দার্জিলিং জমজমাট গল্পে প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে লালমোহনবাবুর মাথা খারাপ দশা। তোপশের ঘুম ভাঙিয়ে জানালার সামনে দাঁড় করিয়ে উচ্চকণ্ঠে লালমোহনবাবুর এথিনিয়াম ইন্সটিটিউটের শিক্ষক বৈকুন্ঠ মল্লিকের লেখা এই অদ্ভুতুড়ে কবিতাটা আবৃত্তি করলেন তিনি। প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আমার নিজের কেমন লেগেছিল সেই গল্প বলবার জন্যই এই লেখা। আজকালকার দিনে কোথাও কিভাবে বেড়াতে যাওয়া যায়, কোথায় থাকা যায়, কী খাওয়া যায় এসব নিয়ে বিস্তর ইউটিউইব ভিডিও, ফেসবুক পোস্ট, ইত্যাদি সবকিছু সুলভ হয়ে গেছে। এই লেখাটায় তাই এসব টেকনিক্যাল ডিটেইল কিছুটা হয়ত কম থাকবে, একেবারেই যে থাকবে না তা বলছি না, তবে এটা হবে মূলত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। এই গল্পে আমার সঙ্গী আমার সহধর্মিনী বহ্নি, ভ্রমণ জুটি হিসেবে যার তূলনা নেই। তাই তার নামটা গল্পে মাঝেমাঝেই উচ্চারিত হবে।
দার্জিলিং আমার অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। হঠাৎ করে ঘাড়ের উপর এসে পড়া এই প্যান্ডেমিকটা শেষ হবার পর প্রথম সুযোগ পেলেই যে জায়গাটাতে আমি চলে যেতে চাইব, সেটা হচ্ছে দার্জিলিং। সম্পূর্ণ অদেখা এই জায়গাটার প্রতি আকর্ষণ জেগেছিল সেই ছেলেবেলায়, যখন ‘সেরা সন্দেশ’-এ ফেলুদার প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ পড়ি। কোন এক সুনসান দুপুরে, আমার মা যখন সবার খাবার পাট চুকিয়ে সানন্দা পত্রিকাটায় চোখ বুলোচ্ছেন, মা’র পাশে উপুড় হয়ে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে আমি তখন ফেলুদা পড়তে পড়তে কল্পনায় চলে গেছি অনেক দূর। ম্যালের বেঞ্চে বসে রোদ পোহাচ্ছি, অবজার্ভেটরি হিলে বৈকালিক ভ্রমণ করছি, পাইন বনের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছি, কিংবা কিচ্ছু না করে হাঁ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছি।
ঘটনার শুরু ২০১০ সালে। প্রতি বছর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়। কক্সবাজার অনেকবার যাওয়া হয়েছে। সেন্ট মার্টিনেও যাওয়া হয়েছে। ইংরেজ রাজধানী কোলকাতা, মোগল রাজধানী দিল্লী, রাজপুত রাজধানী জয়পুর দেখা হয়ে গেছে। সে বছর ভাবলাম দার্জিলিং গেলে কেমন হয়? এতো হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিলাম আর ঘর-হতে-শুধু-দুই-পা-ফেলিয়া এই জায়গাটা এখনো দেখিনি কেন? দার্জিলিং অবশ্য মোটেও ঘর থেকে দু’ পা ফেললেই যাওয়া যায় না। তবে কিনা অন্য যেসব জায়গায় ঘুরেছি তার তূলনায় তো অনেক কাছে। আমার একটা ব্যাপার হলো, কোথাও বেড়াবার প্ল্যান মাথায় এলে যতদিন না সেখানে যাওয়া হচ্ছে ততদিন অস্থির লাগতে থাকে। সময় যত ঘনিয়ে আসে, অস্থিরতা তত বাড়ে। জানুয়ারি মাসে দার্জিলিং যাবার প্রস্তাবটা উত্থাপন করলাম বহ্নির কাছে। বহ্নি লাফিয়ে উঠল। বলল, চলো যাই। ছেলেবেলা থেকে আমার প্রবল দার্জিলিং প্রীতির কথা সে ভাল করেই জানে। ব্যাস, আমার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেল। পেটের ভেতর চেনা সেই গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল। সব দিক চিন্তা করে ঠিক করলাম নভেম্বরে যাব।
প্ল্যান মাফিক এরপর শুরু হয়ে গেল আমাদের রুটিন কাজকর্ম। যে কাজটা আমি আর বহ্নি সবসময় করে থাকি সেটা হলো, কোথাও যাবার আগে জায়গাটা সম্পর্কে ভালোমতো পড়াশোনা করা। এতে দু’টো সুবিধা হয়। প্রথমত, একটা জায়গার ইতিহাস জানা থাকলে জায়গাটার সাথে কানেক্ট করা যায়, অনেক কিছুর মানে বোঝা সহজ হয়, বেড়িয়েও আনন্দ পাওয়া যায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, হারিয়ে যাবার ভয় থাকে না, কোথাও ঠকে যাবার সম্ভাবনাটাও যায় কমে। কোন জায়গা নিয়ে সামান্য পড়ালেখাও অনেক সময় খুব কাজে দেয়। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, আগ্রার তাজমহল আমরা সবাই ঘুরতে যাই। কিন্তু ক’জন জানি যে মমতাজের আসল নাম ছিল আরজুমান্দ বানু বেগম? তাজমহলে হাঁটতে হাঁটতে হয়রান হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কেন হয়রান হই জানি কি? তাজমহলের পুরো জায়গাটার আয়তন এক লক্ষ সত্তর হাজার বর্গমিটার। ভাবা যায়? যেকোন জায়গা নিয়ে ইন্টারেনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য আমার কিছু পছন্দের ওয়েবসাইট আছে। একটা হচ্ছে ট্রিপ অ্যাডভাইজর (tripadvisor.com), আর একটা হচ্ছে উইকিপেডিয়া (wikipedia.com)। ট্রিপ অ্যাডভাইজরের ফোরামগুলো খুবই ভাল। এদের দার্জিলিং ফোরামে ঢুকে দেখা শুরু করলাম নভেম্বরে যেতে গেলে কী কী প্রিপারেশন আমাকে নিতে হবে। কী ধরণের জামাকাপড় নিতে হবে, কোন বিশেষ ওষুধ সাথে রাখতে হবে কি না, কোন্ রেস্টুরেন্টটা কোন্ ধরনের খাবারের জন্য ভালো, কী কী দেখবার আছে দার্জিলিং এ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া হোটেল বুকিংয়েরও ব্যাপার আছে। আমরা আর যাই হোক ব্যাকপ্যাকার না।
আমরা ঘুরতে পছন্দ করি রিল্যাক্স করার জন্য, অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য না। যারা অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য ঘোরে তাদেরকে আমি বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। কিন্তু আমার নিজের সেই বয়স আর নেই। তাই কোথাও গেলে আগে থেকে হোটেল বুক করে যাওয়াটাকে দরকারি মনে করি। তবে যে সময়কার গল্প, তখন তো আর হোটেল বুকিংয়ের জন্য অমুক ডট কম, তমুক ডট কম ছিলনা, সরাসরি হোটেলের সাথেই যোগাযোগ করতে হতো। আমরা প্ল্যান করলাম কলকাতা যাব এয়ারে। সেখান থেকে বিখ্যাত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চড়ে শিয়ালদা থেকে সোজা নিউ জলপাইগুড়ি। ভারতীয় ট্রেনের টিকিট কিভাবে কাটব এটা ভেবে ভেবে যখন হয়রান হচ্ছি, তখন এক কলিগ বলল, ঢাকা থেকেই ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলোনা কেন? আমি অবাক হলাম। ঢাকা থেকেই কলকাতার ট্রেনের টিকিট কাটা যায়? কলিগ খোঁজ দিলেন এক ট্রাভেল এজেন্টের। গুলশান-১ শুটিং ক্লাবের উল্টোদিকের গলিতে ছোট্ট একটা অফিস। গেলাম একদিন সেখানে। টেবিলের অন্যপাশে ফর্সা করে নাদুস নুদুস চেহারার এক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। একগাল পান মুখে নিয়ে হাসিমুখে আমাকে বললেন, কি দরকার বলেন তাড়াতাড়ি। মাহফুজ ভাইয়ের সাথে সে-ই আমার প্রথম পরিচয়। তখনও কি জানি এই মাহফুজ ভাই-ই হয়ে উঠবেন আমার এবং আমার পরিচিত আরো অনেকের টিকিট মাস্টার?
মাহফুজ ভাই জানতে চাইলেন, কবে যেতে চাই কলকাতা থেকে দার্জিলিং। নভেম্বরে যেতে চাই শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, এটা কি মাস বলেন? বললাম এপ্রিল। তিনি বললেন, নভেম্বরের ট্রেনের টিকিট তো এখনও ওপেন হয়নি। আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম। তিনি বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটা। বললেন, কোন একটা নির্দিষ্ট তারিখের ইন্ডিয়ার ট্রেনের টিকিট সেই তারিখের দুই মাস আগে পাওয়া যায়। তার আগে টিকিট “ওপেন” হয় না, অর্থাৎ কাটার জন্য এভেইলেবল হয় না। বলেই তিনি আমাকে তার কম্পিউটারের মনিটরটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন, এই যে দেখুন, এটা ইন্ডিয়ান রেইলওয়ের ওয়েব সাইট। আপনি চাইলে নিজেই বাসা থেকে চেক করতে পারবেন সবকিছু। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে এই ওয়েব সাইট থেকে দুটো স্টেশনের মধ্যবর্তী ট্রেন (Train Between Important Stations) দেখা যায়। কিভাবে ট্রেনের ক্লাস সিলেক্ট করতে হয়, কিভাবে ভাড়া দেখতে হয়।
আমি অবাক হয়ে মাহফুজ ভাইকে দেখছিলাম। মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে তার সাথে আমার পরিচয়, অথচ এমনভাবে কথা বলছেন যেন কত দিনের চেনা! গল্পচ্ছলে জানলাম, তার এই কোম্পানি তিনি দিয়েছেন আশির দশকে। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের একেবারে প্রথম দিককার ট্যুরিজম কোম্পানি। সেই থেকে মাহফুজ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় শুরু। শুধু আমার না, আমার পরিচিত আরো অনেকের। কোন জায়গার প্লেন কিংবা ট্রেনের টিকেট কাটা দরকার? ধর মাহফুজ ভাইকে। কোন একটা ট্যুর প্ল্যান করা দরকার? ফোন দাও মাহফুজ ভাইকে। মাঝখান দিয়ে কিছুদিন যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। অফিসের প্রয়োজনে কিছুদিন ছিলাম দেশের বাইরে। ফিরে এসে একদিন ফোন দিতেই দেখি অন্য একজন লোক ফোন ধরেছে। মাহফুজ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন, মাহফুজ ভাই মারা গেছেন। ক্যান্সারে। আমি স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। মনে পড়ে গেল তার সেই দুই আঙ্গুলে বড় সাইজের একটা পান গালে পুরে দিয়ে হাসি মুখে বলা, কি দরকার বলে ফেলেন তাড়াতাড়ি। এই হাসিমুখ টা আর দেখতে পারবনা কোনদিন।
২০১০ সালের ২৫শে নভেম্বর। জেট এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৩৭ এর 9W273 ফ্লাইটটা মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে চলেছে ঢাকা থেকে কলকাতা। ক্যাপ্টেনের ঘোষণা শোনামাত্রই বহ্নি আর আমার দু’জনেরই দাঁত বের হয়ে গেল। বাহ্, এত দ্রুত কলকাতা চলে আসা যায়! মজার ব্যাপার হল ঢাকায় যখন আমরা প্লেনটিতে উঠি তখন বাজে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কলকাতাতে যখন নামব তখন সেখানেও বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বলা যায় আমরা সায়েন্স ফিকশনের মত একটা হাইপার ডাইভ দিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতা চলে এসেছি। ব্যাপারটা চিন্তা করে বেশ মজা লাগল।
কলকাতা এয়ারপোর্টের পোশাকি নাম বিখ্যাত নেতা সুভাষ চন্দ্র বোস এর নামে। যদিও দমদম এয়ারপোর্ট নামেই এটা বেশি পরিচিত। সুনীলের বইয়ে পড়েছি কিভাবে এই দমদম নামটা এসেছে। পরে আরেকদিন সেটার গল্প করা যাবে। এখন যে বিশাল ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালটা দমদম এয়ারপোর্ট গেলে দেখা যায়, সেসময় তখন সেটার কাজ চলছিল। আমার মনে আছে, তখন ছিল ছোট্ট একটা ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল, আর তার চেয়েও ছোট একটা ইমিগ্রেশন। এত ছোট রুম দেখে আমরা বেশ অবাক হয়েছিলাম। আর এখন অবাক হই নতুন টার্মিনালের বিশালত্ব আর পরিচ্ছন্নতা দেখে। আমাদের প্ল্যান হল, আজকের দিনটা কলকাতায় কোন হোটেলে থাকা। আগামীকাল রাতে আমাদের নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেন।
অনেক চেষ্টা করেও আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের টিকিট পাইনি। মাহফুজ ভাই চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। তবে যে ট্রেনটা আমরা পেয়েছি তার মতে সেটাও খারাপ না। সেটার নাম কাঞ্চনকন্যা। একটা ট্রেনের এত সুন্দর নাম হতে পারে, ভাবা যায়? যাই হোক, রাত আটটা ত্রিশ মিনিটে এই স্বর্ণ-কন্যার আঁচল ধরে শিয়ালদা স্টেশন থেকে আমরা যাত্রা করব। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছাবো পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায়। এই পুরোটা সময় ঘুমানো ছাড়া আর কী করব ভাবছিলাম। ঢাকা থেকে বহ্নি আমাকে একটা ডায়েরি কিনে দিয়েছে। আমার প্রথম দার্জিলিং যাত্রার মুহুর্তগুলো যেন আমি ডায়েরি বন্দি করে রাখি। ভাবলাম, ঘুম না এলে কিছুটা লেখালেখি করা যেতে পারে।
প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশন শেষ হতে একেবারেই সময় লাগলনা। বের হয়ে একটা প্রিপেইড ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম মার্কুইস স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। আমাদের গন্তব্য মির্জা গালিব স্ট্রিটের হোটেল গুলশান প্যালেস। সস্তার মধ্যে হোটেলটা খারাপ না। ট্রিপ অ্যাডভাইজরের (Tripadvisor.com) রেটিং যদিও খুব একটা ভাল বলছিল না। কিন্তু এক রাতেরই তো মামলা, তাই আর বেশি খুঁতখুঁত করলাম না। কোন রকমে রাতটা কাটিয়ে সকালে একটু এদিক সেদিক ঘুরলাম। রাতে আবার ট্রেন আছে, তাই বেশি ক্লান্ত হওয়া যাবে না। দুপুরে লাঞ্চ করলাম বিখ্যাত কস্তুরী হোটেলে। কলকাতায় গেছে এবং এই রেস্টুরেন্টে খায়নি এমন বাংলাদেশি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরা বাক্স প্যাটরা নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে দৌড়োলাম শিয়ালদার উদ্দেশ্যে। কলকাতায় মোট তিনটি রেল স্টেশন। হাওড়াটা নিউমার্কেট থেকে বেশ দূরে। তবে শিয়ালদা একেবারেই কাছে। দশ মিনিটও লাগল না পৌঁছোতে। আর অন্য রেলস্টেশনটা চীৎপুরে, নাম হল ‘কলকাতা স্টেশন’, যেটাতে ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস গিয়ে থামে। ট্রেনে আমাদের কামরাটা হল টু-টিয়ার। অর্থাৎ দু’দিকের দেয়ালে উপরে দু’টো আর নিচে দু’টো করে সিট। বহ্নি উপরে সিট পেয়েছে, আমি সেই একই দিকের দেয়ালে সিট পেয়েছি নিচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা একটা বড় হুইসেল দিয়ে নড়ে উঠল। বহ্নি পা ঝুলিয়ে উপর থেকে বসে ছিল। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে ফেললাম। এতদিনের স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত পূরণ হচ্ছে। আমাদের ঐতিহাসিক দার্জিলিং জার্নি অবশেষে হুইসেল বাজিয়ে শুরু হল।
জীবনের ছোট ছোট চাওয়া যখন একটু একটু করে পুরণ হতে থাকে, তার চেয়ে আনন্দের মনে হয় আর কিছুই হয় না। একবারে হঠাৎ সবকিছু পেয়ে গেলে সেটাতে তৃপ্তি আসে কি? আমার তো মনে হয় না। আমরা একটু একটু করে টাকা জমিয়েছিলাম। একটু একটু করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের মার্কেট থেকে গরম কাপড় কেনা, প্লেনের টিকিটের টাকা জোগাড় করা, পাহাড়ে বেড়ানোর উপযোগী জুতো কেনা, একটা নতুন ব্যাগ কেনা। এসব করতে আমরা সময় নিয়েছি এবং এতে তৃপ্তিও পেয়েছিলাম অনেক। যাত্রার দিন যতই এগিয়ে আসছিল, বুকের ভেতর টাকডুম টাকডুম ঢোলের আওয়াজটা ততই জোরে শোরে টের পাচ্ছিলাম। এগারো মাসের অপেক্ষার পর অবশেষে আমরা দু’জন এখন দার্জিলিংয়ের ট্রেনে।
আমাদের সাথে এক বাঙালি পরিবার যাচ্ছিল কলকাতা থেকে। গল্পে গল্পে বেশ জমে গেল তাদের সাথে। রাত বারটার দিকে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেল সবাই। আমি কম্বলটা টেনে নিলাম। বেশ ঠান্ডা লাগছে, কারণ এসির বাতাস কন্ট্রোল করার কোন উপায় নেই। প্রথম দিককার উত্তেজনা কমে গিয়ে এখন রাজ্যের চিন্তা ভর করছে মাথায়। দার্জিলিংয়ে আমাদের হোটেল বুকিং হয়েছে ‘হোটেল বেলেভিউ’-তে। সকাল সাড়ে সাতটায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে আমরা ব্রেকফাস্ট করব, আশা করি নাস্তা খাওয়ার মত হোটেল টোটেল আশপাশেই পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই। আমরা দু’জন জার্নিতে দিব্বি চকোলেট খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারি। এটা আমাদের পুরনো অভ্যাস। সে জন্য বেশ অনেকগুলো বাউন্টি আর স্নিকার্স ব্যাগে আছে। চিন্তা হচ্ছে শেয়ার্ড জিপে যাওয়া নিয়ে। শুনেছি ট্রেন থেকে নেমেই জিপ ধরতে না পারলে পরে নাকি জিপ পাওয়া কঠিন। কথাটা কতটা সত্য জানি না, কারণ এবারই প্রথম যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে ব্রেকফাস্ট না করে আগে জিপ ধরাই কি ভাল হবে? একেবারে দার্জিলিং গিয়েই কি খাওয়া দাওয়া করব? এই সব চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
ট্রেন আধা ঘন্টা লেটে পৌঁছালো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ডুয়ার্স এই নামগুলো কত যে পড়েছি গল্পের বইয়ে, শেষ পর্যন্ত এখানে পা দিতে পেরেছি এই আনন্দেই মন ভরপুর হয়ে গেল। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ টিকল না। পৌঁছানোর পরেই একটা হুড়োহুড়ি দেখলাম। হুড়োহুড়িটা আর কিছুই না, শেয়ার্ড জিপ ধরার কম্পিটিশন। এখন শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার জন্য দরকারের চাইতেও বেশি গাড়ি সবসময় মজুদ থাকে। কিন্তু সেই ২০১০ সালে যাত্রীর তুলনায় গাড়ি এত পর্যাপ্ত ছিলনা। এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভাল, স্টেশন থেকে সব গাড়িই যে দার্জিলিং যায় তা কিন্তু নয়। কিছু গাড়ি কালিম্পং যায়, কিছু যায় সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক-এ।
আরো অন্যান্য জায়গা তো আছেই। তাই যাত্রী বেশি হলে দার্জিলিংয়ের গাড়ি পাওয়া নিয়ে একটু টানা হেঁচড়া হওয়াটাই সে সময় স্বাভাবিক ছিল। পয়সা যাদের বেশি তারা শেয়ার্ড জিপ টিপের ধার ধারেনা। তারা একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করেই চলে যেতে পারে। কিন্তু আমাকে হিসেব করে চলতে হবে। ট্যাক্সি রিজার্ভ করে এখনই একগাদা টাকা খরচ করার কোন মানেই হয় না। যাই হোক, এরকম দৌড়োদৌড়ি দেখে ব্রেকফাস্ট খাওয়া আমাদের মাথায় উঠল। ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে আমরাও দৌড়োলাম জিপ-স্ট্যান্ড এর দিকে। দৌড়োতে দৌড়োতে হঠাৎ মনে পড়ল, আমি একটা অত্যন্ত দরকারি ব্যাপার দিব্বি ভুলে বসে আছি। সেটা হল, এখান থেকে কলকাতায় ফেরার টিকিট কাটা। ঢাকা থেকে আমি শুধু কলকাতা-জলপাইগুড়ির টিকিটই কেটেছিলাম। ফেরার টিকিটটা কি কারণে যেন কাটা হয়নি। কেন যে কাটা হয়নি সেটা এখন আর মনে পড়ছেনা। তবে এটা মনে আছে যে, ভেবেছিলাম দার্জিলিং স্টেশন থেকেই সেটার ব্যবস্থা করব। কিন্তু এখন এখানে এসে এতসব লোকজনের হুল্লোড় দেখে মাথায় একটা নতুন চিন্তা ঢুকল।
ভেবে দেখলাম, এই লোকগুলোও তো কিছুদিন পরে কলকাতায় ব্যাক করবে। আমি দার্জিলিংয়ে বেড়িয়ে টেড়িয়ে ক’দিন পরে টিকিট কাটতে গিয়ে যদি দেখি তা পাচ্ছিনা, তাহলে তো খাব মহা ধরা। এদিকে কলকাতা থেকে আমাদের ঢাকায় ফেরার প্লেনের টিকিটও কাটা আছে। সময়মতো যদি কলকাতা যেতে না পারি, তাহলে তো প্লেনও মিস করব। সর্বনাশ! সুতরাং যেদিক থেকে দৌড় শুরু করেছিলাম, সেদিকে ঘুরে দিলাম উল্টো দৌড়। আমিও দৌড়োচ্ছি, বহ্নিও সমান তালে দৌড়োচ্ছে। আবার স্টেশন। এবার টিকিট কাউন্টার খোঁজো। ফর্ম ফিলআপ কর। পাসপোর্ট দেখাও।
ফরেন কোটায় রিটার্ন টিকিট কাটলাম ঝামেলা কমানোর জন্য। এবং এই করতে করতে পেরিয়ে গেল প্রায় এক ঘন্টা। টিকিট হাতে নিয়ে আবার লাগেজ টেনে দৌড়োলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা লাল হলুদ জীপ। জানালার পাশে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে, সেখানে লেখা ‘দার্জিলিং’। ততক্ষণে আমাদের জিব বেরিয়ে গেছে। ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে নেয়ে গেছি পুরো। মহানন্দে জিপটায় পা রাখতে যাব, এমন সময় ড্রাইভার বলল গাড়ি যাবেনা। কে-হে-হে-নো-হো-হো? হাহাকারের মত প্রশ্নটা বেরিয়ে এল বুকের ভেতর থেকে। শুনলাম দার্জিলিং এ আজকে ‘বন্দ্’। মানে দোকানপাট থেকে শুরু করে গাড়িঘোড়া চলাচল সব বন্ধ। কোন গাড়ি পাহাড় থেকে নামছেও না, পাহাড়ে যাচ্ছেও না। ল্যাম্পপোস্টের মত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এখন তাহলে কি হবে? কোথায় যাব আমরা?
জাকির হোসেন