স্টেশনে নামতেই ভোর হয় হয়। এখনও আলো ফুটেনি। মাঘের মাঝারি সময়, তাই ঠান্ডা পড়েছে বেশ। সময় আনুমানিক ৪টা পেরিয়েছে, ঘড়ি দেখা হয়নি। প্রথমবার দেশের সীমানা পেরোনোর শঙ্কা আর উত্তেজনায় অনুভূতির গুরুচণ্ডালি টের পেলাম।
ঢাকা থেকে ট্রেনে চেপেছি পৌনে বারোটায়। দর্শনা নামতে প্রায় ঘণ্টা চারেকের মতো লেগেছে। যাত্রাপথে গাড়িতে ঘুমানোর অভ্যাস না থাকায় আধোঘুমে কেটেছে সারাপথ। তার ওপর নতুন পথে প্রথমবার। পাছে স্টেশন মিস হয়ে যায় কি না!
ভাগ্যক্রমে গন্তব্য স্টেশনের এক সহযাত্রীর সঙ্গে পরিচয়। বেনাপোল এক্সপ্রেস ৭৯৬, জ বগির ৬৪ নম্বর সিট। অনলাইনে পাঁচ দিন আগেই টিকিট কেটে রেখেছিলাম। বন্ধু শামিমের প্ররোচণা ছিল বেশ। কিন্তু সে প্রতিবারই গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিয়েছে।
পাঁচ দিন আগে টিকিট কেটেও জানালার পাশের সিট পেলাম না। তবে পাশের দুজন সন্ধ্যেবেলায় টিকিট কেটে ঠিকই আমার পাশের দুটো সিট বাগিয়ে নিয়েছেন। কিছুটা গায়ে লেগেছে বটে ব্যাপারখানা। কালোবাজারিদের কারণে টিকিট কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যত ভোগান্তি।
দু’দিন আগে টিকিট না পাওয়া গেলেও দুই ঘণ্টা আগে ঠিকই টিকিট মেলে। এসব নিয়ে মনে হয় কারো ভাবনা নেই। ট্রেন ছাড়ার সময় ছিল পৌনে বারোটায়। যথাসময়ে সাত নম্বার প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা এসে থামলো। থামতেই ছুটে গেলাম নির্ধারিত বগির দিকে। সিট খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
ট্রেনে চড়ার অভ্যাস তেমন নেই। সিট তিনটাই তখন ফাঁকা। তিনজনের মধ্যে আমিই প্রথম উঠলাম। বসে পড়লাম জানালার পাশে। খানিকবাদেই মাঝখানের সিটে প্রায় সমবয়সী একজন এসে বসলো। নিজ আগ্রহেই কথা বললাম। দু’জনের গন্তব্য একই। শুনে স্বস্তি পেলাম।
আলাপের ফাঁকে পৌঁছানোর আনুমানিক সময়টা জেনে নিলাম। তার পরামর্শে ফোনে এলার্ম দিলাম পাঁচটায়। এর মধ্যে জানতে পারলাম জানালার পাশের সিটটার মালিক আমি নই, তৃতীয় কেউ। অবশেষে আসলেন তিনি। দু’জনেই জায়গা করে দিলাম তাকে।
লোকটিকে দেখে বুঝলাম তিনি সনাতন ধর্মের। মনে হলো তিনি হয়তো কলকাতামুখী হবেন। বেশ আগ্রহ নিয়েই জানতে চাইলাম, দাদা কি কলকাতা যাবেন? আমাকে হতাশ করে মহাশয় উত্তর দিলেন তিনি কুষ্টিয়া যাবেন। তিনজনে খানিক আলাপ করে নিলাম। এর মধ্যে ট্রেন ছেড়েছে।
স্টেশনে আসার আগে রিক্সায় বসে বাড়িতে কথা বলে নিয়েছিলাম মা আর নানুর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আলাপ সেরে স্টেশনে পৌঁছাই। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসার আগে আরেকজনের সঙ্গে ফোনালাপ সেরে নিয়েছিলাম। তারপর যাত্রা শুরু, ট্রেন চললো রাতের আধার আর ভারি কুয়াশার চাঁদর চিঁড়ে।
স্টেশনে নামার ক্ষেত্রে সমবয়সী ভদ্রলোকটি যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। তার ভরসাতেই দর্শনা নেমে যাই। তিনি আমাকে বাকি রাস্তা চিনিয়ে বিদায় নিয়েছেন। তবে ভারি আফসোসের ব্যাপার বেচারার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। অন্তর্মুখী খোলস থেকে আর বের হতে পারলাম না বলে নিজের ওপরই করুণা হলো। মনে মনে লোকটার মঙ্গল কামনা করে পা বাড়ালাম।
ততক্ষণে ভোর হয়নি, তবে স্টেশনে ট্রেন থামায় স্থানীয় ভ্যান চালকেরা জড়ো হয়েছেন। একেকজন হাঁক দিচ্ছেন এই বর্ডার বর্ডার বলে। আমি একাই বেরিয়েছি। অর্ধেক যাত্রীভরতি একটি ভ্যানে চেপে বসলাম। আর একজন পেলেই ভ্যান ছাড়বে। রাত শেষ হয়নি তাই ভাড়া ৪০ টাকা।
দিনের বেলায় ৩০ টাকা। এর মধ্যে একজন লোক এসে পাশে বসলেন। একটু মধ্যবয়সী যুবক। উচ্চতা আমার থেকে একটু কম। ভ্যানে আগে থেকে বসা তিনজন গল্পে মশগুল। চার নম্বর হিসেবে সবার শেষে আসা ব্যক্তিটিও গল্পে যোগ দিলেন।
ভ্যান চলছে অপরিচিত গন্তব্যে। দুপাশে আবছা আলাতে যতদূর চোখ যায় শুধু আখের খেত। আখ কেরু এন্ড কোম্পানির অন্যতম প্রধান কাঁচামাল। ভ্যান চালকের ভাষ্যমতে সব খেতের মালিক কেরু। ওসব নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। চলতে চলতে নানা রকমের গল্প জুড়লেন ভ্যানচালক।
শীতকাল চলছে, কথায় কথায় সে খেজুরের রসের আলাপ তুললো। আপনারা খেজুরের রস খাবেন? চাইলে ব্যবস্থা করে দিতে পারি টাটকা রস। না, আমরা কেউ রস খাব না। বলে রসের আলাপের ইতি টানলো সবাই। আমি ততক্ষণ চুপচাপ আশপাশের পরিবেশ দেখছি। কি নিস্তব্ধ, নীরব।
জনমানব নেই কোথাও। কুয়াশামাখা পাকা রাস্তা ধরে শুধু আমাদের ভ্যানটাই চলছে পাঁচজন যাত্রী নিয়ে। পাশেরজন জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাব। সোজাসাপটা জবাব দিলাম, কলকাতা। তিনিও জানালেন কলকাতা যাবেন। খানিকটা আলাপ জমে উঠলো। আপনি কি কলকাতা ঘুরতে যাচ্ছেন না কোনো কাজে? ঘুরতেই যাচ্ছি।
-আপনি কি করেন? কোথা থেকে আসছেন?
-আমি ঢাকায় থাকি।
-আপনার বাসা কি ঢাকাতেই?
-না, ঢাকায় না, তবে থাকি ঢাকায়। বাড়ি নরসিংদী।
-তাই নাকি! আমি ঘোড়াশালে থাকি।
-আচ্ছা! আপনি ঘোড়াশাল থাকেন? আপনার বাসা কি নরসিংদীতেই?
-না, আমার বাসা খুলনা। চাকরিসূত্রে থাকছি।
অল্প কথোপকথন হলো দু’জনের মাঝে।
অচেনা পথের পানে তাকিয়ে ভাবছি কতক্ষণে দর্শনা বন্দরে পৌঁছাব। ১০-১৫ মিনিট পর পৌঁছালাম দর্শনা কাস্টমসে। ভ্যান থামাতেই কতগুলা লোক এসে ঘিড়ে ধরলো। আপনারা কার কাছে আসছেন? কারও সঙ্গে কথা হয়েছিলো কি? বুঝলাম তারা তথাকথিত দালাল শ্রেণির লোক।
অল্প টাকার বিনিময়ে সীমানা পেরোনোর উদ্দেশে আসা লোকেদের ইমিগ্রেশনের কাজে সহায়তা করে থাকে। আমি আর পাশের ওই সহযাত্রী, কারোরই আগ্রহ জাগলো না অপরিচিতদের হাতে নিজের মূল্যবান পাসপোর্টখানা তুলে দিতে।
অনেকটা নরমসুরেই বললাম, আমাদের লাগবে না। দরকার হলে আপনাদের সহায়তা চেয়ে নিব। তারা নানা ভাবে আমাদের গলাতে চেষ্টা করলো। আমরা দুজনেই নাছোড়বান্দা। কোনোভাবেই ওদের হাতে পাসপোর্ট দিব না।
কাস্টমসে পৌঁছাতে পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটা মতো বেজেছিলো। ৬টার আগে ইমিগ্রেশন শুরু হবে না জানতে পারলাম। আমরাও বসে রইলাম। যাত্রাপথ একই হওয়ায় পাশের সেই ভদ্রলোকটি আমার যোগাযোগ নম্বর চেয়ে নিলেন। আমিও নিলাম। ভদ্রলোকের নাম মোহাম্মদ আলী।
ভালোই হলো বিদেশ বিভূঁইয়ে অন্তত পরিচিত একজনকে পাওয়া যাবে বেশ কিছুক্ষণ। ওনি যাবেন শিয়ালদহ আমিও ওখানেই যাব বলে বেরিয়েছিলাম। পরে অবশ্য আমার গন্তব্য পরিবর্তন হয়ে দমদমে নির্ধারিত হয়। এসবই হয়েছে অনিকদার জন্য।
কলকাতার অনিক সেনগুপ্ত। সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ অনিকদা। বড্ড ভালো সরোদ বাজান। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিস্নাত রাতে দাদার সরোদ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি দমদমে থাকেন তাই আমাকে সেখানে নামতে হবে। ৬টা বাজতেই ইমিগ্রেশনের কাজ শুরু হলো। আমি আর আলী ভাই কাজ সেরে নিলাম।
আমার সব নথি ঠিকঠাক থাকায় ইমিগ্রেশনে কোনো বেগ পেতে হয়নি। দ্রুতই কাজ সেরে দেশ ছাড়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু বিপত্তি বাধালেন আলী ভাই। পেশাগত নথি নিয়ে একটু ঝামেলা হয়ে গেলো তার। দেরি হবে দেখে আমাকে আগে চলে যেতে বললেন। আমি লাইনে থাকতে থাকতেই কাজ সেরে চলে এলেন আলী ভাই। স্বস্তি পেলাম তাকে দেখে।
চেকিং শেষে সীমানা পার হলাম। মিনিট পাঁচেক নো ম্যানস ল্যান্ড দিয়ে হাঁটা পথ। তার পরেই ভারতীয় চেক পোস্ট। ভারতীয় সীমানায় প্রবেশের আগে অনিকদাকে বার্তা পাঠিয়ে রাখলাম। আনুমানিক সময়টা জানিয়ে দিলাম তাকে। তিনিই আমাকে আগামী কয়দিনের জন্য আতিথেয়তা করবেন।
সে-ই আমার এখানে একমাত্র ভরসা। সীমানা পেরোলেই দেশের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই আগেই সব বন্দোবস্ত করে নিলাম। চেকপোস্টে যেতে যেতে কিছু স্মৃতি ক্যামেরাবন্দী করে নিয়েছি। দু’পাশে বিশাল উঁচু কাঁটাতারের বিভেদ। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। একপাশে বাংলাদেশ আরেক পাশে ভারত।
চেকপোস্টে যেতেই চোখে পড়লো মানুষের সারি। ভিড় খুব বেশি না। আমার মতো অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে ইমিগ্রেশনের জন্য। আমাদের সেবায় বিএসএফের সৌজন্যে কিছু চেয়ার রাখা ছিল। তবে চেয়ারের থেকে মানুষের সংখ্যা ছিল ঢের বেশি। প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাদের দাঁড়িয়েই থাকতে হলো।
চেকপোস্টের কাজ শুরু হতে সময় নিলো বেশ। খানিক বাদেই বিএসএফের এক জওয়ান আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। কিছুটা দূরে একজনের কাছে গিয়ে তার ফোনটা ঘাঁটলেন। ভদ্রলোক মনে হয় ছবি তুলেছিলেন সেটা দেখতে পেয়েই জওয়ান খানিকটা তেড়েই আসলেন। দাঁড়িয়ে থেকে ছবিগুলো মুছে তারপর গেলেন।
বাকিরা ততক্ষণে সাবধান। ছবি তোলা যাবে না। বিএসএফের জওয়ানরা সবাই হিন্দিতে কথা বলে। তারা বাংলা বুঝেও না বলতেও পারে না। বাংলাদেশি সবাই কমবেশি হিন্দি বলতে না পারলেও বুঝতে পারে। এর মাঝে এক জওয়ান এসে আমাদেরকে বসার অনুরোধ জানালো।
সাইখ আল তমাল