নৈসর্গিক প্রকৃতি, স্বতন্ত্র সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা গন্তব্য। দক্ষিণ চীন সাগর বিধৌত দেশটির সীমানা বহু যত্নে আগলে রেখেছে ঘন সবুজ অরণ্যে ঢাকা সুউচ্চ পর্বতমালা।
চলুন, মালয়েশিয়ার জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান থেকে শুরু করে সেখানে ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
মালয়েশিয়ার জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান
কুয়ালালামপুর শহর
মালয়েশিয়ার অভিজাত সভ্যতার সম্মুখীন হতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে রাজধানী কুয়ালালামপুর। এখানেই অবস্থিত দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। ১ হাজার ৪৮৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৮৮ তলার এই স্থাপনা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু জোড়া অট্টালিকা। এর ভেতরে উপভোগের জন্য রয়েছে স্কাই ব্রিজ, অবজারভেশন ডেক ও গিফট শপ।
কুয়ালালামপুরের অন্যান্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে কেএল বা কুয়ালালামপুর টাওয়ার, সুলতান আব্দুল সামাদ ভবন ও বাতু গুহা।
ল্যাঙ্কাউই দ্বীপ
মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ল্যাঙ্কাউই দ্য জুয়েল অফ কেদাহ নামে পরিচিত। এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হলো কেবল কার রাইডিং। এটি যাত্রীদের নিয়ে যায় গুনুং মাত চিনচ্যাং পর্বতের একদম শিখরে, যেখানে অবস্থিত ল্যাঙ্কাউই স্কাই ব্রিজ।
ল্যাঙ্কাউই দ্বীপ। ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া
এই ব্রিজে নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদাভাবে স্কাইগ্লাইড নামে একটি বাঁকানো লিফটও আছে। কেবল কারের যাত্রাটি শুরু হয় উপকূলবর্তী এক গ্রাম থেকে। সেখানে আর্ট ইন প্যারাডাইস নামের ত্রিমাত্রিক আর্ট মিউজিয়ামসহ রয়েছে নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক স্থাপনা।
ক্যামেরন হাইল্যান্ডস
পাহাং রাজ্যের সবচেয়ে ছোট পৌরসভা ক্যামেরন হাইল্যান্ডস মালয়েশিয়ার প্রাচীনতম দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি। এখানে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম চা বাগান বোহ টি-এস্টেট। একই সঙ্গে এটি দেশের ব্ল্যাক টি-এর বৃহত্তম প্রস্তুতকারকও। এই এস্টেটের সুঙ্গেই প্যালেসটি পর্যটকদের সবচেয়ে পছন্দের। এখানকার মনোরম টি হাউজে চা খেতে খেতে উপভোগ করা যায় চারপাশের শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য।
ক্যামেরন হাইল্যান্ডের সবচেয়ে প্রাচীন অরণ্য হচ্ছে শ্যাওলা বন। শ্যাওলা আচ্ছাদিত দুর্লভ গাছগুলোকে দেখে মনে হয়, এ যেন এক জাদুর বন।
এখানে ১০টিরও বেশি হাইকিং ট্রেইল রয়েছে। ট্রেইল ৬ ও ট্রেইল ১০ এর পথ দুটো নিয়ে যায় তানাহ রাতার কাছে গুনুং জাসার পাহাড় চূড়ায়। পাহাড়ের ওপার ঢাল বেয়ে পথ নেমে গেছে ভারত চা বাগানের ক্যামেরন উপত্যকায়।
কিনাবালু পাহাড়
সাবাহ রাজ্যের পশ্চিম উপকূলের রানাউ জেলায় অবস্থিত কিনাবালু মালয়েশিয়ার সর্বোচ্চ পাহাড়। ১৩ হাজার ৪৩৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই পাহাড় পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ দ্বীপ। এখানকার জীববৈচিত্র্যের আধার কিনাবালু পার্ক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুরক্ষিত হয়ে আছে।
দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই অভয়ারণ্যে রয়েছে বিখ্যাত ওরাঙওটান এবং দৈত্যাকার ফুল র্যাফলেসিয়া। এ ছাড়াও পাহাড়ের সঙ্গে মিশে থাকা কিংবদন্তি ও লোককাহিনীগুলোও এক অদম্য আকর্ষণে কাছে টানে পর্যটকদের।
মালাক্কা ও জর্জের পুরাতন শহর (পেনাং)
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান মালাক্কা প্রণালীর ভেতরে পড়েছে দুইটি অঞ্চল। একটি পেনাং রাজ্যের রাজধানী জর্জ টাউনের ২ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটার। আরেকটি মালাক্কা রাজ্যের রাজধানী মেলাকা টেঙ্গাহ জেলার মালাক্কা শহর।
দক্ষিণ-পশ্চিমে সুমাত্রা দ্বীপ এবং উত্তর-পূর্বে মালয় উপদ্বীপ; এর মাঝের ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ জলাশয়টিই মূলত মালাক্কা প্রণালী। এটি ৬৫ থেকে ২৫০ কিলোমিটার চওড়া হয়ে আন্দামান সাগরকে সংযুক্ত করেছে সিঙ্গাপুর প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরের সঙ্গে। আর এই প্রণালীর দুপাশের লোকালয়টিই মালাক্কা প্রণালী নামে অঙ্গে ধারণ করে আছে পূর্ব ও পশ্চিমের ৫০০ বছরের ইতিহাস।
এর চিত্তাকর্ষক নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে জর্জ টাউনের গডেস অফ মার্সি টেম্পল, কাপিতান কেলিং মসজিদ এবং শ্রী মহামারিয়াম্মান টেম্পল।
মালাক্কা শহরের পর্যটনকেন্দ্রগুলো হলো পোর্টা দে সান্তিয়াগো, জোঙ্কার ওয়াক, লিটল ইন্ডিয়া, পর্তুগিজ সেটেলমেন্ট, স্ট্যাডথুইস, মেরিটাইম মিউজিয়াম, মালাক্কা সালতানাত প্যালেস মিউজিয়াম এবং টেমিং সারি টাওয়ার।
মালয়েশিয়া ভ্রমণের সেরা সময়
কুয়ালালামপুর ভ্রমণের জন্য সেরা সময় হচ্ছে শীতকাল। বিশেষ করে এখানকার থাইপুসাম উৎসবে অংশ নিতে হলে অবশ্যই জানুয়ারি মাসে যেতে হবে। একদম সকাল সকাল হাজির হয়ে যেতে হবে শ্রী মহামারিয়াম্মান মন্দিরে।
পশ্চিম উপকূলের ল্যাঙ্কাউই, কিনাবালু পাহাড় ও পেনাং এর জন্য ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা সবচেয়ে ভালো। এই মাসগুলোতে আবহাওয়া শুষ্ক এবং রৌদ্রোজ্জ্বল থাকে।
মালাক্কা প্রণালীতে বছরের যে কোনো সময়ই যাওয়া যেতে পারে। একইভাবে ক্যামেরন হাইল্যান্ডসেও পর্যটকদের ভীড় থাকে সারা বছর ধরেই। বৃষ্টিপাতের সময়টা এড়ানোর ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল এবং জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়টা উপযুক্ত হবে।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার উপায়
ভিসা প্রক্রিয়া
মালয়েশিয়ায় ঘুরতে যাওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ভিজিট বা ট্যুরিস্ট ভিসা নিশ্চিত করা। এই ভিসার আবেদনের জন্য যা যা প্রয়োজন তা হলো-
রিটার্ন ফ্লাইট টিকিট
এই ভিসার মাধ্যমে বাংলাদেশি পর্যটকরা সর্বোচ্চ ৩০ দিন মালয়েশিয়া ভ্রমণের অনুমতি পাবেন। বাংলাদেশি দর্শনার্থীদেরকে মালয়েশিয়ায় ভ্রমণের জন্য মালয়েশিয়া ডিজিটাল অ্যারাইভাল কার্ড (এমডিএসি) নিতে হবে। এর জন্য দেশটিতে পৌঁছার ৩ দিন আগেই অনলাইনে এমডিএসির জন্য আবেদন করে রাখতে হবে। সরাসরি এমডিএসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যেয়ে এই আবেদন করা যাবে।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়ার উপায়
মালয়েশিয়ার পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘুরতে হলে বাংলাদেশ থেকে কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড দিয়ে যাওয়া যায়। তবে ঢাকা থেকে কলকাতার ট্রাঞ্জিট নিয়ে গেলে উড়োজাহাজ ভাড়া অনেকটা কমানো যায়।
চলুন, ৩ মাস আগে থেকে ফিরতি টিকিটসহ এই পথের সম্ভাব্য খরচাদির ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।
ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত বিমান ভাড়া সর্বনিম্ন ৩৩৯ মার্কিন ডলার (১ মার্কিন ডলার = ১০৯ দশমিক ৮৭ বাংলাদেশি টাকা) বা প্রায় ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা।
মালাক্কা ও জর্জ টাউন দেখতে যেতে একই রুটে টিকিট কাটতে হবে পেনাং পর্যন্ত। এখানে খরচ হবে ৩৭৭ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪১ হাজার ৪২৩ টাকা।
একইভাবে ল্যাঙ্কাউই এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ভাড়া ৪০০ মার্কিন ডলার বা ৪৩ হাজার ৯৫০ টাকা।
ক্যামেরন হাইল্যান্ডসের ক্ষেত্রে উড়োজাহাজে কুয়ালালামপুর গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে করে কেএল সেন্ট্রাল যেতে হবে। তারপর ট্রেন বদলে আরেক ট্রেনে ক্যাম্পার এসে ট্যাক্সি করে সোজা ক্যামেরন হাইল্যান্ড্স।
কিনাবালু পাহাড়ে চড়তে হলে কটা কিনাবালুর প্লেন ধরতে হবে। এই যাত্রায় খরচ হতে পারে সর্বনিম্ন ৪৪৩ মার্কিন ডলার বা ৪৮ হাজার ৬৭৫ টাকা।
শহরের অভ্যন্তরে স্থানীয় যানবাহনগুলোতে গড়পড়তায় খরচ দিনপ্রতি ৫৬ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা ১ হাজার ২৮৪ টাকা (১ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত = ২২ দশমিক ৯২ বাংলাদেশি টাকা)।
মালয়েশিয়া ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
কুয়ালালামপুর শহরে বাজেট হোটেলগুলো পাওয়া যাবে বুকিত বিন্তাং-এ। এখানে একজন ব্যক্তির জন্য সর্বনিম্ন গড়ে ১৪ মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৫৩৭ টাকা খরচ হতে পারে। দুই তারকার হোটেলগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ২৭ মার্কিন ডলারে (প্রায় ৩ হাজার টাকা) রাতযাপন করা যেতে পারে।
ক্যামেরন হাইল্যান্ডস ভ্রমণের সময় স্বল্পমূল্যে আবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে তানাহ রাতা এবং ব্রিঞ্চ্যাং নামক জায়গাগুলোতে। পেনাং-এর জন্য জর্জ টাউন, আর কটা কিনাবালুতে জালান গয়া ও গয়া মার্কেট এলাকার কাছের হোটেলগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে রাতযাপন করা যাবে।
মালয়েশিয়ায় খাবার বাবদ একজনের দিনপ্রতি খরচ হতে পারে সর্বনিম্ন ৮৭ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, যা প্রায় ২ হাজার টাকার সমান।
কুয়ালালামপুরের জালান আলো স্ট্রীট ফুডের জন্য বিখ্যাত। এখানে পাওয়া যাবে গ্রিল ফিস, সাতে, রাইস পুডিং সহ নানা স্থানীয় ও চাইনিজ খাবার।
মালয়েশিয়াতে ডুরিয়ান নামক এক ফল আছে, যা দিয়ে বিভিন্ন চকলেট, কেক, কুকিজ, কফি এমনকি আইসক্রিমও বানানো হয়। এটি দেখতে অনেকটা কাঁঠালের মতো।
মালয়েশিয়ার বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে সমুচার মতো কারিপাফ, নারকেলের দুধে রান্না করা ভাত বা নাসি লেমাক, আসাম লাক্সা নুডুল্স এবং সবজি রোল বা পপিয়াহ।
মালয়েশিয়া ঘুরে বেড়ানোর সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও কিছু টিপস
পরিশিষ্ট
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, ল্যাংকাউই দ্বীপ, ক্যামেরন হাইল্যান্ড্স, কিনাবালু পাহাড়, এবং মালাক্কা ও জর্জ টাউনের প্রতিটিই এক বৈচিত্র্যপূর্ণ মালয়েশিয়ার পরিবেশনা। শীত বা বসন্ত কিংবা শরতের যে কোনো একটি সপ্তাহই যথেষ্ট এগুলোর যে কোনোটিকে স্মৃতি হিসেবে পাওয়ার জন্য। রিটার্ন টিকিটে ফেরার তাড়া থাকলেও বাজেটের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় স্বস্তির দেখা মিলবে পূর্বপরিকল্পনা ও সতর্কতার কথা ভেবে। আগে থেকে ঠিক করা হোটেলে ওঠার সময়েও মিলবে এই অনুভূতি।
পরিশেষে স্যুভেনির নিয়ে আসতে ভুলে গেলে তার পুরোটাই পুষিয়ে দেবে পাখির চোখে শহর দেখা, পাহাড় ট্রেকিং আর উপকূলীয় খাবারের স্বাদ। আর দর্শনীয় জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর সময় ক্যামেরার ফ্রেমে ধারণ করা মুহূর্তগুলো তো থাকছেই।