চারপাশে ঘন সবুজ অরণ্যের ঢেউ খেলানো ছোট-বড় পাহাড়ের সারি। পাহাড়ে গায়ে সারি সারি আকাশচুম্বী বৃক্ষরাজি। সবুজে মোড়ানো চাদরের ওপর কুয়াশার মতো উড়ছে ধূসর ও শ্বেতশুভ্র মেঘ। যেখানে চলে পাহাড় আর মেঘেদের মিতালী। যারা আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাদের স্বপ্ন পূরণের ঠিকানা হতে পারে সাজেক ভ্যালি।
যান্ত্রিক জীবনের কর্মব্যস্ততার ছক থেকে বেরিয়ে সবুজে ঘেরা পাহাড় আর শ্বেতশুভ্র মেঘ দিয়ে নিজেকে রাঙিয়ে তোলার এক রহস্যময় উপত্যকা সাজেক ভ্যালি। যেখানে একবার ঘুরে এলে বার বার যেতে মন চাইবে। এমন অনুভূতি যেন নৈসর্গিক।
বলছি দেশি বিদেশী পর্যটকদের কাছে আলোচিত পর্যটনকেন্দ্র ‘সাজেক ভ্যালি’র কথা। নয়নাভিরাম অরণ্যভূমি আর পাহাড়ের বন্ধন যেখানে অবিচ্ছেদ্য। সাজেক ভ্যালিতে দাঁড়িয়ে মনে হবে আপনি আকাশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন।
একখণ্ড পাহাড়ে সবুজে মোড়ানো চাদরের ওপর মেঘমালার ছুটে চলা আর সবুজ প্রকৃতির মায়াবী রূপ দেখতে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ছুটে যাচ্ছেন সাজেক ভ্যালিতে। পর্যটকের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে নৈসর্গিক সৌন্দয্যের লীলাভূমি ‘সাজেক ভ্যালি’।
পর্যটকদের বর্ষাকালে সাজেক ভ্রমণের পরামর্শ দিয়ে তরুণ ব্যবসায়ী পিয়াস কান্তি দাশ বলেন, ‘বৃষ্টি সাজেকের সৌন্দর্য্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বর্ষাকালে না আসলে মেঘ দেখতে পাবেন না। মেঘ দেখার অনুভুতি মিস করবেন।’
সাজেক বিধাতার অনন্য সৃষ্টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাজেক না আসলে সৃষ্টিকর্তার অনন্য সৃষ্টি অদেখা থেকে যেতো। সাজেকের রূপ সৌন্দর্য্য যে কাউকে কাছে টানবে।’
নোয়াখালী থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে সাজেক ঘুরতে আসা পর্যটক মো. ইসমাইল হোসেন রনি বলেন, ‘যে কেউ নিশ্চিন্তে সাজেক ভ্রমণ করতে পারেন। এখানে থাকা বা খাওয়ার কোনো সমস্যা নেই।’
তবে যারা মোটর সাইকেলে সাজেক ভ্রমণে আসববেন তাদেরকে সাবধানে মোটর সাইকেল চালানোর পরামর্শ দিয়ে এ পর্যটক বলেন, ‘সাজেকের ভিউ পর্যটন পিপাসুদের আন্দোলিত করবে ‘
সবুজে মোড়ানো সর্পিল আর সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে মেঘের রাজ্য সাজেকে যাওয়া সত্যিই অসাধারণ অনুভূতির। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন সাজেকভ্যালির অবস্থান পার্বত্য রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে।
৭০২ বর্গমাইল আয়তনের সাজেক ইউনিয়ন দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। সাজেকের রুইলুইপাড়া এবং কংলাকপাড়ার সম্মিলিত রূপ সাজেক ভ্যালি। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি যেন এক মনোরম ভূ-স্বর্গ।
সাজেক ভ্যালির অবস্থান রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি-দিঘিনালা সড়কে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের সাজেক যেন বিধাতার অনন্য সৃষ্টি। সাজেক ভ্যালিতে দাড়িয়ে রাঙ্গামাটির অনেকটাই দেখা যায়। এ কারণে অনেকেই সাজেক ভ্যালিকে রাঙ্গামাটির ছাদ বলেন।
সাজেক যাবেন যেভাবে
ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে খাগড়াছড়িতে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কিলোমিটার। এতে জনপ্রতি ৫২০-৫৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। আর এসি বাসে ভাড়া লাগবে ১০০০-১২০০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকেও আপনি পর্যটনের শহর খাগড়াছড়ি আসতে পারেন। চট্টগ্রামের অক্সিজেন বা বায়েজীদ থেকে খাগড়াছড়ি অভিমুখী গাড়িতে উঠতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি আসতে জনপ্রতি ১৮০-২২০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ির দুরত্ব ১০৯ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন হুন্দাই (এসি-নন এসি), গ্রীণ লাইন (এসি), শ্যামলী, হানিফ (এসি-নন এসি), শান্তি পরিবহন, এস আলম, সৌদিয়া, রিল্যাক্স (এসি-নন এসি), ও ঈগল প্রায় সবধরনের বাস পাবেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়াও আপনার শহর থেকে আসা গাড়িতে করে খাগড়াছড়ির প্রাণকেন্দ্র শাপলা চত্বর গাড়ি থেকে নামতে হবে।
শাপলা চত্বরের আশেপাশেই রয়েছে সাজেকগামী গাড়ির কাউন্টার। সেখান থেকেই নির্ধারিত ভাড়ায় সাজেকগামী চাঁদের গাড়ি, পিকআপ, মাহেন্দ্র ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা মধ্যে আপনার পছন্দের বাহন রিজার্ভ করবেন।
সকালের নাস্তাপর্ব শেষ করে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দিয়ে প্রথমে আপনাকে বাঘাইহাট আর্মি চেকপোস্টে গাড়ির চালকসহ পর্যটকদের তথ্য দিয়ে টোকেন নিতে হবে। সেখান থেকেই শুরু হবে সাজেক অভিমুখে আপনার স্বপ্ন যাত্রা।
মনে রাখবেন, আপনাকে বাঘাইহাট এন্ট্রিপয়েন্টে আপনাকে সকাল সাড়ে ১০টার মধেই পৌঁছাতে হবে। সকালের এ্যাসকট না পেলে আপনাকে আবারো বিকালের এ্যাসকটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সাজেক ভ্যালির প্রবেশ মুখেই আছে প্রবেশ ফি টিকিট কাউন্টার। সাজেক ভ্যালিতের প্রবেশের জন্য পর্যটক প্রতি ২০ টাকা দিয়ে টিকিট নিতে হবে।
এ ছাড়াও যানবাহনের ক্ষেত্রে চাঁদের গাড়ির জন্য ১০০ টাকা ও মোটরসাইকেল হলে ৫০ টাকার টিকিট নিতে হবে। ফেরার সময় প্রবেশ মুখের নির্ধারিত কাউন্টারে সেই টিকিট আবার ফেরত দিতে হবে।
সাজেকে থাকবেন কোথায়?
মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালিতে শুরুর দিকে পর্যটকদের থাকার জায়গার সঙ্কট থাকলেও বর্তমানে সাজেক ভ্যালিজুড়ে পাকা রিসোর্টের পাশাপাশি কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি নান্দনিক রিসোর্টে ভরা। সেখানেই আছেন সেনাবাহিনী পরিচালিত সাজেক রিসোর্ট ও রূন্ময় রিসোর্ট।
সেখানে আরও আছে সাজেক বিলাস, রুইলুই রিসোর্ট, মেঘপুঞ্জি, মাচাং ঘর, জুমঘর, সাজেক ভ্যালি, মেঘের ঘর, সাম্পারী রিসোর্ট, দার্জিলিং রিসোর্ট, মোনঘর, লুসাই কটেজ ও অবকাশ ইকো কটেজসহ বেশকিছু রিসোর্ট ও কটেজ।
এ ছাড়াও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মালিকানাধীন খোয়ালবুকও আছে সেখানে। রিসোর্ট বা কটেজ ভেদে পর্যটকদের প্রতি রাত যাপনের জন্য ভাড়া গুনতে হবে ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
তবে কেউ ছুটির দিনে সাজেক ভ্রমণ করলে আগে থেকেই রুম বুকিং কনফার্ম করতে হবে। না হলে বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে।
সাজেক ভ্রমণে পরামর্শ ও সতর্কতা
১. সাজেক ভ্রমণে যাওয়ার আগেই থাকার রুম বুকিং দিন (ছুটির দিনে ভিড় থাকে)।
২. নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে রাখুন।
৩. সাজেকে শুধু রবি ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তাই রবি বা টেলিটক যে কোনো একটা সিম সঙ্গে রাখুন।
৪. সাজেক যাবার পথ অনেক দুর্গম, আঁকাবাঁকা ও উঁচু নিচু, তাই ভ্রমণে সতর্ক থাকুন।
৫. স্থানীয়দের ছবি তোলার ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি নিন।
৬. যাত্রাপথে কয়েক জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প আছে। সেখানে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য জমা দিতে হয়। নিজের প্রয়োজনেই জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সঙ্গে রাখুন।
৭. ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবে ভাড়া কম বেশি হতে পারে।