থাইল্যান্ডের কোহ সামুই দ্বীপ আমাদের কাছে ততটা পরিচিত নয়, যতটা ফুকেট কিংবা পাতায়া। তবে সৌন্দর্যে সবাইকে হার মানাবে গালফ অব থাইল্যান্ডের দ্বীপটি।
মন্দিরে আসার পথে কোহ সামুই বিমানবন্দর দেখে এসেছি। থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য শহর ছাড়াও সিঙ্গাপুর এবং হংকং থেকেও এখানে সরাসরি ফ্লাইট আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটি থাইল্যান্ড সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় না, বরং বলা চলে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের নিজস্ব বিমানবন্দর এটি। সে কারণেই এখানকার বিমানভাড়াও আকাশছোঁয়া। আমাদের প্রথম দিকের পরিকল্পনা ছিল বিমানে করে ব্যাংকক থেকে কোহ সামুই যাওয়া–আসা করব। কিন্তু বিমানভাড়া দেখে আগ্রহ উবে গেছে। খরচ বাঁচাতে তাই সুরাত থানি থেকেই ফেরত যাওয়ার টিকিট কেটেছি।
সন্ধ্যায় সবার একসঙ্গে দেখা করার কথা। মোবাইলের মেসেজ চেক করে দেখি মারজান লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে। পিএন্ডএন বিচ ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। আমরা এখন আছি দ্বীপের একদম উত্তরে, রেস্তোরাঁর অবস্থান একদম দক্ষিণে। এত দূরের এই রেস্তোরাঁ বাছাইয়ের কারণটা বুঝতে পারলাম এখানটায় পৌঁছানোর পর। পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবু ডুবু করছে। সূর্যাস্ত দেখার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আসলেই হয় না। বেতের চেয়ারগুলোয় হেলান দিয়ে কার্নিশের ওপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে সূর্যাস্তের শোভা উপভোগ করা যায়। এক প্লেট ম্যাঙ্গো স্টিকি রাইস আর এক গ্লাস রেড মোজিটো অর্ডার দিয়ে আরাম করে বসলাম। অস্তগামী সূর্যের আবিরের রঙে রাঙানো চারপাশ। জায়গাটা বেশ নির্জন। সৈকতে কিছু মাছ ধরার নৌকা বাঁধা আছে, মাঝি-মাল্লাদের টিকিটিও নেই। থাইল্যান্ডের খুব জনপ্রিয় খাবার ম্যাঙ্গো স্টিকি রাইস। প্রতিদিন কমপক্ষে তিন প্লেট করে তো খেয়েছিই।
চারপাশে বিশালকায় পাথরের মাঝ দিয়ে সগর্জনে বয়ে চলেছে জলের ধারা, স্রোতের তীব্র শব্দে কান পাতা দায়। পানির আঘাতে কোনো কোনো জায়গায় তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক পানির আধার, যেখানে জলকেলিতে ব্যস্ত ছোট ছোট বাচ্চারা। এমনই এক প্রাকৃতিক সুইমিংপুলের হিমশীতল জলে ডুব দিয়েই মনে হলো শরীর থেকে সব ক্লান্তি কর্পূরের মতো উবে গেছে। পাথরে হেলান দিয়ে গলা পর্যন্ত ভিজিয়ে বসে থাকতে মন্দ লাগছে না। সাদীকে অনেকবার বলার পরও বেচারা পানিতে নামতে ইচ্ছুক নয়। বরং জলের যে ধারা পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে, সেটার উৎসে পৌঁছানোতেই সে অধিক আগ্রহী। আমাদের আজকের যাত্রার উদ্দেশ্যও তো সেটিই।
শুরু থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল প্রথম দিন কোহ সামুইয়ের সৈকত আর দ্বিতীয় দিন পাহাড়গুলোতে ঘুরে বেড়াব। সেই মতে প্রথম দিন তো পুরো দ্বীপের সৈকতগুলো ঘুরে দেখলাম। আজ দেখব পাহাড়, যদিও সৈকতগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, আর তেমন ইচ্ছাও নেই। দুটোর দুই রকম সৌন্দর্য। গত রাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছে। ডিনার করেছিলাম সবাই মিলে থংসন বাংলো রেস্তোরাঁয়। জায়গাটা দ্বীপের সর্ব উত্তরের বিন্দুতে। একদম সৈকতের তীর ঘেঁষে করা রেস্তোরাঁ। বালির সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনটে লোমশ কুকুর। ফেনিল জলরাশি ক্ষণে ক্ষণে এসে পা ভিজিয়ে চম্পট দেয়। থাইল্যান্ডের সি ফুড আমার বেশ পছন্দের। একদম টাটকা সামুদ্রিক মাছগুলো চোখের সামনে ভেজে উপাদেয় সস দিয়ে পরিবেশন করে। একটা বড় মাছেই যেখানে দুজনের পেট ভরে যায়, সেখানে পাঁচজনে মিলে আটটা মাছ সাবাড় করা যেনতেন কথা নয়। সমুদ্রের বাতাসে নাকি হজমশক্তি বাড়ে। কথাটা মিথ্যা না। অন্তত মারজানের জন্য তো নয়ই। খাওয়া শেষে আবার গিয়েছিলাম লাদ কোহ ভিউ পয়েন্টে রাতের সমুদ্র দর্শনে যেখানে ফসফরাসের ছোঁয়ায় সুনীল জলরাশি প্রাণ ফিরে পায়।
থাইল্যান্ড পর্যটকবান্ধব দেশ। গভীর রাত পর্যন্ত বাইক নিয়ে চষে বেড়ালেও কোনো টেনশন কাজ করেনি। আমাদের দেশে যেদিন থেকে আমরা পর্যটকদের মনে এমন নিরাপত্তাবোধ নিশ্চিত করতে পারব, সেদিন থেকেই আমাদের পর্যটন মাথা তুলে দাঁড়াবে।
সকালে নাশতা সেরেছি দারুণ এক জায়গায়। সিলভার বিচ রিসোর্টের রেস্তোরাঁয়। অসাধারণ একটা রিসোর্ট। কোনো বড় বিল্ডিং নেই, সব আলাদা আলাদা কটেজ। সুন্দর বাগান। নির্দিষ্ট দূরত্বে নারকেলগাছের সারি। কয়েকটা গাছের মাঝে হ্যামক ঝোলানো, যেখানে বসে রৌদ্রস্নানের পাশাপাশি বই পড়া যায়। রেস্টুরেন্টটা একদমই সৈকতঘেঁষা। দ্বীপের অন্যান্য দিকের তুলনায় এদিকটার পানি অধিক স্বচ্ছ এবং নীলাভ। বালির বর্ণও অধিক শুভ্র।
আনন্দের আতিশয্যে বউকে ভিডিও কল দিয়ে খেলাম রামধরা। ব্যাপার হচ্ছে, সাদা চামড়ার কিছু রমণী সৈকতে বিকিনি পরে সূর্যস্নানে মগ্ন ছিলেন। বউয়ের ভাষ্য খুবই সাধারণ, ‘তুমি কি ঘুরতে গেছ নাকি মেয়ে দেখতে গেছ?’ যতই বোঝাই এগুলো ঘোরাঘুরির বাই প্রোডাক্ট, আমার মন একদম বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ, সে কি আর বুঝতে চায়? তবে যা–ই বলি না কেন, নাশতাটা যথেষ্ট উপাদেয় ছিল। একটা ফিশ কাটলেটের সঙ্গে এক ঝুড়ি ফ্রেঞ্চফ্রাই, সেই সঙ্গে শসা, টমেটো, বরবটি সহকারে ভেজিটেবল সালাদ। সঙ্গে বোনাস হিসেবে সুস্বাদু মেয়োনিজ আর টমেটো সস। আর পরিবেশন বরাবরের মতোই চোখে লেগে থাকার মতো।
সকালের নাশতা করে দিনের প্রথম গন্তব্য হিন লাত (মতান্তরে হিন লাড) জলপ্রপাত। কোহ সামুইতে বেশ কয়েকটি ছোট–বড় জলপ্রপাত থাকলেও এটিই বেশি আলোচিত এর যাত্রাপথের সৌন্দর্যের কারণে। প্রবেশপথের বাইরে বাইক পার্ক করার জায়গা আছে। মানুষের আনাগোনা ভালোই। তবে যা বুঝলাম, ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যে লোকজন কমই এসেছে। বেশির ভাগই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসেছে ঝরনার পানিতে গোসলের জন্য এবং বাচ্চারাও মনের আনন্দে দাপাদাপি করছে। সেই দাপাদাপিতে কিছুক্ষণ অংশ নিয়ে আমরা ছুটলাম ঝরনার উৎস সন্ধানে। বাইরে সূর্যের তাপ যেমনই হোক না কেন জঙ্গলের ভেতরে সেটির প্রভাব নেই। তাপমাত্রার এই আকস্মিক পতনের ব্যাপারটা পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে খুবই সাধারণ। বিষয়টা প্রথম খেয়াল করেছিলাম বান্দরবানের আলিকদমে আলীর গুহায় ঘুরতে গিয়ে। সুবিধা হচ্ছে এর ফলে ট্রেকিংয়ের কষ্ট কম হয়। তারপরও যেটুকু কষ্ট হয়েছে, সেটিও কম নয়।
খাড়া পাহাড়ি পথ দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার ওঠানামা করলে তবে জলপ্রপাতের দেখা মেলে। যাত্রাপথে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, জলপ্রপাত দেখে হতাশ হয়েছি। যেটা ভেবেছিলাম যে অনেক উঁচু কোনো পাহাড়ের ওপর থেকে জলের ধারা পতিত হচ্ছে বিষয়টা তেমন নয়। এর থেকে আমাদের হামহাম জলপ্রপাত অনেক সুন্দর। তাই ফাহিম যখন ফোন দিয়ে বলল যে তাঁরা তিনজন নিচে এসে পৌঁছেছে এবং জলপ্রপাতের পথে ট্রেকিং শুরু করবে কি না, তখন নিষেধ করলাম। একে তো এই সৌন্দর্য দেখে হতাশ হবে, তার ওপর পথ যথেষ্ট পিচ্ছিল। কোনোভাবে আছাড় খেয়ে আহত হলে বাকিদের পক্ষে বহন করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তবে যাঁরা ট্রেকিং পছন্দ করেন, তাঁরা এই পথটা ঘুরে দেখলে বান্দরবানে ট্রেকিংয়ের অনুভূতি পাবেন। অসংখ্য নাম না জানা পাখির কূজন আর বুনো ফুলের ঝাঁক পুরো পথেই আপনাকে শুভেচ্ছা জানাবে। এর বাইরে অবারিত সবুজের সঙ্গে ঝরনার কলকল শব্দের মিতালি একটা ভালো লাগার অনুভূতিতে পুরোটা সময় মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
ঝরনার পানিতে দাপাদাপি শেষে ক্লান্তি দূর করার নিমিত্তে ডাবের পানিতে চুমুক দিয়ে পরের গন্তব্য ঠিক করলাম। তারনিম ম্যাজিক গার্ডেনে যাব এখন। এখান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কোহ সামুইয়ের সর্বোচ্চ পাহাড় পম পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি এর অবস্থান। এটিকে অনেকে সিক্রেট বুদ্ধ গার্ডেনও বলে থাকেন। আদতে এটি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্ক। ১৯৭৬ সালে খান নিম থংসাক নামের এক কৃষক ৭৭ বছর বয়সে এই পার্কের স্থাপনাগুলো নির্মাণ শুরু করেন। ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এখানে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছিলেন।
ভদ্রলোকের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে জায়গাটির দেখভাল করছেন। প্রবেশপথে টিকিট কাউন্টার আছে। ৮০ বাথ দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে কিঞ্চিৎ হতাশ হয়েছি। জায়গাটার ব্যাপ্তি খুব বেশি নয়। তবে স্বল্প জায়গাটুকুর একদম যাকে বলে পরিপূর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দেব–দেবীসহ বুদ্ধের বিভিন্ন রকমের ভাস্কর্য আছে। আছে পাখি, সাপসহ বিভিন্ন সরীসৃপের প্রতিকৃতি। এ ছাড়া আছে পুরো এক বাদ্য দলের ভাস্কর্য। একসময় হয়তো মূর্তিগুলো চকচক করত। দীর্ঘদিন অনাদর–
অবহেলায় থেকে শেওলা জমেছে।
পাহাড়ে ওঠানামা করে ক্ষুধা পেয়েছে ভীষণ। কিন্তু খাব কোথায়?
‘ভাই চলেন, আপনাকে এমন এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাব, যেখানকার কথা আপনার সারা জীবন মনে থাকবে।’
জায়ান্ট সামিট সামুই রেস্তোরাঁ থেকে দেখা দ্বীপের একাংশ খাবারের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে সাদীর ওপর ভরসা রাখা যায়। ডাক্তারি পড়াশোনা শেষে করপোরেট কোম্পানিতে চাকরি করলেও সাদীর প্যাশন রান্না এবং খাওয়াদাওয়া। রাজশাহী শহরে তাঁর তিনটা রেস্টুরেন্ট আছে। বিভিন্ন খাবারের বর্ণনা বিশেষ করে বিরিয়ানির বর্ণনা এত চমৎকারভাবে সে দেয়, যেন বয়ানেই অর্ধভোজন হয়ে যায়। তাই সাদী যেহেতু বলেছে, তাই সেখানে যেতেই হবে।
রেস্তোরাঁয় পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলাম কেন সাদী বলেছিল সারা জীবনেও ভুলব না এই জায়গার কথা। এই রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব এর অবস্থান। অনেক উঁচুতে অবস্থিত বলেই এখান থেকে পুরো দ্বীপের ১৮০ ডিগ্রি প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে গালফ অব থাইল্যান্ডের একটা বড় অংশও চোখে পড়ে। খাবারের মান যে খুব আহামরি তা না, দামও অন্যান্য জায়গার চেয়ে একটু বেশিই। কিন্তু ওই যে বললাম, অবস্থান। রেস্তোরাঁর অবস্থানই এটিকে অনন্য করেছে। কাঠের খোলা ব্যালকনিতে সারি সারি চেয়ার সাজানো, যেগুলোতে বসে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ক্লান্তি আসবে না।
সাদীর কথায় সম্মতি না জানানোর কোনো কারণ নেই। বাকি তিন সঙ্গীর জন্য খারাপ লাগছিল। বেচারারা এত চমৎকার জায়গায় অবস্থানের অভিজ্ঞতা পেল না। এখান থেকে সহজে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। তারপরও উঠতে হলো এক বিশেষ জায়গায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। জায়গাটা এখান থেকে কাছেই। টেম্পল অব দ্য মামিফাইড মঙ্ক। মিসর গিয়ে মামি দেখার সুযোগ কবে পাব, কে জানে। ওয়াট খুনারাম নামের মন্দিরটিতে আমাদের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন সন্ন্যাসী লাউং পরদায়েং, যিনি ৪০ বছর ধরে মামি হয়ে আছেন এবং পূজিত হচ্ছেন সামুই দ্বীপের অধিবাসীদের কাছে।