শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল হলেও দিনে দিনে কমছে শাপলার দেখা। এক সময় গ্রাম বাংলার বিলজুড়ে সৌন্দর্য ছড়ানো আমাদের জাতীয় ফুল এখন বিলুপ্তির পথে। শাপলার আরেকটি জাত লাল শাপলা বা রক্ত কমল, যা খুব কম চোখে পড়ে এখন।
নেত্রকোণা জেলার বেশ কিছু স্থানে রয়েছে লাল শাপলা বিল। এসব বিলের বেশিরভাগই নিচু ফসলি জমি। বর্ষাকালে এসব জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। তখন বিলে প্রাকৃতিকভাবে শোভা ছড়ায় অসংখ্য লাল শাপলা ও পদ্ম ফুল। আর এই অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর দুর্দান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থী ও পর্যটকরা।
নেত্রকোণা সদর উপজেলার কালিয়াড়া গাবরাগাতি ইউনিয়নের নাড়িয়াপাড়া গ্রামের ঘোরাদিঘি বিলে এখন শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন লাল শাপলা। বিলে এখন দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে সব সময়।
প্রাকৃতিক জলাভূমির বুকজুড়ে ফুটে আছে দৃষ্টিনন্দন লাল শাপলা। এই সৌন্দর্যের আরো কাছে থেকে উপভোগ করতে শাপলা বিলের বুক চিরে ছোট ডিঙি নৌকায় করে দর্শনার্থীরা ঘুরে বেড়ান মনের আনন্দে। খুব ভোর না হলেও সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে বিলে। শুধু নেত্রকোণা নয়, আশেপাশের জেলা থেকেও দর্শনার্থীরা আসেন এ লাল শাপলা বিলে।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌহিদা ফাতিমা বলেন, আমরা মূলত ঢাকায় থাকি, গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণাতেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধবের দেওয়া পোস্টের ছবি দেখে এখানে ঘুরতে এসেছি। আজকে আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। তার জন্য সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে পারিনি। আরো সকালে আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য আরো ভালোভাবে উপভোগ করা যেত।
তৌহিদা আরো বলেন, আরেকটা জিনিস বলতে চাই, দেখলাম এখানে বেড়াতে এসে অনেকেই অনেকগুলো করে ফুল তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যেটা আসলে উচিত নয়। কারণ ফুল প্রকৃতিতেই শোভা পায়। তারা এটা তুলে নিয়ে যাওয়াতে প্রকৃতির সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে, যেটা কাম্য নয়।
ঢাকার আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজাউল হক বলেন, আমিও ঢাকায় থাকি। গতকাল আমরা নেত্রকোণা বেড়াতে আসার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে ঘুরতে আসব। কিছুদিন যাবত আমরা বন্ধু-বান্ধবের ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে এই বিলের সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি দেখলাম। এ বিলে সকালেই এসেছি কিন্তু এসে জানতে পারলাম আরো সকালে আসলে ভালো হতো। ভোর বেলায় নাকি ফুলগুলো অনেক সুন্দর ছিল। তবুও এখন যা দেখলাম সেটাও অসাধারণ মনোমুগ্ধকর। ভোরবেলায় যদি আসতে পারতাম তাহলে হয়ত আরো সুন্দর একটা প্রকৃতি উপভোগ করতে পারতাম।
দর্শনার্থীদের আনাগোনা বাড়ায় এলাকার অনেকেই দর্শনার্থীদের নৌকায় নিয়ে ঘুরে বাড়তি আয় করছেন। অনেকেই নৌকার পাশাপাশি বিলের মাঝখানে প্রাকৃতিক বাঁশ-কাঠ দিয়ে মাচা বানিয়েছেন। যেখানে সুন্দর সুন্দর ছবি ধারণ করতে রয়েছেন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। অনেকেই নৌকায় চড়ে ঘুরে ঘুরে ফুল দেখছেন, ফুলের সাথে ছবি তুলছেন। ফুলের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হচ্ছেন ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা।
লাল শাপলা বিলে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ছবি তোলেন মোহাম্মদ লিটন। এখানে কেমন ছবি তুলেন জানতে চাইলে বলেন, আমরা এখানে ফটোগ্রাফি করি। এখানে যারা বেড়াতে আসেন তাদের ছবি তুলে দেই। বর্ষাকালে তিন মাস এখানে শাপলা ফুল ফুটে। অনেকেই এখানে বিলে শাপলা দেখতে আসে। এখানে যারা বেড়াতে আসে অল্প পেমেন্টের মাধ্যমে তাদের ছবি তুলে দিয়ে থাকি। এতে করে যারা বেড়াতে আসেন তারাও সুন্দর ছবি পেয়ে খুশি। আমাদেরও একটা পার্টটাইম ইনকামের ব্যবস্থা হয়। এদিকে স্থানীয়রা নিষেধ করলেও অনেক দর্শনার্থী ঘুরতে এসে তুলছেন ফুল। এতে বিলের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা।
ঘোরাদিঘি বিলের মাঝি দুজাহান মিয়া বলেন, আমরা সকাল থেকেই নৌকা নিয়ে এখানে তৈরি থাকি। কারণ বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এই বিলে বেড়াতে আসে এবং তারা ফুলের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আমাদের এই নৌকাগুলো ব্যবহার করে। বর্ষাকালে সাধারণত তিন মাস লাল শাপলা ফুল স্থায়ী হয়। ঘুরে বেড়ানোর পর খুশি হয়ে যে যে পরিমাণ টাকা দেন, আমরা সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি, আমাদের আলাদা কোন দাবি থাকে না। তবে সবচেয়ে সমস্যার বিষয় হলো, এখানে যারা বেড়াতে আসেন তারা ফুল দেখার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ফুল তুলে নিয়ে যান। যেটার কারণে এ বিলের সৌন্দর্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়।
এসব বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া তাবাসসুম বলেন, নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের সবাই চায় একটু প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার জন্য। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই বিলগুলো মানুষের প্রকৃতির কাছে যাওয়ার একটি ভালো ঠিকানা। একটি অঞ্চলে যদি পর্যটন গুরুত্ব বাড়াতে হয় সেক্ষেত্রে অবকাঠামো নিরাপত্তা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এখানে যারা স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আছেন। যাদের জমি বা সম্পত্তির মধ্যে বিলগুলো পড়ে তারা নিজেরাও আগ্রহী এ এলাকাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। পাশাপাশি তারা যদি স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে সরকারের সমন্বয় চান তাহলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব। এর বাইরে অবকাঠামোগত যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়মিত উন্নয়নের পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করব স্পেশাল নজরদারির মধ্যে রাখতে। আমরা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করব।
তিনি আরো বলেন, দিনশেষে প্রকৃতির কাছাকাছি আমাদের ফিরতেই হয়। সেক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতিকে উন্মুক্ত রাখতে চাই। প্রকৃতিকে যদি আমরা উপভোগ করতে চাই তাহলে সকলের জন্য এটা উন্মুক্ত রাখতে হবে। আমরা চাই পর্যটক এবং ভ্রমণ পিপাসু যারা আছেন, তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, সবাই মিলে যেন প্রকৃতির উপভোগ করতে পারি, সেই পরিবেশটা যেন ঠিক থাকে। পাশাপাশি আমরা সবাই যে যার জায়গা থেকে এর সৌন্দর্য ঠিক রাখার জন্য সচেষ্ট থাকব।