বাসা থেকে একশো দশ কিলোমিটার দূরে এক লেকের নাম কালাবগী। এমন নাম কীভাবে হলো জানা নাই। উদ্দেশ্য নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, নৌকা চালানো, পিজা খাওয়া। ছেলে-মেয়েরাও দূরের ভ্রমণ পছন্দ করে। আর আমার বিশেষ কৌতূহলের কারণ হলো লেকটার উদ্ভট নাম; কালাবগী! কেমন জানি কানাবগি টাইপের..
ছেলে-মেয়েরা গাড়িতে উঠলে আর বাসায় ঢুকতে চায় না। আবার, বাসায় ঢুকলে আর সহজে বেরুতে চায় না। এমন কি, বাসায় ঢোকার গলিতে চলে আসলেও আবদার ধরবে- আব্বু একটু দূর দিয়ে যাও প্লিজ?..
তখন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের বেশি দূরের রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। তাতেই তাদের আনন্দ।
পিজা আর পুতিনের লোভ দেখাতেই বাচ্চা দু’জন রাজি হয়ে গেলো। ওরা আসলে কিন্তু বাচ্চা না; একজন বারো, আরেকজন পনেরো বছরের। বাপ তো, তাই..। নৌকাটা উঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলা শুরু করে গিন্নিকে রসিকতা করে বললাম- আচ্ছা, এখন যদি দেখি বৈঠা নেইনি?- বলে আমরা দুজন খুব করে হাসলাম। উল্লেখ্য, এটা বাতাস দিয়ে ফুলানো নৌকা; বিরাট ব্যাগের মধ্যে সবকিছু আছে।
দখিনা বলল, বৈঠা না নিয়ে আগে কখনো গেছো?
– হ্যা? ঐযে আমি আর তোর চিশতী আংকেল নৌকা চালাতে গিয়ে বৈঠা না নিয়েই অন্টারিও লেকে নৌকা ভাসিয়ে পথ হারিয়ে ভাসতে ভাসতে অনেকদূর চলে গিয়ে মরার দশা হইছিলো। পরে হেলিকপ্টার এসে আমাদের উদ্ধার করলো!
– ধুর আব্বু, এসব সত্যি না। বিত্ত, আব্বুর কথা কি সত্যি?- দখিনা কনফিউসড হয়ে জিজ্ঞেস করে তার পাশে বসা ভাই কে।
তার দুষ্টু ভাই কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মিটিমিটি হাসলো। ঐটা আরেক ফাজিল।
আমরা দোকান থেকে পিজা আর পুতিন কিনে নিয়ে, গান শুনতে শুনতে আর চিপস চিবাতে চিবাতে ছুটলাম পশ্চিমে; কালাবগী’র দিকে। গিন্নি পাশ থেকে আমার হাতে একটা করে চিপস দিতে থাকে। বিত্ত কে সাবধান করলাম, খবরদার আগেই পিজায় হাত দিবি না! ওটা তার হাতের নাগালেই। আর পুটিনের সে মহা ভক্ত।
পৌঁছুলাম বিকাল চারটার পর। বের হতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল।
নাস্তা খেয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম।
সুন্দর লেক, লোকজন নৌকা চালাচ্ছে, কিছু দূরে পাহাড়, পাখি উড়ছে। লেকের পানি থেকে নদীতে জলবিদ্যুতও তৈরী হচ্ছে। একটা সাইডে আবার নৌকা নামানোর ব্যবস্থা আছে। পাথর বিছানো ঢালু জায়গা। পারফেক্ট! আবহাওয়া খুব সুন্দর; বাইশ ডিগ্রির মতো। বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ছবি তুলে, রিল্যাক্সড হয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকলাম মেয়েটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে।
এবার নৌকা ফুলানোর পালা।
আমি আর গিন্নি মিলে ফুলালাম অনেক কষ্টে। তারপর পানিতে নামানোর পালা। খুব একটা ভারী না। তবে গিন্নির দিকে তাকিয়ে ভরসা পেলাম না। তার আশংকা এই বাতাসে তার স্বামী ব্যালেন্স হারিয়ে উল্টাদিকে ভেসে যাবে। বিত্ত আর দখিনাও নিষেধ করলো- আব্বু চালানোর দরকার নাই, বাতাস!
কিছু মানুষ তো চালাচ্ছে? অবশ্য ওদের নৌকায় দুজন বা তিনজন করে। আমার মতো আনাড়ীর একা চালানো রিস্কের বৈকি!
আল্লাহ ভরসা। লাইফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বৈঠা আনতে ব্যাগটা হাতড়াতে থাকি। কোই? আরে, বৈঠা কোই?
গিন্নীও খুঁজে পেলো না।
আনিনি!
এবারও আমরা হাসলাম, তবে বোকার মতো!
দূরে একটা গ্রাউন্ড হগ (মোটা-তাজা বিড়াল সাইজের প্রাণী) দেখতে পেয়ে ছবি তুলতে এগিয়ে গেলাম। সেটা গর্তের মধ্যে পালালো। আমি গর্তের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম- “এক্সকিউজ মি মিস্টার হগ, এবারে শীত কেমন পড়বে জানালে খুব উপকার হইতো, আমার বেশি ঠান্ডা খুব অপছন্দ। এক্সকিউজ মি.. হ্যালো! বাড়ি আছেন নি?”
দখিনা হেসেই কুটিপাটি। কানাডিয়ানদের বিশ্বাস গ্রাউন্ড হগ আবহাওয়ার অগ্রিম বার্তা দিতে পারে, শীত কম না বেশি পড়বে বলতে পারে। এ নিয়ে মেলা, অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ফেব্রুয়ারীর প্রথমে যদি হগ গর্ত থেকে বের হয়ে তার নিজের ছায়া দেখতে পায়, তবে শীতকাল আরও ছয় সপ্তাহ দীর্ঘায়িত হবে। আর যদি তার ছায়া দেখতে না পায়, তাহলে বসন্ত তাড়াতাড়ি আসবে।
.
এবার নৌকার বাতাস বের করবার পালা। ফুলানোর চাইতেও বাতাস বের করা আরও কঠিন। ভাল্ভ খুলে দিয়ে তিনজন কে নৌকার ওপর বসিয়ে দিয়ে চাপ মেরে বাতাস বের করে নৌকা ভাঁজ করে গাড়িতে তুললাম। শুটকি দখিনা আদৌও কোনো কাজে আসলো কি না বুঝলাম না।
ওদিকে সন্ধ্যা হবার আগে লেকটার পানি সবুজ রঙে ঝিকমিক করতে লাগলো। কি প্রশান্তি! মনে হচ্ছে একটা তাবু খাটিয়ে এখানেই শুয়ে পড়ি।
সংসার থাকলে অনেক কিছুই সম্ভৰ নয়। অনেক নিয়মের মধ্যে আটকিয়ে যেতে হয়। তবে একবার সত্যি সত্যি হঠাৎ কাউকে না বলে বনের মধ্যে তাবু খাটায়ে থাকবো একা একা! কেউ জানবে না!
বিদায় হে কালাবগী!