ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে বেড়ানোর জায়গা অগণন নয়। যেসব প্রকৃতিপ্রেমী এরই মধ্যে দেশের প্রধান প্রধান ভ্রমণ স্পটগুলো দেখে ফেলেছেন ও কম খরচে প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে আবিষ্কার করতে চান তাদের জন্য সেরা গন্তব্য হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্য।
সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সঙ্গে স্থল সীমান্ত আছে মেঘালয়ের। চোখজুড়ানো পাহাড়ি দৃশ্যাবলী আর শীতল আবহাওয়ার কারণে এই রাজ্যের রাজধানী শিলং শহরকে ডাকা হয় ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ নামে। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দেড় হাজারমিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল স্থান চেরাপুঞ্জি মেঘালয়েই অবস্থিত। মেঘালয়ের ভৌগলিক কাঠামো অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, সিকিমের গ্যাংটক ও হিমাচল প্রদেশের শিমলার মতো।
তবে উল্লেখিত স্থানগুলোর তুলনায় মেঘালয়ে বেড়ানোর খরচ তুলনামূলক কম। মেঘালয়ের ঘন সবুজ বনভূমি, চমৎকার পাহাড়ি দৃশ্যাবলী, আকর্ষণীয় লেকসমূহ, নদী অববাহিকা আর বিচিত্র প্রজাতির পশুপাখি সবকিছুই এককথায় অসাধারণ।
কীভাবে যাবেন?
মেঘালয়ে যেতে হলে আপনাকে আগে সড়ক, রেল কিংবা আকাশপথে সিলেট শহরে পৌঁছতে হবে। শহরের দরগাহ গেইট ও অন্যান্য জায়গায় বিভিন্ন বাজেটের আবাসিক হোটেল পাবেন। শহর থেকে তামাবিল চেকপোস্টে যাওয়ার জন্য কার কিংবা মাইক্রোবাস পাবেন।
কারের জন্য ২,০০০ ও মাইক্রোবাসের জন্য ৩,০০০ টাকা লাগতে পারে। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ুন। প্রায় ৫৪ কিলোমিটার দূরের তামাবিল চেকপোস্টে পৌঁছতে ৪৫-৫০ মিনিটের মতো লাগতে পারে। এরপর তাড়াতাড়ি কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে ফেলুন।
জিরো লাইন পেরিয়েই পাবেন ভারতীয় কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন অফিস। সুসজ্জিত ও পরিপাটি অফিসে আপনার কাজ শেষ হয়ে যাবে একটু দ্রুতই। দুই কিলোমিটার দূরের ডাউকি বাজারে যেতে পারেন ট্যাক্সিতেই। ডাউকি থেকেই একটি কার অথবা জিপ রিজার্ভ করতে পারেন শিলং যাওয়ার জন্য।
কারের জন্য ২,৫০০ ও জিপের জন্য ৩,৫০০ রুপি লাগতে পারে। পাবলিক পরিবহনও আছে তবে তা আরামদায়ক হবে না। দুপুর ১২টার মধ্যেই রওনা হওয়া উচিত কারণ, সূর্যাস্তের পর ডাউকি-শিলং রুটে যানবাহন প্রায় চলেই না।
ডাউকি থেকে শিলংয়ের দূরত্ব আনুমানিক ৮৩ কিলোমিটার ও প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই ভ্রমণ আপনার জন্য উপভোগ্যই হবে। রাস্তার দু’পাশেই দেখবেন ঘন সবুজ পাহাড়, ঝরনা আর বিশালাকৃতির সব প্রস্তুরখণ্ড।
যাত্রা শুরুর ২০ মিনিট পরই দেখবেন আশপাশে মেঘের ওড়াওড়ি। পিনুরসলা ও লাইলিংকট নামে দুটি বাজার পড়বে যাত্রাপথে। তবে এগুলোতে নেমে কিছু খাওয়া বা পান করা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
হাতে সময় থাকলে ডাউকি বাজার থেকে ৮/১০ কিলোমিটার দূরে দেখে নিতে পারেন এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাউলিনং, কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানির উমগট নদী ও দৃষ্টিনন্দন গ্রাম স্নোনেংপেডেং।
শিলংয়ে পৌঁছানোর পর কী করবেন?
বাংলাদেশে থাকতেই ইন্টারনেটে কোনো হোটেল বুকিং করলে খুব ভালো হবে। তুলনামূলক কমদামের হোটেলগুলো শহরের প্রাণকেন্দ্র পুলিশ বাজারে অবস্থিত।
হোটেল সেন্টার পয়েন্ট, হোটেল মিকাসা, হোটেল জে.কে. ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল বুলভার্ড, ইডেন রেসিডেন্সি, হোটেল অ্যাম্বাসি, হোটেল পাইনবোরো, হোটেল ব্রডওয়ে প্রভৃতি পুলিশ বাজারের সুপরিচিত হোটেল।
পুলিশ বাজারের বাইরে ভালো হোটেল হলো হোটেল পাইনউড, হোটেল অর্কিড, হোটেল পলো টাওয়ার্স, হোটের পেগাসাস ক্রাউন, হোটেল আলপাইন কন্টিনেন্টাল, দ্য ম্যাজেস্টিক হোটেল, আশুতোষ ইন, হোটেল ইয়ালানা প্রভৃতি।
আপনার সঙ্গে থাকা ইউএস ডলার ভাঙিয়ে ভারতীয় রুপি করার ব্যাপারে হোটেল রিসেপশনের সাহায্য নিতে পারেন। অনেক হোটেলই আকর্ষণীয় জায়গাগুলোতে প্যাকেজ ট্যুরের সুবিধা দিয়ে থাকে।
শিলং শহর ও তার বাইরের আকর্ষণীয় সব জায়গা ঘুরে দেখতে হলে আপনাকে অন্তত দু’দিন সেখানে অবস্থান করতে হবে।
মেঘালয়ের জনপ্রিয় গন্তব্যসমূহ কোনগুলো?
শিলং পিক ও সোহপেতবিনেং পিক
জায়গা দুটি শিলং শহর থেকে যথাক্রমে ১০-২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শহরের উচ্চতম স্থান শিলং পিক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৯৬১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে ঘন সবুজ বনানী এটিকে এক আদর্শ পর্যটন স্পট বানিয়েছে।
পাখির চোখে গোটা শিলং শহরকে দেখতে পারবেন এখান থেকে। সোহপেতবিনেং পিকের উচ্চতা ১ হাজার ৩৪৩ মিটার। খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও ভই সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি তীর্থস্থান।
ওয়ার্ডস লেক ও উমিয়াম লেক
ওয়ার্ডস লেক একটি কৃত্রিম লেক ও এটির অবস্থান শিলং শহরের মধ্যেই। এটি পলক লেক নামেও পরিচিত। বিচিত্র সব রংয়ের ফুল ও পাইন গাছ হলো ১০০ বছরের পুরনো লেকটির প্রধান আকর্ষণ।
চোখজুড়ানো উমিয়াম লেক শিলং শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে। এটির আরেক নাম বড়পানি লেক। নৌকা বাওয়া, নৌকা চড়া, স্কিয়িং প্রভৃতি সুবিধাদি থাকায় জলক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে লেকটি এক চমৎকার জায়গা।
ঝরনাসমূহ
হ্যাপি ভ্যালিতে অবস্থিত সুইট ফলস হলো মেঘালয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঝরনাগুলোর একটি। শিলং শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রেংথিয়াম ফলস একটি ফিতাসদৃশ ঝরনা।
সুনা ভ্যালিতে অবস্থিত বিশপ ও বিডেন ফলস হচ্ছে আরও দুটি নজরকাড়া ঝরনা। এলিফ্যান্ট ফলস ও স্প্রেড ঈগল ফলসও সৌন্দর্যের বিচারে পিছিয়ে নেই। তবে সবগুলো দেখার মতো সময় না থাকলে বেছে নিন এলিফ্যান্ট ফলসকেই।
পার্কসমূহ
সারা মেঘালয় রাজ্য জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পার্ক। তবে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে শিলং শহরে অবস্থিত লেডি হায়দারী পার্কেই। রাজ্যের প্রথম লেডি ও আসামের গভর্নরের স্ত্রী হায়দারীর নামেই নামকরণ করা হয়েছে পার্কটির।
এক কিলোমিটারের বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত পার্কটিতে দেখা মিলবে ৭৩ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির সরীসৃপ, ভালুক, লোপার্ডসহ আরও বন্যপ্রাণীর। এর পাশাপাশি বিপুল প্রজাতির ফুল ও বৃক্ষরাজি তো আছেই। মেঘালয়ের অন্যান্য পার্কগুলোর মধ্যে আছে চেরাপুঞ্জির থাংখারাং পার্ক ও ইকো পার্ক, রি ভই জেলার নেহেরু পার্ক, খারাসাতি পার্ক, থ্রিলস ফান পার্ক ও জৈন্তিয়া হিলস জেলার লালং পার্ক ও লুকসি (কুলপি) পার্ক।
শিলং গলফ কোর্স
ছবির মতো সুন্দর শিলং গলফ কোর্স ভারতের মধ্যে তৃতীয় প্রাচীনতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলফ এসোসিয়েশন ও জাদুঘর একে ‘গ্লেনঈগল অব দ্য ইস্ট’ হিসেবে গণ্য করে।
১৮৮৯ সালে নয় হোলের গলফ কোর্স হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ১৯২৪ সালে ক্যাপ্টেন জ্যাকসন ও সি.কে.রোডস এটিকে ১৮ হোলে রূপান্তর করেন।
পাইন ও রডোডেনড্রন গাছে আচ্ছাদিত এক উঁচু-নিচু উপত্যকায় অবস্থিত গলফ কোর্সটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
উপরোক্ত স্থানগুলো ছাড়াও দেখার মতো কয়েকটি জাদুঘর আছে শিলং শহরে। এগুলো হলো ডন বসকো মিউজিয়াম, এয়ার ফোর্স মিউজিয়াম, বাটারফ্লাই মিউজিয়াম ও ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন সাংমা স্টেট মিউজিয়াম।
চেরাপুঞ্জি
চেরাপুঞ্জির অবস্থান শিলং শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে আর্দ্র স্থান হিসেবে পরিচিত। এক বছরে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের হিসেবে চেরাপুঞ্জি ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’এর অন্তর্ভুক্ত।
চমৎকার সব উপত্যকা ও নদী চেরাপুঞ্জির সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। সারা বছরই ভ্রমণ করা যায় জায়গাটিতে। শিলং থেকে সকালে কার কিংবা পাবলিক বাসে চেরাপুঞ্জি গিয়ে আবার বিকেলে ফেরা সম্ভব।
আর যদি আকর্ষণীয় সব জায়গা ভালোভাবে ঘুরে দেখতে চান তাহলে একরাত থাকতে পারেন। চেরাপুঞ্জি হলিডে রিসোর্ট, কনিফেরাস রিসোর্ট, পলো অর্কিড রিসোর্ট, সোহরা প্লাজা, হালারি রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড লজিং প্রভৃতি প্রস্তুত আপনাকে উষ্ণ আতিথেয়তা দিতে।
কেভস বা গুহাসমূহ
খাসি হিলস, জৈন্তিয়া হিলস ও গারো হিলসের গুহাগুলো মেঘালয়ে যাওয়া পর্যটকদের জন্য এক বিশেষ আকর্ষণ। মৌসুমাই কেভ, ক্রেম মৌমলুহ ও ক্রেম ডেম খাসি হিলসের প্রধান প্রধান গুহা।
জৈন্তিয়া হিলসের গুহাগুলো হলো ক্রেম কটসাটি ও দ্য কেভ অব ইওসিন এজ যেগুলো অন্ধকার ও ভীতিকর। বক-বাক দোবাকল, সিজু দোবাকল ও তেরেংকল বালওয়াকল হলো গারো হিলসের দীর্ঘতম ও দুর্গম কিছু গুহা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
মেঘালয়ে আপনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও যেতে পারেন আবার সহায়তা নিতে পারেন নির্ভরযোগ্য কোনো ট্যুর অপারেটরের। দ্বিতীয়টি বেছে নিলে আপনাকে ভিসার আনুষ্ঠানিকতা, যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হবে না।
যদিও এতে খরচটা একটু বেশি পড়বে তবে আপনার ভ্রমণ হবে অনেক নিরাপদও দক্ষ ট্যুরিস্ট গাইডের সঙ্গও পাবেন। তবে নিজস্ব ব্যাবস্থাপনায় গেলে একটু সতর্ক থাকতে হবে। ভালো ইংরেজি জানলে তা খুব কাজে লাগবে কারণ, মেঘালয়ে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন আছে।
অবশ্য শিলং শহরে অনেক বাংলাভাষী লোকজনও পাবেন। হোটেল ও ড্রাইভার দুটির ক্ষেত্রেই বাঙালি ও নেপালিদের বেছে নেওয়ার ও খাসিয়াদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। হোটেল রুম ও ট্যাক্সি রিজার্ভের সময় সুনিপুণভাবে দরদাম করতে ভুলবেন না।
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সূর্যাস্তের পর বাইরে ঘোরাঘুরি এড়িয়ে চলুন। কারণ রাতের শিলং কিন্তু দিনের মতো নিরাপদ নয়। তামাবিল সীমান্তে যাওয়ার আগেই খেয়াল করে সোনালী ব্যাংকে ভ্রমণ কর পরিশোধ করুন। মার্চ থেকে অক্টোবর বিশেষ করে মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলো মেঘালয় ভ্রমণের সেরা সময়।
লেখক: সাইফুর রহমান তুহিন