আমরাও ততক্ষণে উপসাগরের রূপে মুগ্ধ। উপসাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে দেখি উপসাগর জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথরের চাঁই। এগুলির কয়েকটি বৃক্ষহীন হলেও, বেশির ভাগ পাথরস্তম্ভের গায়েই সবুজের ছড়াছড়ি। আপনমনে পাখিদের আনাগোনা দেখতে দেখতে স্তম্ভগুলির পাশ দিয়ে এগোতে থাকি। চোখের সামনে তখন দেশবিদেশের পর্যটক-বোঝাই লঞ্চ ভেসে চলেছে উপসাগর জুড়ে।
খানিক দূরে রং-বেরঙের ছোট ছোট রবারের নৌকা নিয়ে একদল পর্যটক মেতে উঠেছেন ‘কায়াকিং’-এ। আমরা কায়াকিং-এ আগ্রহী না হওয়ায় লঞ্চ চলল এগিয়ে। খানিকক্ষণ চলার পরে এসে থামল একটা বড় দ্বীপের সামনে। এখানেই রয়েছে একটি বিখ্যাত চুনাপাথরের গুহা। সেটি এত বড় যে, একসঙ্গে এক হাজার পর্যটকও দাঁড়াতে পারেন অনায়াসে।
শুনলাম, ১৯০১ সালে ভিয়েতনাম যখন ফরাসিদের অধিকারে, সে সময়ে তারাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই গুহাটি আবিষ্কার করে নাম দেয় ‘সারপ্রাইজ় কেভ’। সাং সট কেভ নামেও এটি পরিচিত। যদিও হা লং উপসাগরের এক প্রান্তে অবস্থিত এই গুহাটিকে সাজিয়েগুছিয়ে দর্শনের উপযোগী করে পর্যটকদের দেখার জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৯৩ সালে। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকি আমরাও। প্রায় তিরিশ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এই গুহাটির চারপাশে অপরূপ ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। দেখে মনে হয় যেন রামকিঙ্কর বেজের মতো কোনও শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে শিল্পকর্মগুলি। ঝাড়বাতির মতো আকৃতি নিয়ে কোনওটি নেমে এসেছে উপর থেকে, কোনওটি বা নীচ থেকে বেড়ে উঠেছে উপরের দিকে অপরূপ কারুকার্যে শোভিত হয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ গুহাটির ভিতরে সময় কাটিয়ে বেরিয়ে আসি বাইরে। যে দিকে তাকাই, সে দিকেই চোখে পড়ে উপসাগরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা অনুচ্চ পাথরের সারি। বিশ্বের একপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অপরূপ সৌন্দর্য ভাণ্ডারের দিকে অপলকে চেয়ে থাকি। চমক ভাঙে গাইডের ডাকে। জানায়, এ বার ফিরতে হবে।
একরাশ তৃপ্তি নিয়ে উঠে আসি লঞ্চে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে পড়েছে হা-লং বে’র জলে, পাথরচূড়ার মাথায় মাথায়। আকাশটাও যেন জীবনানন্দ দাশের কথায় ‘ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।’
লঞ্চ ছাড়ে। জল থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরগুলির পাশ দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ শুনি ডেকের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার এক সহযাত্রী-বন্ধু আপনমনে গাইছেন— ‘মধুর, তোমার শেষ যে না পাই…’