একসময় ইউরোপের কথা শুনলেই প্রথমে ইতালির কথা মনে ভেসে আসতো। কেননা ইংল্যান্ডের পরে ইউরোপের কোনো দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি আছে দেশটিতে। নিরাপদ ও সহজ অভিবাসন এবং সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে ইতালির বিভিন্ন শহর।
আমার ঘুরে বেড়ানোর চরম নেশা সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই ইউরোপে বিগত চার বছরে প্রায় ১৫টি দেশের পঞ্চাশের বেশি শহর ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। বিভিন্ন দেশে একাধিকবার ভিন্ন ভিন্ন শহরে আমার যাওয়া হয়েছে। ইতালিও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবছরের শুরুতে বিশ্বের প্রাচীনতম নগরী ইতালির রাজধানী রোম শহর ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। আর বছরের শেষে অন্য দুই শহর বাণিজ্যিক নগরী মিলান এবং পর্যটন নগরী ভেনিস ভ্রমণের মাধ্যমে ষোলোকলা পূর্ণ হলো।
সাংবাদিকদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আমরা পর্তুগাল থেকে ছয় জনের একটি টিম মিলান যাওয়ার পরিকল্পনা করি। একপর্যায়ে সদস্যের সংখ্যা বেড়ে দশে পৌঁছলো। মিলান যাবো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কিন্তু আমরা ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করি ভেনিসে। তাই পর্তুগালে থাকা অবস্থায় মিলান থেকে ভেনিসের ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করি। কিন্তু শেষ পর্যায়ে আমরা ছয় জন মিলান যাই এবং আমাদের মধ্যে পাঁচ জন ভেনিসে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
আমাদের ট্রেন দশ মিনিট আগে প্লাটফর্মে এসে পৌঁছায় এবং আমরা সবাই চটজলদি তাতে উঠে পড়ি। এর আগে স্টেশনে আমরা ইতালিয়ান কোরাসাও এবং কাপাচিনো দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। মিলান থেকে ভেনিস প্রায় ২৭০ কিলোমিটার। যা হাইস্পিড বুলেট ট্রেন দিয়ে দুই ঘণ্টায় পাড়ি দিলাম। কিছু কিছু জায়গায় ট্রেনের গতি ডিজিটাল পর্দায় তিনশ’ কিলোমিটারের বেশি দেখাচ্ছিল। কিন্তু ভেতর থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, এত প্রচণ্ড গতিতে ট্রেন ছুটে চলছে।
জীবনে প্রথম বুলেট ট্রেনের অভিজ্ঞতা হলো ভেনিস ভ্রমণের মাধ্যমে। ট্রেন সরাসরি ভেনিসের কেন্দ্র পর্যন্ত ছুটে যায়। স্টেশন থেকে বের হলেই চোখে ধরা পড়বে ভেনিসের চিরচেনা সেই দৃশ্য! আঁকাবাঁকা বয়ে চলা অসংখ্য খাল যার উপরে ছোট ছোট নয়নাভিরাম ব্রিজ এবং প্রকৃতির খাল দিয়ে বয়ে চলছে হরেক রকমের নৌযান, লঞ্চ এবং পর্যটকের জন্য বিলাসবহুল প্রমোদতরী। প্রথম দেখাতেই যে কারোরই মন ভরে যাবে এসব নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে।
ভেনিসের গঠন মূলত শহরটিকে আলাদা করে তুলেছে। যা শহরটিকে বিশ্বের সেরা সুন্দর শহরের তকমা দিয়েছে। একশ’ সতেরোটি দীপপুঞ্জ নিয়ে এক হাজার পাঁচশ বছর আগে গড়ে ওঠা শহরটিতে একশ’ পঞ্চাশটির বেশি খাল রয়েছে। যার ওপর প্রায় চারশটি ব্রিজ রয়েছে মানুষ চলাচলের জন্য। এসব কারণে শহরটি অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় আকর্ষণীয়। যদিও এই অপূর্ব সুন্দর শহরটি প্রতি একশ’ বছরে ৮ ইঞ্চি করে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগে ভ্রমণার্থীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছে।
ভেনিস শহরটির একাধিক উপাধি রয়েছে। তাই দীর্ঘদিন ধরে তা দেখার প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু আমার কাছে সব উপাধি ছাড়িয়ে এককথায় বলতে পারি, স্রষ্টার বিস্ময়কর সৃষ্টি। জলের সঙ্গে মানুষের বসবাস! শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও এটিই এখানে বাস্তবতা। শুরুতে বিষয়টি কিছুটা অবাক মনে হলেও পরে অনুধাবন করি, মানুষের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।
মানুষ সেই অরণ্যে থেকে হিমালয়, মরুভূমি থেকে উত্তর মেরু-সব জায়গায় নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সাগরতীরে ভাসমান একটি শহরে হাজার বছর ধরে মানুষের বসবাস সত্যি অসাধ্য সাধন বটে। আর তাই তো এমন দৃশ্য দেখতে প্রতি বছর ভিড় জমায় লক্ষ-কোটি পর্যটক। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকষর্ণীয় এবং বিশ্ব ঐতিহ্য স্বীকৃত এই শহরটি কোটি মানুষের পদচারণায় অন্যতম ব্যয়বহুল শহরের তকমা পেয়েছে ইতোমধ্যে।
এখানে পর্যটকদের জন্য ঘুরে বেড়ানোর বেশ কিছু স্থান রয়েছে। তার মধ্যে বেসিলিকা ডি সান মার্কো, ডোজের প্যালেস, ডরসডুরো, গন্ডোলা রাইড, রিয়াল্টো মার্কেট, জাদুঘর ও গির্জা ট্রেলিং, লা ফেনিস থিয়েটার, মুরানো, বুরানো, তুরসেলো দ্বীপপুঞ্জ এবং লিডো সী বিচ। মোটামুটি তিন দিনের ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে সব স্থান পরিদর্শনের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু আমাদের মাত্র একদিনের স্বল্প সময়ের ট্যুর!
মিলান থেকে ট্রেনে চড়ার আগে আমাদের একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিলো আমরা ভেনিস আসছি। অনেকেই আমাদের কল এবং মেসেজ পাঠিয়েছে এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য। ভেনিসে প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে। যাদের বেশিরভাগ কাজ করছে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এবং ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট খাতে। দেশীয় ভাইদের অতিথিপরায়ণতা দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম। কিন্তু সময়ের অভাবে অনেকের সাথে দেখা করা সম্ভব হয়নি।
সিনিয়র এক ভাই যিনি একসময়ে পর্তুগাল ছিলেন। বর্তমানে ভেনিসে ব্যবসা করছেন। তার অনুরোধে আমরা তৃতীয় স্টেশন নেমে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। আমি সাধারণত কোথাও ভ্রমণে গেলে সেখানকার স্থানীয় খাবার খেতে পছন্দ করি। আর ইতালিয়ান ফিজা বিশ্বের সেরা। অসংখ্য স্বাদের ফিজা পাওয়া যায় এখানে, যা ভীষণ সুস্বাদু। তাই আমরা সবাই পছন্দসই ফিজা এবং কফি খেলাম সেই ভাইয়ের সাথে দেখা করে।
তারপর আবার অপেক্ষা পরবর্তী বোট ধরে সামনের অজানাকে জানা এবং অদেখাকে দেখার। খালের পাশের প্রতিটি বাড়ির সামনে রয়েছে হরেক রকমের নৌকা, স্পিডবোটসহ বিভিন্ন ধরনের জলযান। নিয়মিত লঞ্চ সেবার পাশাপাশি প্রত্যেকে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় এসব জালযানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন তাদের নিত্যদিনের যাতায়াতের জন্য।
ভেনিসে সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। কারণ এ সময়টাতে ইউরোপে সামার টাইম থাকে। ফলে আবহাওয়া বেশ চমৎকার হয়। তাছাড়া এ সময়ে সামার ভেকেশনের ফলে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে এবং সবাই ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। ভেনিসে প্রতি বছর প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ বেড়াতে যায়। যেখানে শহরটিতে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ। যা দেশটির আয়ের বিশাল একটি খাত। আমরা যখন ভ্রমণে এলাম; তখন আবহাওয়া বেশ খারাপ। মাত্র কয়েক দিন আগে এখানে প্রচণ্ড জোয়ারের ফলে পুরো শহর পানির নিচে তলিয়ে যায়।
তাছাড়া এসময়ে শীতের পাশাপাশি প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়। ভেনিস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক ফুট উপরে অবস্থান করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শহরের তালিকায় ভেনিসের অবস্থান সামনের দিকে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে শহরটির অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়।
সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমরা তাই বিকেল চারটায় দুপুরের খাবারের জন্য রেস্টুরেন্টে বসলাম সিটি সেন্টারে বাস স্টেশনে। দুটি ফিজা ও পাঁচটি ঠান্ডা পানীয় আমাদের বিল এলো ৭০ ইউরো। আগেই বলেছিলাম শহরটি বেশ ব্যয়বহুল। আমাদের ফিরতি ফ্লাইট ছিল রাত আটটায়। তাই খাবার শেষ করে বাসে চড়ে বসলাম। এখানে বলে রাখি, সারাদিনের জন্য সংগ্রহ করা টিকিট এয়ারপোর্টের বাসে কাজ করে। তাই জনপ্রতি বাড়তি ৬ ইউরো দিয়ে টিকিট করতে হয়নি। সিটি সেন্টার থেকে সরাসরি মিনিট বিশেকের দূরত্বে মার্কো পোলো বিমানবন্দর। এবার লিসবন, দ্বিতীয় বাড়িতে ফেরার পালা!