ইট-পাথরের শহর মানেই নিত্যদিনের কোলাহল, যানজট, বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের খেলা। শহরের এই চিত্র বাদ দিলে সারা দেশেই দেখা মিলবে বিস্তৃত সবুজ বন, সাগর, নদী, সমতল এবং পাহাড়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। সবুজ প্রকৃতির পার্বত্য অঞ্চল ও তার নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশ্বের অন্যতম বড় ম্যানগ্রোভ বন, কক্সবাজারের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত, সিলেট অঞ্চলের চা-বাগান, জল-পাথর এবং সবুজ অরণ্য শুধু দেশীয় নয়, বিদেশিদেরও টেনে আনে।
এ ছাড়া সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলরাশির ভুবন ভোলানো মায়া এড়ানোর সাধ্য কার? কর্মময় জীবনের চাপে হাঁপিয়ে উঠলে একটু খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে কমবেশি সবারই নিয়মিত বিরতিতে চেষ্টা থাকে নির্জন, ছায়া সুনিবিড় মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কদিন কাটিয়ে আসার।
অন্যদিকে একঘেয়েমি এড়িয়ে চলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হওয়ায় ঋতু বদলের মতো স্থান এবং হাওয়া বদলের মধ্যেও মানুষ বিনোদন ও স্বস্তি খুঁজে বেড়ান। বৈচিত্র্যময় পরিবেশ ও প্রকৃতিই পারে এই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটাতে। এ কারণে অস্থির মনে প্রশান্তি জোগাতে অনেকেই বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণে। কেউ ছুটে যান একা, কেউ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দল বেঁধে, কেউ আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে। নতুন দম্পতিদের এই ভ্রমণবিলাস তো যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ‘বেরিয়ে পড়া’ যে কারও সদিচ্ছার ওপরই নির্ভর করে। কিন্তু পুনরায় নিরাপদে ফিরে আসার আগপর্যন্ত সময়টি চক্রের মতোই জড়িয়ে থাকে পুরো পর্যটনশিল্পের সঙ্গে। প্রশান্তির জন্য শুধু চুটিয়ে ঘুরে বেড়ালেই হবে না। ভ্রমণকালীন সার্বিক নিরাপত্তা থাকতে হবে। উদরপূর্তিতে যা খুশি খাওয়া-দাওয়া, বৈচিত্র্যমূলক বিনোদন রাইডে আরোহণ, দিন শেষে রাতযাপনে আবাসনের সুব্যবস্থা এবং ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়ারও নিশ্চয়তা থাকতে হয়। তবেই ভ্রমণের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। এ শিল্পের সবখানেই জড়িয়ে রয়েছে প্রয়োজনীয় সেবা সরবরাহের বিনিময়ে অর্থের সংশ্লিষ্টতা। এ জন্যই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বিশ্বজুড়েই পর্যটনশিল্পের গুরুত্ব অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্যমতে, সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন কেন্দ্র আছে ১ হাজার ৪০০টি। প্রতিবছর এসব জায়গায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সমাগম থাকে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান। পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, ভ্রমণপিপাসুরা যাতায়াত করেন এমন সব জায়গায় সামর্থ্য অনুযায়ী সবার রাতযাপনে বিভিন্ন মানের হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। রয়েছে খাওয়া-দাওয়া ও ব্যবহার্যের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের সুব্যবস্থা।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বলছে, এর বাইরে নিরিবিলি পরিবেশে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মানের রিসোর্টেও অবকাশ যাপনে আসছেন পর্যটকেরা। সারা দেশে এ ধরনের আট শতাধিক রিসোর্ট রয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বহুলাংশে বেড়েছে। পর্যটন গন্তব্যগুলোতে যাতায়াতের সুবিধা বেড়েছে। এতে দেশীয় পর্যটকদের ভ্রমণপ্রবণতা বেড়েছে। বিদেশিরাও বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
টোয়াবের তথ্যমতে, দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রতিবছর দেড় কোটির বেশি অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সমাগম হচ্ছে। আর বিদেশ থেকে আসছে এবং দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে ৫০ লাখের বেশি মানুষ। ইতিমধ্যে এই খাতটি ৪০ লাখ মানুষের বেকারত্ব দূর করেছে। জিডিপিতে অবদান রাখছে ৩.৪ থেকে ৩.৮ শতাংশ পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব জানিয়েছেন, সময়ের চাহিদা বিবেচনায় দেশে খাতটি এখন শ্রমঘন শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে সরকার যদি খাতটির প্রতি আরও মনোযোগী হয় এবং উদ্যোক্তারা দায়িত্বশীল হন, তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে দীর্ঘ মেয়াদে।
জানা গেছে, ইতিমধ্যে সহস্রাধিক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে পর্যটন খাতে। নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বাড়ছে বিনিয়োগ। কোনো কোনো হোটেল-রিসোর্ট নির্মাণে ১ হাজার কোটি টাকার ওপরেও ব্যয় হয়েছে। সিলেট, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন এবং পার্বত্য জেলাগুলোতে রয়েছে পাঁচ তারকা মানের হোটেল-রিসোর্ট। এর বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরি হয়েছে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার মতে, পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিহিত থাকে। সারা দেশে পর্যটন স্থানগুলোতে সেটিই দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে।