বন্ধুদের মঙ্গে ঘুরতে যেতে কার না ভালো লাগে। হঠাৎ করেই একদিন সবাই মিলে ঠিক করা হলো কলমাকান্দা যাবো। যেই চিন্তা, সেই কাজ! বলে রাখা ভালো, অনেকে প্রথমে রাজি না থাকলেও সকালে তারাই সবার আগে হাজির হয়ে যায়। যা ভ্রমণে বাড়তি আমেজ তৈরি করেছিলো।
নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়ি সৌন্দর্যে ঘেরা একটি এলাকা হলো পাঁচগাঁও, যা রংছাতি ইউনিয়নে অবস্থিত। আমরা পরদিন সকাল ৫টা ৪০ মিনিটে মোহনগঞ্জ লোকাল ট্রেনে করে ময়মনসিংহ থেকে রওনা করলাম কলমাকান্দায়।
ট্রেনের যাত্রা, তাও আবার সকালবেলা। আমাদের সবাইকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। ট্রেনের মধ্যে আড্ডা ও বাইরের মনোরম পরিবেশ দেখতে দেখতে একের পর এক স্টেশন শম্বুগঞ্জ, বিসকা, গৌরীপুর, শ্যামগঞ্জ, হিরণপুর, চল্লিশা নগর, নেত্রকোনা, নেত্রকোনা কোর্ট ও বাংলা পার করে ঠাকুরাকোনায় এসে পৌঁছালাম।
সবাই দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। তারপর একটা লেগুনা ভাড়া করে সবাই কমলাকান্দার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। অনেক দূর থেকে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। দূর থেকেই পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো মেঘের সঙ্গে মিশে রয়েছে। অনেকে পাহাড় দেখে আনন্দে চিৎকার করতে লাগলো।
সকাল ৯টায় কলমাকান্দা বাস স্টেশনে নেমে সবাই হোটেলে নাশতা করলাম। তারপর কয়েকটি অটোরিকশা নিয়ে আমরা পাঁচগাঁও গ্রামের দিকে রওনা হলাম। সড়কের দু’পাশেই বিল আর সামনের দিকে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। এরপর যথারীতি আমরা পাঁচগাঁওয়ে পৌঁছাই।
এর উত্তরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে ডিঙ্গাসদৃশ পাহাড়টি চন্দ্রডিঙ্গা নামে পরিচিত, সেই প্রাচীন যুগ হতে। বর্তমানে স্থানটিতে ৭টি পাথরের নৌকার আকৃতি টিলা আছে। গারো পাহাড়ের ছোট ছোট অংশগুলো স্থানীয়ভাবে টিলা নামেও পরিচিত, চারপাশে সমতল ভূমির মাঝখানে অবস্থিত এই টিলা।
টিলার পাদদেশেই বাস করে হাজং ও গারো উপজাতিরা। টিলাগুলো অনেক সুন্দর একেবারে সবুজের সমারোহ বললেই চলে। স্থানীয়দের মতে, ভারতের পাশে পাহাড়ে এখনও হাতির দেখা মেলে। ছোট-বড় কিছু প্রাণী আছে এই টিলাগুলোতে। টিলার পাদদেশের মেঠো পথ ধরে বিখ্যাত বটগাছ।
সবাই সেখানে একটু বিশ্রাম করি। তারপর আমরা ঝিরিপথ দিয়ে ঝরনার দিকে চললাম। ঝিরিতে পা রাখা মাত্রই আমাদের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল! এতো শীতল, নির্মল, আরামদায়ক একটা পরিবেশ বর্ণনা করা কঠিন। ঝরনার অবিরাম স্রোতধারা আর মনোরম দৃশ্য আমাদের মনকে জুড়িয়ে দেয়।
ঝরনার পানি পাহাড় থেকে পড়তে দেখাটা অনেকটা আনন্দের উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঝরনার পানিতে খুব ভিজলাম আমরা। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বিএসএফ ক্যাম্প, পাহাড়ের বুক চিরে বর্ডার কাঁটাতারের বেড়াগুলো দেখা যাচ্ছিল। অতঃপর আমরা কয়েকটি ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে বড় ঝরনার গায়ে পাথুরে প্রাকৃতিক সিঁড়ি বেয়ে টিলার উপরে উঠতে শুরু করলাম।
আমরা ছাড়াও আরও অনেকেই এখানে ঘুরতে এসেছিল। দূরন্ত পর্যটকরা দিচ্ছে আনন্দের হাতছানি, চলছে সেলফি। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছে নাম না জানা কতশত গাছপালা। সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৌন্দর্য কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। আমরা ঘণ্টাখানেকের মতো ঝিরিপথ ধরে উপরে উঠলাম, মনে হচ্ছিলো আর একটু উপরে হয়তো ঝরনার দেখা পাব!
আমাদের অনেকে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, তারা আর সামনের দিকে যেতে পারলো না (আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পাথুরে পথ আমরা কেউই অভ্যস্ত নই)। আমরা কয়েকজন আরও উপরের দিকে এগিয়ে গেলাম। উপরের দিকের ঝিরিপথটা আরও বেশি উঁচু ছিল, কি অনিন্দ্য সৌন্দর্য তার!
কিছুক্ষণ পর আমি একা হয়ে গেলাম, কাউকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না! কয়েকজন বন্ধু উপরে উঠে গেছে তাদেরকে দেখা যাচ্ছিলো না। এই নিস্তব্ধ পাহাড় কি ভয়ংকর সুন্দর! সেই মুহূর্তে আমার বুকটা ধরফর করে ওঠে, এই যেন পড়ে গেলাম এই ভেবে। বর্ডার কাছাকাছি থাকাই বিএসএফ টহল দলেরও একটা ভয় ছিল মনে।
তখন আমরা মেঘালয় রাজ্যের অনেকটা ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম। আমি আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপরের দিকে উঠলাম না। দুপুরের পর সবাই নিচে নেমে এসে স্থানীয় উপজাতিদের দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আবার স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
এসে দেখি ঠাকুরাকোনা স্টেশন থেকে ট্রেনটা চলে গেছে আগেই। স্টেশনেই বসে রইলাম সারা বিকাল প্রচুর আড্ডা, খোশ গল্প ও পুকুর থেকে মাছ ধরা অনেক কিছুই উপভোগ করলাম সবাই। সন্ধ্যার পরে ট্রেন আসলে আমরা ট্রেনে করে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
পাহাড় ঝরনা আর সবুজ সমতলের এই ছোট্ট সুন্দর গ্রামটি আমাদেরকে নিরাশ করেনি। তবে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার অপূর্ণতা আমার মনে রয়েই গেল!