঁকের লুকোচুরি। উপভোগ করছিলাম তিন মূর্তি।কখনো বা দিকে বাঁক নিচ্ছে তো কিছুক্ষণ পর ডানদিকে। বাঁকের আড়াল থেকে কলকল করে উঠল পাহাড়ি একঝলমল মিষ্টি ঝরনা, শুধু মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে দেহ-মনে। পাহাড়ি দুহিতারা সেখানে মনের আনন্দে স্নান সারছে। একটুখানি দূরে এগিয়ে গাড়ি পৌঁছোল বড়াপানিতে। এখানকার রোমাঞ্চকর অনুভূতি ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। শুধু অনুভবের যোগ্য। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যেন নিজের বিশালাকৃতির দেহকে লুকিয়ে রেখেছে মনোমুগ্ধকর এক সবুজ লেক। মাদকতা ভরা কাব্যিক নাম –,’ উরিয়ম’ । লেকের তীরজুড়ে অর্কিড লেক রিসোর্ট।
মেঘালয় সরকারের পরিচালিত হোটেল। সাজানো গোছানো পার্ক সহ বিশাল ফুলের বাগান। অলস দুপুরে রং মূহুর্তে বদলে যাচ্ছে উরিয়ম লেকের জলে। বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে পড়লাম।এটা কি করে সম্ভব? ব্যখ্যা খোঁজার একটা নিষ্ফল চেষ্টা করলাম মাত্র। পাহাড়ি প্রকৃতি রঙমেলান্তী খেলায় মেতে উঠেছে। লেকের নির্মল জলরাশিকে চারিদিকের সবুজ গাছগাছালি গুলো নুয়ে আলিঙ্গনরত।এ -যেন সবুজের জংলী প্রেম। মাথা নত করে আলাপচারিতায় মশগুল সবুজ পাহাড়ের দল। লেকের নির্মল জলের কলতান আর বুক জুড়ে রয়েছে ওয়াটার স্পোর্টস-এর সুন্দর ব্যবস্হা। পাশেই নেহেরু পার্ক। নরম সবুজের সমারোহ লন জুড়ে, মনকাড়া মনোরম দৃশ্য।ভোলা যাবে না। পার্ক আলো করে রঙিন বিচিত্র ফুল আর দুষ্প্রাপ্য অর্কিড। এক লহমায় দেখেই চলে আসতে বাধ্য হলাম। বারবার ড্রাইভার ভাই তাড়া দিচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, ফেরার পথে একবার নয়নভরে দেখার চেষ্টা করবো।আসলে দেখে আশ মিটল না।একটা অতৃপ্তি খচখচ করতে লাগলো। গাড়ি চলছে একেবারে পঙ্খীরাজের মতো। মেঘালয়ের অন্দরমহল’ও জন্মবৃত্তান্ত বড় সুন্দর।
১৯৭২ সালের ২১ শে জানুয়ারি অসম থেকে বিভাজিত হয়ে ৫টি জেলা নিয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য মেঘালয়ের আত্মপ্রকাশ। একটু বাদে পৌঁছলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রের কাছাকাছি। সবাই জানি মেঘালয় ফুল আর বর্ণিল মনোমুগ্ধকর মেঘের দেশ। তিনটি মনকাড়া পাহাড়। খাসি,জয়ন্তিয়া আর গারো। বাংলাদেশের সিলেট জেলা একদিকে বিরাজমান। সূর্য দেব এখনো পশ্চিমে ঢলে পড়েনি,সময় নষ্ট না করে যাত্রা করলাম খাসি পাহাড়ের দিকে।উপরে ওঠার পর মনেহলো এ–কোন জগতে আমরা সবাই!! আসলে সবুজ-নীল পাহাড়ের দেশে শিলং কে এইভাবে কখনও দেখিনি,ও ভাবেই নি। ফিরে এলাম পুলিশ বাজারে,বহু হোটেলের সমাবেশে ব্যস্ত জায়গা। আগেই কোলকাতা থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে থাকার সব ব্যবস্হা করে রেখেছিলাম। থাকার সমস্যা মুক্ত আমরা।
শিলং -এর সব চেয়ে মনোমুগ্ধকর জায়গা হলো পোলোগ্রাউণ্ড এলাকায় ওকল্যাণ্ড রোডে হোটেল পোলো টাওয়ারস। নানান ধরণের বাহারি ক্যাকটাস, রঙীন পাতাবাহার আর নুড়িপাথর দিয়ে সাজানো গোছানো সুন্দর স্হান। দাঁড়িয়ে দেখছি মেঘেরা খেলায় মেতে উঠেছে। মেঘেরা বারেবারেই ছুঁয়ে দিচ্ছে পাইন গাছের মাথা, ঝরনা গুলো যেন নব যৌবনের মাধুর্যে বড় উচ্ছল উদ্দাম আর বেপরোয়া। ঘন পাইন–দেবদারুর ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছবির মতো সাজানো সব রঙবেরঙের বাড়ি।। ওখানকার এক জন বাঙালী ভদ্রলোক বললেন,শীতে বরফ পড়ে না, বসন্তের আমেজে ভরা থাকে শিলং।গমরকাল বড় আদরনীয়।এই সময় না শীতের,না গরমের দাপাদাপি। অত্যন্ত আরামদায়ক আবহাওয়া থাকে মেঘালয়ে। তাই এক সময়ে ইংরেজ সাহেবদের কাছে বড় প্রিয় ছিল এই শহর, সেই সঙ্গে কবিগুরুর অত্যন্ত ভালোবাসার শহর ছিল শিলং। রবীন্দ্রনাথের বহু স্মৃতি বিজড়িত এই মনোরম শৈল শহর। মনে পড়লো, ‘শেষের কবিতা’র অমিত-লাবণ্যেরও স্বপ্নের শহর। গেলাম রবীন্দ্রনাথের বসতবাড়ি রিবং-এর পাইনে ছাওয়া মালঞ্চ-এ। কোন্ পাইন-দেবদারুর ছায়ায়, কোন্ লাল কাঠের বাড়ির নীল উঠোনে দাঁড়িয়ে অমিত-লাবণ্য তাদের ভালোবাসার আদুরে স্বপ্নের মেঘকে ভেসে যেতে দেখেছিল দূর থেকে দূরে, ধরে রাখতে চেয়েছিল তাদের স্বপ্নকে অসীম আকাশের সীমানায়, কে জানে!
আর বিশেষ ঘোরা হলনা। সন্ধ্যায় শিলং-এর রাস্তা বড়ো নির্জন হয়ে যায়। তবু গেলাম সার্কিট হাউসে। শুনলাম, ডা বিধান চন্দ্র রায় ছুটি কাটাতে আসতেন এই বাড়িতেই। খাসি কিশোরীরা মাথায় ফুল গুঁজে বিচিত্র পসারা সাজিয়ে ফল,ফুল,ইডলি আর শুকরের মাংস বিক্রি করছে। মেঘালয়ের নারী সমাজের অন্দরমহলের এক বর্ণময় ছবি। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে পা বাড়ালাম রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্টহাউস -এর দিকে। ঘরে ঢুকে দেখি পশ্চিমের দেওয়ালজোড়া সার্সির পিছনে আগুনরাঙা চাঁদ উঠেছে তখন। পাহাড়ে জোনাকির মতো আলো জ্বলে উঠেছে। ফ্রেস হয়ে নিলাম, তারপর নীচে নেমে মিশনের মন্দিরের সন্ধ্যা আরতিতে যোগ দিলাম।মন পবিত্রতায় ভরে উঠলো মুহুর্তেই। এরপর আলোঝলমল রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। চেখে দেখলাম স্হানীয় খাবারও। রাত বাড়ছে,সঙ্গে ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে বসেছে। গেস্টহাউসে যখন পৌঁছলাম তখন রীতিমত আমরা সবাই কাঁপছি। রাতের বেলা খাওয়া পর্ব সংক্ষেপে সারলাম। যে যার ঘরের ব্যালকনি থেকে রাতের অপরূপ শিলং-এর রূপ মুগ্ধনয়নে অবলোকন করলাম, কিছু পরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, নতুন ভোরের প্রতীক্ষায় নিয়ে।
পরেরদিন রোদঝলমল একটা মিষ্টি সকালের মুখোমুখি হলাম সবাই। ঘড়ি জানান দিচ্ছে সকাল সাড়ে ৫টা। আসলে পূবের দেশে সূর্যিঠাকুর ওঠেন তাড়াতাড়ি।চটপট তৈরি হয়ে রওনা হলাম ‘ অমিত-লাবণ্যে’ র শিলং দেখতে। শিলং -এর আসল সৌন্দর্যই হলো এর অপূর্ব নির্মল প্রকৃতি ও সবুজ ল্যাণ্ডস্কেপ। সুন্দর মসৃণ রাস্তার দুপাশে আকাশছুঁয়ে থাকা পাইন আর সরল গাছের সারি। যা আলো-আঁধারি তৈরি করে চলেছে আপন খেয়ালেই।’forget me not’ এর থোকা-থোকা বাহারী ফুল এখানে -সেখানে মেলা বসিয়েছে। মেঘের দেশে যখন তখন বৃষ্টি নামে। আবার কখনও মেঘের দল ধীরে ধীরে নেমে এসে ঢেকে দেয় শিলং শহরকে। এ-এক অন্যভুবন । আকাশ ছোঁয়া রডোডেনড্রন,পাইন বনের মাঝে মাঝে ছবির মতো সুন্দর স্কুলবাড়ি, চার্চ, হোস্টেল, খেলার গ্রাউন্ড আর অনিন্দ্যসুন্দর ভিউপয়েন্ট।
আমাদের ভাড়া করা গাড়ি এসে থামলো ‘ডন বসকো ‘–র ক্যাথিড্রাল ক্যাথলিক চার্চের সামনে। সাজানো গোছানো সুন্দর স্হান। শুধুই ফুলের আর অর্কিডের মেলা, মুগ্ধ হলাম সবাই।মা মেরির সামনে সুসজ্জিত ফুল আর মোমবাতির আলোয় সাজানো প্রেয়ার গৃহের হল ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হলো না। তবু গাড়িতেই উঠে ঠিক করলাম এবার ওয়ার্ডস লেকটা সুন্দর করে ঘুরে দেখবো। তারপর দুপুরের খাওয়া পর্ব সেরে আমরা যাব অনিন্দ্যসুন্দর ডন বসকো মিউজিয়ামে।
গাড়ির ড্রাইভার লক্ষণ জি বললেন,লেকে পৌঁছনোর রাস্তাটা অসাধারণ, অনেকটা ঢালু, আঁকাবাঁকা, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছায়াপথ। হেঁটে গেলেই খুব ভালো লাগবে।নেমে পড়লাম। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে লেকে অবশেষে পৌঁছলাম। অনেকখানি জায়গা জুড়ে এই অশ্বাক্ষুরাকৃতি লেক এবং বাগান। লেকের উপর কাঠের তৈরি নয়নাভিরাম ব্রিজ। বোটিং করলাম।
গার্ডেন কাফেতে চিকেন মোমো খেয়ে গার্ডেন কাম ফরেস্টে একটুখানি হাটতে গেলাম। ওয়ার্ডস লেকের পাইন বনের সৌন্দর্য বহুদিন স্মৃতির মণিকোঠায় চিরজাগরূপ হয়ে থাকবে। অনুভব করলাম ,ফুল আর মেঘের শহর শিলংয়ের মায়ামাখানো স্নিগ্ধ সৌন্দর্য গাড়িতে চড়ে উপভোগ করার নয়। হাঁটতেই হবে। শুরু করলাম হাঁটা।চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ঘন পাইনের জঙ্গলে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম। শুধুই মুগ্ধতা।এরপর আমাদের গন্তব্যস্হল ডন বসকো মিউজিয়াম। সাততলা ভবন,দেখতে সময় লাগলো ২ঘন্টার বেশি।মন ভরে গেল।
মূলত উত্তর–পূর্ব ভারতের শিল্প-সংস্কৃতি,আচার আয়োজন, জনজীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে এখানকার মিউজিয়াম। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলাম মিউজিয়ামের ছাদে। পুরো ছাদটা গ্রিল দিয়ে ঘিরে ঢেকে একটা সরকারি – ওয়াক বানানো হয়েছে। নান্দনিক সৌন্দর্যের অপার বিস্ময়। পুরো শহরটাকে এক লহমায় দেখা যায়। দূরে শিলং পিকের উপর মেঘের ছায়া নেমেছে।কাছেই শিল্পসামগ্রীর একটি বিপনণ কেন্দ্র। কিছু শিল্পসামগ্রী কিনলাম। ফেরার পথে আলোঝলমলে পুলিশ বাজারে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলাম শিলং-এর সাহেবি ক্লাবে। খুব সুন্দর,পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। আর কিছুক্ষন নির্জন প্রকৃতি র সাথে কাটিয়ে দ্বিতীয় দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে গেস্টহাউসে পৌঁছলাম। ঘড়িতে রাত পোনে দশটা। রাতের খাবার পর্ব সারলাম। তৃতীয় দিনের ঘোরার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে করতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম।
সকাল হলো। আলোঝলমল সুন্দর পরিবেশ, কিছু বাদে শুরু হলো বৃষ্টি। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়েগেল। আসলে শিলং-এর প্রকৃতি যেন খামখেয়ালী। নিজের শর্তে চলে। ফলে একটু অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টি আর মেঘের খেলা দেখতে দেখতে আমরা শহর ছাড়িয়ে চলেছি ডাউকির স্বপ্নময় স্বর্গরাজ্যের দিকে। মনে হলো সবমেঘ নেমে এসেছে যাত্রাপথে।এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি ও স্বপ্নের সফরে আমরা পঞ্চপান্ডব চলেছি। রডোডেনড্র ট্রেকের একটু পরেই স্বল্প বিরতি, সামনে এলিফ্যান্ট ফলস। এখানে একটা দূরন্ত চঞ্চলা ঝর্না ধাপে ধাপে নীচে নেমে একটা লেক বানিয়েছে। সিঁড়ি ধরে সাবধানে নামলাম।ঘন সবুজ কার্পেটের উপত্যকা। চারিদিকে মস আর ফার্নের উপস্থিতি চোখে পড়লো। ফিরে আবার পথ চলা শুরু করলাম। ৪০কিমির মসৃণ পথে পাড়ি দিলাম।
একটা তিনমাথার মোড় পড়লো ,এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে সোজাসুজি চেরাপুঞ্জির দিকে। আমাদের গাড়ি ঘুরলো বাঁ-দিকে। অনেকটা স্বপ্নপুরীর মতোই মনে হতে লাগলো জায়গাটিকে।একটা ছোট্ট নদীর উপর নির্মিত সেতু পেরিয়ে আমরা চলেছি ডাউকির পথে। নীচে পাহাড়ি খাদ ক্রমশ গভীর হচ্ছে আর উঠে আসছে মেঘ,এ দৃশ্য অতুলনীয়, অসাধারণ। মেঘের আস্তরণ ঢাকা পথ ভেদ করে আমরা পঞ্চপান্ডব চলেছি একটি ভিউ পয়েন্টের দিকে।এই রাস্তা জুড়েই অসংখ্য ভিউপয়েন্ট আছে।ভিড়ে পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে সব সময়েই।এই পরিবেশ আচ্ছন্ন করবেই যে কোন পর্যটককে। প্রকৃতির এই নির্মল উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য পাখ-পাখালির সিম্ফনি জানান দিচ্ছে- এ -এক অন্যজগত, নাগরিক জীবনের কোলাহল মুক্ত সবুজের সমারোহে মুক্ত-বন্ধনহীন জীবন।
পেরিয়ে এসেছি সভ্যতার শেষ বিন্দু শিলং। অদ্ভুত এক নিস্বব্ধতা। নীলচে সবুজ পাহাড়ের সারি আর মেঘের দল। গভীর খাদ নেমেছে নীচে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল না। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটি সুন্দর পাহাড়ি জনপদ ভূমি ছুঁয়ে যাওয়া হলো। একে একে পেরিয়ে গেলাম রঙ্গাই,শুন্হিম,পংটুং পাহাড়ি স্বপ্নের গ্রাম। পাহাড় থেকে অনেকটা নেমে এসেছি আমরা। এবার গন্তব্যস্হল মউলিননং, সেটা অনেক খানি সমতলে। মেঘ আমাদের সাথী, একেবারে মাথার উপর বিরাজমান। সমতলে প্রকৃতি যেন পাল্টে গেল মুহুর্তের মধ্যেই।এ-যেন আমাদের বাংলার চিরপরিচিত আম-কাঁঠালের দেশ। পথের পাশে এক জায়গায় ভালো আনারস পাওয়া গেল।স্বাদে ও রসে অনন্য। সোজা রাস্তা ছেড়ে আমাদের ড্রাইভার ভাই ডানদিকে ঘুরলো। রিওয়াই -মউলিননং হয়ে রাস্তা গেছে সোজা ডাউকির দিকে। মউলিননং প্রকৃত অর্থেই নির্মল গ্রাম। নিঃশ্বাসে বিষ ঢোকে না। এখানকার মানুষ স্বাস্হ্যসচেতন, পরিস্কার -পরিচ্ছন্নতা ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। উত্তর-পূর্ব ভারতের সুন্দরী রাজ্য মেঘালয়ের স্বপ্নের গ্রাম মউলিননং।
অত্যন্ত গর্বেব বিষয়,এশিয়ার ক্লিন ভিলেজের শিরোপা এই গ্রামের এক আকাশ অহংকার। মউলিননং -এর যমজ রিওয়াই। এখানে দেখলাম আশ্চর্য এক জ্যান্ত সেতু— লিভিং ব্রিজ। কংক্রিটের জঙ্গল নয়, প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া এই সেতু। মনে হয় যেন দেবতাদের প্রযুক্তিবিদ বিশ্বকর্মার হাতের ছোঁয়ায় রচিত হয়েছে প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন। শিলং থেকে দূরত্ব মাত্র ৯০কিমি। সারাদিনের সবুজের স্মৃতি পেতে মউলিননং-এর বিকল্প মেঘালয়ে নেই বলে মনে হলো। সেতুর নীচে দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে একা এক পাহাড়ি নদী। এখানকার আনারস অসাধারণ। দুপুরে গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মসুরির ডাল সঙ্গে ডিমের ঝোল আর সাদা ধবধবে ভাত খেয়ে বুঝলাম, মউলিননং শুধু এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রামই নয়, অপূর্ব বাঙালি খাওয়ারের বিশ্বস্ত ঠিকানা। খাওয়া পর্ব সারলাম এবং গ্রাম দেখতে বেরোলাম। রাতে গাছবাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম।ফলে থাকার চিন্তা না থাকায় আনন্দে ভরে উঠছিলো সবার মন। রাজকীয় মহিমায় প্রাকৃতিক রাজসিংহাসন সত্যিই বিরল। মউলিননং-এর প্রকৃতির এই নির্মল-স্হাপত্য শুধু দেখারই ! আমরা পায়ে হেঁটে চললাম গ্রামের মধ্যে।
যদিও মেঘালয় সরকার নিরন্তন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মউলিননংকে মডেল ভিলেজে বানানোর। একশো ভাগ সাক্ষর গ্রাম,দেখে মনে হলো পরিবেশকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখতে প্রতিটি মানুষই সক্রিয়।ক্যালেন্ডারের ছবির মতো এক ধরনের কাঠের তৈরি নয়নাভিরাম বাড়ি। রঙের বাহার,বাড়ির সামনে রঙবাহারি ফুলের বাগান। পর্যটকদের জন্য রয়েছে দু’ কামরার গাছবাড়ি। আধুনিক টয়লেট। গাছবাড়ির লাগায়া বাঁশের পথ বেয়ে মাচায় চড়া,সে এক অনবদ্য রোমাঞ্চকর অনুভূতি। রাতের খাবার পর্ব সারলাম। বাঙালির অতি পরিচিত মেনুতে মজে গেল মন।মসুরির গাল, বেগুন ভাজা, সবজি এবং ডিমের তরকারি। অমৃতের স্বাদ পেলাম।রাত বাড়ছে ক্রমশ। তারাভরা আকাশের নীচে ভাসন্ত বারান্দার চারপাশে গভীর জঙ্গল, নীচে বিশালাকৃতির খাদ, ঝর্নার শব্দ,রহস্যময় উদ্ভিদ,গা ছমছম বনপথ। সীমান্তে সিলেট বর্ডার– বাংলাদেশ। এইভাবেই রাত কাটালাম, পরেরদিন সকালে পাহাড়ের গায়ে গাড়ি মোড় ঘুরিয়ে চলল ডাউকির উদ্দেশ্যে।
বুকিং এই প্রান্তের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সর্বশেষ গ্রাম।অন্যপ্রান্তে বাংলাদেশের তামাবিল আর জাফ্লং টি এস্টেট। এখানেও দু’টি পাহাড়কে জুড়েছে লম্বা সাসপেনশন ব্রিজ। ব্রিজের নীচে দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে উমগোট নদী। একেবারেই পোস্টকার্ডের ছবি যেন। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে মনজুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় ভারত, পায়ের কাছে বাংলাদেশ। সামনে নদীর উপর জিরো পয়েন্ট। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম!কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই। জিরো পয়েন্টে নুড়ি পাথরের দ্বীপে ছোট ছোট দোকান দেখলাম। আমরা সবাই কাছাকাছি গেলাম। তবে নামা বারণ। দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর সদস্যরা সব কিছু সামাল দিচ্ছে। নদীর জল সবুজ।স্বচ্ছ জলের তলায় নুড়ি-পাথর গুলো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ভারতের দিকে নদীটা পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘুরে গিয়েছে। বাংলাদেশে এই নদী অনেক খানি চওড়া। ছোট ছোট বাড়ির টিনের চাল শেষ দুপুরের সোনালী আলোয় চকচক করছে।
নৌকাভ্রমণ করে,জিরো পয়েন্ট ঘুরে সিড়ি ভেঙে উঠে পড়লাম পাহাড়ি রাস্তায়। আজকের গন্তব্যস্হল চেরাপুঞ্জির মায়াবী পথে। গাড়িতে চলতে চলতে চোখে পড়ল একটি নান্দনিক হোডিং।বড় বড় করে লেখা আছে—-“হেডিং টু ক্লাউডস, ফিট ফার্মলি অন গ্রাউণ্ড।” কথা বলতে বলতেই সত্যিই আমরা মেঘের স্বপ্ন রাজ্যে ঢুকে পড়লাম। রাস্তায় দু’টি জায়গায় থামলাম। সাইটের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য। প্রথমেই গাড়ি থামলো মকডল ভ্যালি ভিউ পয়েন্ট,যার সামনেই গ্রিন ক্যানিয়ন। আর অন্যটি হলো ওয়াকাবা ফলসে। খাদের ধারে রেলিং দিয়ে ভিউ পয়েন্ট করা।নানা অচেনা পাখির কলতান শুনতে শুনতেই এগিয়ে চলেছি চেরাপুঞ্জির দিকে, পথের দুপাশে ন্যাসপতি আর চেরিগাছ অযাচিত ভাবে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। নিষ্পত্র গাছগুলিতে শুধু ফুল আর ফুল।
চেরাপুঞ্জিকে এখানকার মানুষরা ডাকে ‘সোরা’নামে। অনেকটাই কাছে এসে গেছি, পথে পড়ল চেরা ব্রিজ ।ব্রিজের বাঁদিকে দেখলাম একটি ভিউ পয়েন্ট।মনে হলো পাহাড়ের ঢালে ঢালে পাইনবনের সারিরা একে অপরকে কোলাকুলি করছে। চেরাপুঞ্জির কাছে এসে মনে হলো, হঠাৎ পাহাড় ছেড়ে মালভূমিতে নেমে পড়েছি। ঢুকে ডানদিকে উপরে রাস্তা গিয়ে মিশেছে চেরাবাজারে,আর সোজা পথ চলে গিয়েছে মইরং-এ। মইরং-এ আছে কিলিং রক আর নয়নাভিরাম পার্ক। সামনের পাহাড়ের শেষ কোনে রেলিং দেওয়া ভিউপয়েন্ট, গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। সামনে খাড়া খাদ। হঠাৎ যেন খাদের অন্ধকার বুক চিরে উঠে এসেছে বিশালাকৃতির চারকোনা কালো পিক। এটাই বিখ্যাত কিলিং রক। ‘কিলিং’ একটি খাসি শব্দ। এর অর্থ ‘শিবলিঙ্গ’।
দূরে রূপসী বাংলাদেশ। সবুজের নকশিকাঁথার মাঠে রুপোলি একফালি বিরহী জলধারা। সীমান্তে ছোট্ট একটি গ্রাম শেলা। সীমান্ত পেরোলেই বাংলাদেশের সিলেট জেলা। পরিচয় হলো একজন সিলেটি বাঙালির সঙ্গে। দেশভাগের পর তিনি চলেএসেছেন খাসি পাহাড়ে। বললেন, বাংলাদেশের সুরমা উপত্যকা থেকে খাড়া উঠে গিয়েছে পাহাড়ের পাঁচিল। তার ই উপর চেরা। উপত্যকার জলভরা মেঘ উপরে উঠে আটকে যায় চেরাপুঞ্জিতে ।
তাই চিরবৃষ্টির দেশ চেরাপুঞ্জি। মনে পড়ে গেল একটি বিখ্যাত কবিতার অংশ——” চেরাপুঞ্জি থেকে একখানা মেঘ/ধার দিতে পার গোবি সাহারার বুকে।” এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম, একজনের সহযোগিতায়। সমস্ত ব্যাগপত্র রেখে ফ্রেস হলাম। সকালের টিফিন পর্ব সংক্ষেপে সারলাম। মিশনের ক্যাম্পাস খুব সুন্দর।স্কুল, হোস্টেল, গেস্টহাউস,লন নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাস। সামনে বিশাল খোলা চত্বর। এক দিকে প্যাগোডা স্টাইলের মন্দির অবস্হান করছে।অন্য প্রান্তে ফুলের বাগান। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ি অনিন্দ্যসুন্দর ল্যাণ্ডস্কেপ, ঘাসের ফুলে থাকা।পাহাড় আর আকাশ মিলেমিশে গিয়েছে হালকা কুয়াশায়। অনেক দূরে সুতোর মতো কালো রাস্তার ছাপ পাহাড়ের বাঁকে। বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝেই। সারা দিন হেঁটে হেঁটে ঘুরলাম পুরো এলাকায়। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়। শুধু মাত্র গায়ে-মাথায় লেগে থাকলো কিছু মেঘের দল, ইতিউতি ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর বাহারি ফুলের ছোঁয়া। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে আসলাম গেস্টহাউসে।
বারান্দায় ঢুকে পড়েছে মেঘের দল। দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম এবং ছোট ছোট লোকালয়ে ঢুকে পড়লাম, ওদের লোকজীবন ও সংস্কৃতির অন্বেষণে। বেশ কয়েকটি হোমস্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি। এদের সঙ্গে পরিচয় ও আলাপ হলো। এঁদের কাছে জানতে পারলাম, ফসলের কামনায় জয়ন্তিয়া ও খাসিরা ‘বেদিন খাম’ উৎসব পালন করে। আগস্ট—সেপ্টেম্বর জুড়ে জাতীয় উৎসব পালিত হয়” নংক্রেম”ছোট ছোট লোকালয়গুলো শিলং-এর পুরানো পাড়াগুলোর মতই। কাঠের তৈরি বাড়ির বারান্দায় ফুলের বাহার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজার ছাড়িয়ে থাংখারাং পার্কের দিকে এগিয়ে চললাম। এই পথ চলেগেছে, ডাউকির পথে বাংলাদেশের দিকে। পরবর্তী গন্তব্য স্হল নোহ-কা–লিকাই ফলস। পার্কের উপরে রয়েছে সুন্দরী কিনরিম ফলস আর বাংলাদেশের ১৮০ ডিগ্রি অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট।উচ্চতম প্লাঞ্জ জলপ্রপাত দেখলাম। এই ফলসকে নিয়ে গল্প আছে। আসলে পুরো মেঘালয় জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গল্প-গাথা আর কিংবদন্তি। খাসি প্রজাতির মানুষজনেরা বিশ্বাস করেন অনেক রকম দেবতা আছে, যারা নাকি এই সবুজ বনানির রক্ষাকর্তা।ড্রাইভারের কাছ থেকেই শুনলাম খাসি দেবী ‘লাবসা’র লোমহর্ষক কাহিনী। আমরা চললাম শেষ গন্তব্য স্হল সেভেন সিস্টারস ফলসের উদ্দেশ্যে। সবুজ পাহাড়ের বুক থেকে নেমে এসেছে সাত-সাতটা ঝর্না। পাথরের গায়ে গায়ে জলের দাগের কত রকমের কারুকার্য। বাংলাদেশের ভিউটা ভারী অদ্ভুত এই চেরাপুঞ্জির পাহাড় থেকে।
এবার ফেরার পথে রওনা দিলাম। দেখতে দেখতে হলুদ উপত্যকার শেষে আবার শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, বাঁদিকে চলল থরে সাজানো পাহাড়। মনের অন্দরমহল’ জুড়ে কয়েকদিনের জীবন্ত স্মৃতি বিরাজমান। নানা ধরনের ভাবনার উদয় আর অস্ত। মাত্র ৬দিনের তোমায় কতটুকু চিনলাম শিলং। তোমার অঙ্গে অঙ্গে এত রূপের হাতছানি— সব আমি এত অল্প সময়ে আমার ক্ষুদ্র দুটি চোখ দিয়ে কতটুকুই দেখব? বড় ইচ্ছে ছিল দেবী নারটিআঃ জয়ন্তেশ্বরীর মন্দিরে পুজো দেওয়ার। উরমিয়াম লেক আর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে পাশে রেখে ফেরা ভোরের নরম আলোয় উমিয়মের জল তখন তরল সোনা। সোনালী জলে ডাকছে রাতজাগা পাখি। আকাশে মেঘের দল ওই তো ঘন হয়ে এলো। তবুও বৃষ্টি নামল না পাইনের জঙ্গলে। মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতির,’ আমরা প্রত্যেকে নির্জন গিরিশৃঙ্গে একাকী দণ্ডায়মান হইয়া উত্তরমুখে চাহিয়া আছি, মাঝখানে আকাশ এবং মেঘ,রেবা–শিপ্রা-অবন্তি–উজ্জ্বয়িনী, ভোগ–উপভোগের চিত্রলেখা, তাহাতে মনে করাইয়া দেয়, কাছে আসিতে দেয় না, আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক করে, নিবৃত্ত করে না।’ আমি বাঁচব শিলং, তোমার কাছে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচব।
শিলং হয়ে আমাদের গাড়ি চলেছে গুয়াহাটির দিকে,আর কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে যাব। রাত দশটায় কোলকাতায় ফেরার ফ্লাইট। ফেলে আসা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া জনপদভূমির কথা মনে হতে লাগলো। ৬দিনের স্মৃতিবুকে নিয়ে আবার কেজো জীবনের প্রত্যাবর্তন। এটাই স্বাভাবিক। একটা অধরা স্বপ্নপূরণের কথা মনজুড়ে জেগে উঠেছে। শিলং তোমার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে, আমি ভিজব। ভাবতে ভাবতেই আমরা পঞ্চপান্ডব আকাশ পথে পাড়ি দিলাম কিছু অপার ভালোলাগা বিরল অনূভূতি নিয়ে।
ডঃ সুবীর মণ্ডল