1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ পূর্বাহ্ন

মধ্যপ্রাচ্য থেকে টরন্টো

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

প্রথম আমার সংসার শুরু করেছিলাম মধ্য প্রাচ্য থেকে। দেশ ছেড়ে বিদেশে বসবাস করবো সে চিন্তা বা কল্পনা আমার কখনো ছিলো না। আর মধ্য প্রাচ্যে ? সে কথা স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি কিন্তু ভাগ্য চক্রে সেখানেই শুরু করতে হয়েছিলো আমার সংসার জীবন। মধ্য প্রাচ্য মানে মরুভুমি, খেজুর গাছের সারি, উট হেঁটে বেড়াচ্ছে । জুব্বা পরা লোকজন বোরখা পরা মহিলারা এতোটুকুই আমার জ্ঞান ছিলো মধ্য প্রাচ্য ঘিরে। আর সৈদী আরবে সারা বিশ্বের মুসলীম ধর্মাবলম্বীরা যান হজ্জ করতে। কাজ নিয়েও অনেকে যায় মধ্য প্রাচ্যে , এতোটুকুই ছিলো আমার জ্ঞানের পরিধি। তার মাঝে আমিও যে একজন হবো সে কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমি তরুণী মেয়েটি কখনো ভাবিনি ।

আমার স্বামী আমেরিকার একটি নাম করা ইঊনিভারসিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ P h D degree নিয়ে আসলেন ইরাকের বসরা ইউনিভারসিটির প্রফেসর হয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো দু চার বছরের মধ্যে মধ্য প্রাচ্যের মোটা অংকের কিছু টাকা জমিয়ে দেশে ফিরে যাবেন । সেখানেই ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভারসিটিতে শিক্ষকতা করবেন। চাকুরিতে যোগদান করে দেশে গিয়েছিলেন বিয়ে করতে। তখনি আমি তাঁর বিয়ের ফাঁদে আটকে পরে তাঁর স্ত্রী হয়ে গেলাম।

বিয়ের পাঁচ দিন পর আমার স্বামী আমার সাথে মধু চন্দ্রিমা করতে নিয়ে আসলেন দিল্লি আর আগ্রাতে। দিল্লি শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে আমরা এলাম আগ্রাতে তাজমহল দেখতে। যমুনার জলে জ্যোৎস্নার আলোয় আপ্লূত হয়ে আমাদের মধু চন্দ্রিমা হোল

মধু চন্দ্রিমা শেষ করে আমার স্বামী চলে গেলেন তাঁর কর্ম স্থলে তার কয়েকমাস পর আমি যোগ দিলাম তার সাথে।” বসরাই গোলাপ” নাম শুনেছি অনেক এখন সে গোলাপ দেখতে পাবো নিজের চোখে সে উত্তেজনা ছিলো মনের ভিতর। ইরাকের সামাজিক জীবন সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্র ধারনা ছিলো না। আমার স্বামীর চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম ওখানে এবং বসরাতে অনেক বাঙালি আছে বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ার দের অনেক পরিবার তাছাড়া বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছে বসরার বাঙালি সমাজ। তিনি এও জানিয়েছিলেন খুব বেশী আশা করে এসো না। মুগ্ধ হবার মতো দেশ কিংবা মুগ্ধ হবার মতো শহরও এই বসরা শহরটিও না। তবে অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে দেখার মতো । তুমি আসো তখন দেখা যাবে সব। তাছাড়া আমরা তো এখানে বহু বছর থাকতে আসিনি দু তিন বছরের ব্যাপার ।

আমি যথা সময়ে সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি বলে মন খারাপ করে রওয়ানা হলাম প্রবাসে। প্লেন নামলো ইরাকের রাজধানী বাগদাদ এয়ার পোর্টে । সেখানে আমার স্বামী আসলেন আমাকে নিতে। আমরা বাগদাদ একরাত হোটেলে থেকে পরদিন বসরার ফ্লাইট নিলাম। আমার স্বামী থাকে ইউনিভাসিটি কোয়াটারে । এই কোয়াটার গুলো বিদেশী শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ ছিলো। সেখানে আমার জীবনের প্রথম সংসারে আমি ঢুকলাম । খুব উন্নত মানের না হলেও মোটামুটি গোছের আসবারপত্র দিয়ে বাসাটা সাজানো । আমার তেমন মন খারাপ হোল না যতোটা আমার স্বামী ভেবেছিলেন। স্বামীর কাছে এসেছি সংসার করতে সে আনন্দটা আমাকে অন্য কিছু ভাবার সময় দিলো না। সে বিলডিংয়ে আরো দুটু বাঙালি পরিবার আছে জেনে স্বস্থি পেলাম যাক এখানে আমি একা নই।

আমি রান্না বান্নার ব্যাপারে মোটেও পটু ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে গেলে একেবারেই অপটু ছিলাম। আমি যখন প্রথম বসরা শহরে আসলাম তার কদিন পরেই ছিলো ঈদ। আমার বোনেরা আম্মাকে বললো , আম্মা ওকে অন্তত সেমাই রান্নাটা শিখিয়ে দাও। তানাহলে ঈদ এর দিন জামাইকে সেমাই রান্না করেও খাওয়াতে পারবে না। আম্মা মুখে মুখে আমাকে সেমাই জর্দা রান্না শিখিয়ে দিলেন। আর সাথে দিয়ে দিলেন একটা বাংলাদেশি রান্নার বই। কিন্তু ঈদ এর দিন আমরা স্বামী স্ত্রী মিলে ভালোই রান্না করেছিলাম রান্নার বই দেখে তাছাড়া ও মোটা মোটি ভালই রান্না করতো , এতদিন দেশের বাইরে থেকে পড়াশুনা করেছে বলে।

আমার স্বামী কয়েকদিন ছুটি নিয়েছিলো আমি যেনো একা অনুভব না করি। সে কয়েকদিন আমাকে এলাকাটা চিনালো । বেশ কাছেই একটা সপিং সেন্টার ছিলো সেখানেও আমাকে একদিন ঘুরিয়ে আনলো । আমাদের বিল্ডিং এর অন্য দুইটা পরিবারের সাথে পরিচয় হোল । দুই রাত দুই পরিবারের বাড়ীতে দাওয়াত খেলাম। ভাল লাগলো ওনাদের সাথে পরিচয় হয়ে। উনারা কয়েকবছর থেকে আছেন এখানে আর আমি নতুন বউ। বেশ আন্তরিকতার সাথে উনারা আমাকে গ্রহন করলেন। যে কোন প্রয়োজনে যেনো উনাদের মনে করি সেটাও বললেন।

ইরাকে তখন প্রেসিডেন্ট হাসান আল বকর ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিলেন । ক্ষমতায় এসেছিলেন একনায়কত্বে বিশ্বাসী ডিক্টেটর সাদ্দাম হোসেইন । তার বিরোদ্ধে কথা বলার সাহস করো ছিলো না। তার মতের অমত করা মানেই মৃত্যু । আমরা যেহেতু বিদেশী আমাদের এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোন ব্যাপার ছিলো না।

বসরা শহরকে দুই ভাগ করে মাঝ খানে বয়ে গেছে ‘সাতেল আরব নদী ‘। নদীর একপাড়ে ইউনিভারসিটি অন্য পারে প্রফেসরদে কোয়াটার । ফেরি দিয়ে নদী পাড় হতে হতো এপার থেকে ওপারে যেতে । দুই পাড়েই ছিলো জনবসতি। বাঙালীরাও দুই পাড় মিলিয়েই থাকতো । ইরাক দেশটিতে কোন ঝল মলে ভাব ছিলো না। প্রচুর সম্পদ দেশটিতে থাকা সত্বেও সাধারন মানুষের ভোগের ক্ষমতা ছিলো না। সমস্থ ক্ষমতা ছিলো সাদ্দাম হোসেন ও বাত পার্টির হাতে। বসরা শহরটিকে দেখলে মনে হতো মধ্য বিত্ত পরিবারের টানা পোড়ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেখানকার মানুষরা ছিলো অত্যান্ত ভদ্র সভ্য । মেয়েরা খুব আধুনিক ভাবে চলাফেরা করতো । কলেজ ইউনিভারসিতে পড়া শুনা করতো ।

ইরাকের লোকেরা শিক্ষকদের অত্যান্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতো । তবে সে দেশে বাক স্বাধীনতা বলে কোন জিনিষ ছিলো না। সেখানে বিরোধী দল বলে কিছু ছিলো না। কারো যদি রাজনীতি নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে থাকতো , তাহলে দরজা জানালা বন্ধ করে গোপনে হয়তো বলতো । সাদ্দামের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাকে পৃথিবীর মায়া কাটাতে হতো । তার বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে ধরে নিয়ে কান কেটে দিয়েছে সে কথাও বহুল প্রচলিত ছিলো । ইরাকে মুসলিমরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো , শিয়া এবং সুন্নি ।ইরাকের দক্ষিণ অংশে প্রধানত শিয়া এবং পশ্চিম অংশে সুন্নিরা বসবাস করতো । সাদ্দাম নিজে সুন্নি ছিলেন বলে শিয়াদের উপর অনেক নির্যাতন চালানো হতো । কোন ভালো সরকারি কাজে তাদের নিয়োজিত করা হতো না।

দেখতে দেখতে আমার স্বামীর কয়েকদিনের ছুটি ফুরিয়ে গেলো । সে সকাল আটটায় কাজে যায় আর ফিরে আসে বিকেল পাঁচটায় । আমি সারাদিন একা বাড়িতে নিঃসঙ্গ সময় কাটাই । দেশের জন্য বুক খা খা করে। সবার কথা মনে করে চোখ গড়িয়ে পানি পরে। আমাদের বিল্ডিং একজন মহিলা যিনি আমার চাইতে খুব বেশী বড় হবেন না। তিনি মাঝে মাঝে এসে গল্প করে যেতেন । উনাদের তিন বছরের একটি ফুটফুটে ছেলে ছিলো । উনার নাম ছিলো জেসমিন । জেসমিন ভাবী এদেশের নিয়ম কানুন, কোথায় কেনা কাটা করার ভালো জায়গা , কোথায় কোন জিনিষ ভালো পাওয়া যাবে সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন। আমরা দুই পরিবার একসাথে বাঙালী দের বাসায় বেড়াতে যেতাম । যেহেতু আমি নতুন বউ সবার খুব আগ্রহ ছিলো আমাকে দেখার। উনারাই আমাদের নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

দেশে সবাইকে চিঠি লিখি সময় কাটাবার জন্য। সে সময় ইরাকে আমাদের কারো বাড়ীতে টেলিফোন ছিল না। বড় বড় ইরাকিদের বাড়ীতে ছিলো । যার ফলে চিঠি ছিলো আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। টিভি তে সারাদিন আরাবিক নাচ গান নাটক এসব চলতো । তবে ইংরাজি সিরিয়াল হতো বেশ কিছু, যেমন, eight is enough, full house, Walton. বাচ্চাদের ইংরেজি কার্টুন ও দেখানো হতো । আরো অনেক সিরিয়াল দেখাতো টিভিতে এতো আগের সব কিছু মনে নেই।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com