সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীটাকে সাজিয়েছেন অপার মহিমা দিয়ে৷ কোথাও পাহাড়, কোথাও পর্বত, কোথাও মালভূমি, কোথাও অপরিসীম জলরাশি, কোথাও সমতল আবার কোথাও বা কলকল ধ্বনি দিয়ে বয়ে চলা ঝর্ণা৷ এক একটি নিদর্শনের এক এক রূপ৷ তেমনি সেন্টমার্টিন দ্বীপ স্রষ্টার একটি মহান দান , যা বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ও লবনাক্ত জলরাশির মধ্যখানে সুমিষ্ট ও সুপেয় জল আর নারিকেল এর বাহারী সমাহারক্ষেত্র৷ প্রায় শতভাগ মুসলিম এই ক্ষুদ্র জনপদটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন হিসাবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর আমলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বর্তমানে জনপ্রিয় ও রোমান্ঞ্চকর পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে সুপরিচিত৷
গত ১৭ই মার্চ,২০১৯ইং ভোর বেলা আমরা বাংলাদেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই৷ আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর শেষে সাইড চেইন হিসাবে বান্দরবান, কক্সবাজার সী বীচ যাই৷ এর পর সেন্টমার্টিন ভ্রমণ ছিল একটি রহস্যময় ও চমকপ্রদ ব্যাপার৷ ঐদিন নয়টায় টেকনাফের কিরুনতলী জাহাজঘাট থেকে জাহাজ ছাড়বে বলে আমরা একটি বাস ও একটি হায়েস নিয়ে ভোর বেলা যাত্রা শুরু করি৷ যাওয়ার সময় বাসটি টেকনাফের প্রধান সড়ক হয়ে গেলেও আমরা প্রফেসর ড.মামুন আল রশীদ স্যারের সাথে হায়েস যোগে সেনাবাহিনী কর্তৃক নবনির্মিত মেরিন ড্রাইভ রোড হয়ে প্রায় আটটার দিকে কিরুনতলী জাহাজ ঘাটে পৌঁছাই৷ মেরিন ড্রাইভ রোডের গা ঘেষে পূর্বে উচুঁ উঁচু পাহাড় আর পশ্চিমে সাগরের উত্তাল টেউয়ের দেখা মিলবে৷
বেলা প্রায় নয়টার দিকে আমাদের সীট রিজার্ভ করা জাহাজ কেয়ারী সিন্দাবাদ এ চড়লাম সবাই৷ জাহাজ ছাড়লে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হলো, পাশাপাশি সাগরের দুধারের পাহাড়, জনপদ সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয়৷নাফ নদী পেরিয়ে বঙ্গপোসাগরের জলরাশিতে চলতে চলতে জাহাজ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বদিকের শেষ বিন্দু শাহপরীর দ্বীপ, মায়ানমারের মংডু শহর, উঁচু উঁচু পাহাড় আর উপকূলীয় অন্ঞ্চলের সৌন্দর্যের হাতছানি চোখে পড়বে৷ বেলা প্রায় বারটার দিকে দ্বীপের একমাত্র জরাজীর্ণ জেঠিঘাটে জাহাজ পৌঁছালে আমরা জেঠি বেয়ে সেন্টমার্টিং দ্বীপের আসল সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে প্রবেশ করি৷ যাতায়াতের জন্য এখানে সুপরিচিত ছাদওয়ালা ভ্যান গাড়ী বা লাভিং কার রয়েছে৷
আমাদের বুকিং করা সী প্রবাল বীচ রিসোর্ট এ গিয়ে সবাই রুম ভাগ করে নিল৷ অন্য সবাই চার-পাঁচ জন করে এক এক রুমে প্রবেশ করল৷ড. হেলাল উদ্দিন স্যার স্বপরিবারে ছিলেন, প্রফেসর ড. শামসুল আলম স্যার ও প্রফেসর ড. অশোক কুমার চক্রবর্তী স্যার কক্সবাজার থেকে সফর শেষ করে চলে যাওয়ায় প্রফেসর ড. মামুন আল রশীদ একা হয়ে যান৷ ফলে স্যারের সঙ্গী না থাকায় স্যার আমাকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন৷ রিসোর্টের দোতলার পূর্বদিকের সর্বউত্তরের কক্ষটিতে স্যার আর আমি, চরম ভালগার একটা ব্যাপার হল এই কক্ষ থেকে জানালা দিয়ে উকি দিলেই সাগরের উত্তাল তরঙ্গের ঢেই আর কলকল শব্দে মুখরিত পরিবেশের দৃশ্য দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল৷
দ্বীপের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জিনজিরা বা নারিকেল গাছ, যার জন্য একে জিনজিরা নামেও অবিহিত করা হয়৷ সুমিষ্ট নারিকেল আর ডাবের সুপেয় পানি একটি ভিন্ন মাত্রা দেয় পর্যটকদের৷ রয়েছে ছেড়াদ্বীপ , কেয়াবিথী সমুদ্র সৈকত নামে ক্ষুদ্র অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ যা সেন্টমার্টিন দ্বীপেরই বিশেষ সৌন্দর্যমন্ডিত অংশ৷ দ্বীপটি ঘুরে দেখা মিলবে দ্বীপের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে পুলিশ ফাড়ি, কোষ্টকার্ডের কোয়ার্টার, নৌ বাহিনী স্টেশন৷ বাজারে ঘুরে বিভিন্ন স্বাদের খাবারের বাহারী সমাহার, ঝিনূক-কড়ি, সেন্টমার্টিন দ্বীপের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্বলিত বই ‘ জিনজিরা থেকে সেন্টমার্টিন’ ৷ যার লেখক সেন্টমার্টিনের সাবেক সফল চেয়ারম্যানের বড়পুত্র , সেন্টমার্টিনের অন্যতম কৃতি সন্তান বাংলাদেশ মানবাধিকার এর সেন্টমার্টিন শাখার সভাপতি, সেন্টমার্টিন বিডি নিউজ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক এডভোকেট এম এ কেফায়েত উল্লাহ খান৷ সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সুবাদে চমৎকার ব্যক্তিত্বের এই তরুণ লেখকের সাথে আমার যথেষ্ট সখ্যতা গড়ে উঠেছে৷
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের এই ইউনিয়নে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নৌবাহিনী পরিচালিত সেন্টমার্টিন বি এন ইসলামিয়া স্কুল এন্ড কলেজ, কয়েকটি এতিমখানা ও কয়েকটি ফুরকানিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। আরও রয়েছে তেরটি মসজিদ, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় মসজিদটি ১৯৫৬ সালে নির্মিত৷ এছাড়াও রয়েছে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়দ আহম্মেদের নির্মিত সমুদ্রবিলাস রিসোর্ট৷অন্যান্য হোটেন মোটেল এর মধ্যে বাগানবাড়ি রিসোর্টটি অন্যতম৷ এই দ্বীপের মানুষ অনেক ধর্মবান্ধব বলেও একটি সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তারা দ্বীপটির আদিকাল থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে এলেও ১৯৯০ সাল থেকে পর্যটন এলাকা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত পাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
বর্তমান সময়ে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ পর্যটন ব্যবসাকে প্রধান ব্যবসা হিসাবে বেঁচে নিয়েছেন। যার যা ছিল জায়গা জমি ফিশিং ট্রলারসহ সব কিছু বিক্রি করে কেউ কটেজ কেউ বা রেস্টুরেন্ট, কেউ আবার বীচ চেয়ার আবার অনেকেই ডাব বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ঠিক এমন সময় কিছু পরিবেশবাদী পরিবেশ বিনষ্টের দোহাই দিয়ে পর্যটনশিল্পকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে রীতিমতো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ সমুন্নত রাখতে এখানে বহুতল আবাসিক বিল্ডিং নির্মাণ বন্ধ রাখা উচিত৷দ্বীপের শান্তিপ্রিয় ধর্মভীরু মানুষদের জন্য এর পরিবেশ সংরক্ষণ প্রয়োজন৷ তবেই এই দ্বীপটি তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে আকৃষ্ট করবে বিশ্ববাসীকে৷ আর স্বরণীয় হয়ে থাকবে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি স্বপ্নপুরী সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ৷