ঘুরাঘুরি করতে করতে আমরা আবারো বেড়িয়ে পড়েছি, এই বাংলার রুপ গিলতে। দলবল নিয়ে আধ বাস টিম ঘুরুঞ্চি ছুটছি এবার নয় কুঁড়ি কান্দার ছয় কুঁড়ি বিল নামে খ্যাত ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে’।
রাতের বাস ঢাকার ফকিরাপুল হতে ছাড়লো যখন তখন রাত প্রায় ১টা। হাওর বাওরের দেশের পথে রুপ গিলে সুনামগঞ্জ পৌঁছেই যখন নামলাম নতুন বাস টার্মিনালে তখন প্রায় সকাল সাড়ে ৮টা।
এ যাত্রায় আমাদের এক রাত দুই দিনের জন্য আমাদের ঘাটি একদম ব্র্যান্ড নিউ হাউজবোট ‘বর্ষা’। নতুন হাউজবোট হওয়াতে একদম পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন নৌকাটি। এই নৌকায় আছে দুটো কাপল ডোর লক কেবিন।
যার প্রতিটিতেই আছে এটাচ ওয়াশরুম। এছাড়া আছে আরও ৪টি ওপেন কেবিন। যার দুটিতে ৪ জন করে আর অন্য দুটিতে ৩ জন করে বেশ আরামেই থাকা সম্ভব। আছে দুটি বড়সড় ও পরিচ্ছন্ন ওয়াশ রুম।
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আমরা ছাড়লাম বোট, ধরলাম হাওরের পথ। নৌকায় উঠেই প্রথম কাজ মূলত পেটপূজো করা। হালকা বৃষ্টি ভেজা এই সকালের খাবারের মেনুতে ছিলো খিচুড়ি, ডিম, আলুভর্তা, বেগুন ভাজি, সালাদ ও আচার।
এর পরেই ছিল ঠান্ডা ওয়েদারে ভয়পুর গরম চায়ের আয়োজন। খাওয়া দাওয়া শেষে উঠে পড়লাম ছাদে। অসাধারণ প্রকৃতি ও ওয়েদারে কি অসাধারণ অনুভুতি হচ্ছিল সবার তা বলে বোঝানো সম্ভব না।
স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি সুন্দরবন। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।
মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা (ঝরনা) এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি।
পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার ও বাকি অংশ বসতি ও কৃষিজমি। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির।
শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে কান্দা জেগে উঠলে শুধু কান্দার ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবি শস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন।
এ সময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরা।
ঘুরতে ঘুরতেই চলে আসলাম আমরা টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারে। মূলত বার্ডস আই ভিউ’তে হাওর দেখা আর হাওরের স্বচ্ছ পানিতে জলকেলি করার জন্য সবথেকে সেরা স্থান এই ওয়াচ। টিম ঘুরুঞ্চি আমরাও ব্যাতিক্রম নই, তাই দলবল পাকিয়েই নেমে পড়লাম পানিতে।
ওয়াচ টাওয়ারে ভরপুর মজা করে ধরলাম পথ ট্যাকেরঘাট। একই সঙ্গে শুরু করলাম দুপুরের খাবারের আয়োজনের। এই বেলায় ভাতের সঙ্গে হাওরের মাছ, দেশি মুরগির মাংস, চ্যাপা শুটকির ভর্তা, ডাল-সালাদ আর আয়োজন।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। তবে পাখি দেখতে চাইলে শীতকালেই যেতে হবে আপনাকে। গল্প, গান ও আড্ডায় দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। আর আমরা এসে পৌঁছালাম ট্যাকের ঘাটে। এখানেই আছে বিখ্যাত শহীদ সিরাজ লেক। যা কিনা আপনারা নীলাদ্রি লেক নামেই চিনে থাকেন মূলত।
এই লেক মূলত চুনাপাথরের খনি ছিল। এখান থেকেই উত্তোলিত হতো চুনাপাথর। সেই চুনাপাথরের পরিত্যক্ত কুয়ারিজ আজ লেক। এই লেকের গভীরতা প্রায় ৩০০-৪০০ ফিট। তাই এই লেকে নামার আগে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন।
হাতে সময় কম, যাওয়া উচিত লাকমাছড়ায় যা কিনা মূলত বিছানাকান্দির লাইট বলতে পারেন। তাই অটো নিয়েই ছুটলাম সবাই লাকমাছড়ায়। মেঘালয়ের পাহাড় পেরিয়ে অস্থির বেগে ছুটে আসা শীতল পানির স্রোত আর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের মাঝে সন্ধ্যে হওয়া সে এক অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য।
সন্ধ্যায় ফিরলাম বোটে। সন্ধ্যায় ছিলো ফ্রেন্স ফ্রাই, আর ঝালমুড়ি সঙ্গে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের আয়োজন। রাত যখন প্রায় ৯টা বোট নিয়ে চলে গেলাম হাওরের খানিক মাঝে। রাতে সেখানেই থাকার পালা। রাতের আয়োজনে হাওরের হাঁস, মাছের মুড়িঘণ্ট, ডাল, সবজি ও সালাদের ভরপুর ডিনার। গল্প গানে আড্ডার মুখোর হয়ে অপেক্ষা করালাম সকাল হওয়ার।
মাঝ রাত হতেই মুষলধারে বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টিতেই ভোর ৬টায় আমরা বোট ছাড়লাম, ধরলাম শিমুল বাগানের পথ। সকাল প্রায় ৯টায় পৌঁছালাম শিমুল বাগান। এর মাঝেই সকাল হয়ে গেলে আগের দিনের মতোই খিচুড়ির আয়োজন। সঙ্গে গরম চা গিলতে গিলতে একটু আলসেপনা যেন ঘিরেই ধরেছিল সবাইকে।
একদল বেড়িয়ে পড়লো বৃষ্টিতে ভিজেই শিমুল বাগান দেখতে আর আমরা কিছু অভাগা বসলাম অফিসের ট্রেইনিংয়ে। শিমুল বাগান ঘুরেই মূলত গেলাম যাদুকাটা নদীর চড়ে। আর সেখানেই নেমে পড়লাম ফুটবল খেলতে আর নদীতে গোসল করতে। যাদুকাটা নদী ঘুরে ছুটলাম বারেক টিলার উদ্দেশ্যে।
বারেক টিলা (যা বারিক্কা টিলা, বারেকের টিলা নামেও পরিচিত) সবুজে মোড়া উঁচু টিলার একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে স্বচ্ছ জলের নদী। টিলার ওপর দাঁড়ালে হাতছানি দেয় মেঘ-পাহাড়। এর অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের লাউড়েরগড় এলাকায় ভারত সীমান্ত ঘেঁষে।
ভারতের পাহাড়ে আছে একটি তীর্থস্থান ও মাজার। বছরের নির্দিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন দিনে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার হাজার লোক জড় হয় পূণ্যস্নান ও উরসে, তখন ২-১ দিনের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করা হয়।
এই বারেক টিলাতে আছে ৪০টির মত আদিবাসীদের পরিবার। এই এলাকায় ৩৬৫ একর জায়গাজুড়ে আছে রং-বেরঙের নানা প্রজাতির গাছপালা। বারেক টিলা ঘুরে আবার নৌকায় আমরা, আজ দুপুরের আয়োজন দেশি মুরগির মাংস, ছোট মাছ, ডাল, সবজি ও সালাদ।
কীভাবে যাবেন?
টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়া যায় মূলত দুইভাবে, একটি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ হয়ে আরেকটি সুনামগঞ্জ জেলা হয়ে। প্রতিদিন ঢাকা থেকে এনা মামুন ও শ্যামলী পরিবহণের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। এসব বাসে নন-এসিতে জনপ্রতি টিকেট কাটতে ৭৫০-৮৫০ টাকা লাগে। আর সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে।
যদি চান সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাবেন সেক্ষেত্রে সিলেটের কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লোকাল ও সিটিং বাস আছে। সুনামগঞ্জ যেতে ২ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
বর্ষায় সুনামগঞ্জ শহরের একদম কেন্দ্রের সাহেববাড়ি ঘাট হতেই ছাড়ে মূলত হাউজবোটগুলো। আর যদি যেতে চান মোহনগঞ্জ হতে তবে আসতে হবে ট্রেনে, মোহনগঞ্জ দিয়ে তুলনামূলক কম খরচে ঘুরে আসা যায় টাঙ্গুয়ার হাওর।
মোহনগঞ্জ দিয়ে যেতে চাইলে ট্রেনে বা বাসে মোহনগঞ্জ এসে সেখান হতে সিএনজি বা লেগুনায় মধ্যনগর ঘাট। আর সেখান হতেই যেতে পারবেন টাঙ্গুয়ার হাওরে।