যতই বিশ্বকাপে হারুক ব্রাজ়িল, ফুটবল মানেই যে ব্রাজ়িল, ফুটবলের শিল্প মানেই যে সে দেশ, তা দেখে এলাম কিছুদিন আগে রিও-তে গিয়ে। বিকেলের রিও-র কোপাকাবানা বেলাভূমি দেখলে মনে হবে, এ বুঝি ফুটবল, ভলিবলের অনুশীলনের মাঠ। সমুদ্রের ধারে ফুটপাতের উপর তৈরি করা সুদৃশ্য বসার জায়গার একটাতে বসে পড়েছিলাম খেলা দেখব বলে। অবাক হয়ে দেখছিলাম হিল আর ইনস্টেপ ড্রিবলিং-এ ওদের পায়ের ম্যাজিক। ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত গেল অতলান্তিকের ওপারে। অমনি পটপট আলো জ্বলে উঠল অন্ধকারের গায়ে। ফুটবল, ভলিবল অনুশীলন চলতেই থাকল অবিরত। কোপাকাবানা সমুদ্রের তীর এক আজব জায়গা। ফুটবল, ভলিবল ছাড়াও বিস্তৃত বেলাভূমি জুড়ে হরেকরকম শরীরচর্চার আয়োজন। জগিং, বৈকালিক হাঁটা তো আছেই। এ ছাড়াও শরীরচর্চা
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি থেকে প্রশিক্ষক এসে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার অভ্যেস ও আরও নানারকম দড়ির খেলা শেখাচ্ছেন ছোটদের। বড়রাও নানা সাজ-সরঞ্জাম এনে নানা ধরনের অ্যাক্রোব্যাটিক্স অনুশীলন করছে। আমরাই কেবল বালির বিচ ধরে অলস পায়ে হাঁটছি। সন্ধের আলো জ্বলে উঠলেই রঙিন হয়ে ওঠে সমুদ্রের ধারে সাদা-কালো মার্বেলের বিশাল চওড়া ফুটপাত। ফুটপাতের উপরেই সাইকেল, রোলার স্কেটিং আর জগিং করার র্যাম্প পরপর। তারপর গাড়ি চলার রাস্তা। সাদা-কালো ঢেউ খেলানো এই নকশা রিও শহরের বৈশিষ্ট্য। শহর জুড়ে সব দ্রষ্টব্য স্থান বা সুভেনিয়র শপে বিভিন্ন হাতের কাজের জিনিসেও এই নকশা আঁকা। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পা আটকে গেল অপূর্ব সঙ্গীতের সুরমূর্ছনায়। এক ওপেন-এয়ার রেস্তরাঁয় ‘বাইপিরিনহা’ নামের পানীয় আর সি-ফুড ভাজা নিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে কয়েকজন। তাদের গান শুনিয়ে মনোরঞ্জনে ব্যস্ত এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। ওর চাঁপার কলির মতো আঙুল ঝংকার তুলছে কোলের উপর রাখা গিটারের তারে।
চলতে চলতে তেষ্টা পেলে কোক পেপসির বদলে রাস্তার ধারে সফিস্টিকেটেড ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হওয়া নারকেলের মিষ্টি জল পান করতেই দেখছি বেশির ভাগ মানুষকে। আবার কারও কারও হাতে টক-মিষ্টি স্বাদের গুয়ানারা ফলের রস। বোঝা যায় স্বভাবতই স্বাস্থ্য সচেতন এখানকার মানুষ। ‘চুরোস’ নামের ভিনিগারে ভেজানো ভুট্টা সেদ্ধ আর ‘ট্যাপিওকা’ ভাজাও বেশ বিক্রি হচ্ছে রাস্তার ধারের ঠেলায়। এক রেস্তরাঁর দেখি বাজনার তালে তালে সাম্বা নাচ চলছে। সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওদের পায়ের দিকে। একটু এগিয়ে রাস্তার ধারে এক বেঞ্চের ওপর বসে তিন আফ্রিকান শিল্পী ড্রামবাদ্য বাজাচ্ছেন। কী অপূর্ব তালের সমন্বয় ঘটছে তিনজনের মিলিত বাজনায়। আমরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন বাদকের দল।
অতলান্তিকের সুনীল বিস্তার, সোনালি তটরেখা আর সবুজ পাহাড়ের সারির ঠিক মাঝে রিও ডি জেনেইরো। সত্যিই অপরূপা। ব্রাজিলিয় উচ্চারণ ‘হিও ডি জেনেইরো’। ‘হিও ডি জেনেইরো’-র অর্থ River of January (‘হিও’-র অর্থ নদী)। আঁদ্রে গনকাভস নামে এক পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন গুয়ানাবারা উপসাগরের দিকে তাঁর জাহাজ চালিয়ে আসছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল তিনি এক বিশাল নদীর মোহনায় এসে পৌঁছেছেন। দিনটা ছিল ১৫০২ সালের পয়লা জানুয়ারি। সেই থেকে এই শহরের নাম রিও ডি জেনেইরো। তারপরের ইতিহাস বলে এখানে ফরাসি, স্প্যানিশ এবং শেষে পর্তুগিজ উপনিবেশের গল্প। তাই এ শহরে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার।
আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে রিও শহরের যে কোনও জায়গা থেকে দেখা যায় আলখাল্লা পরা দু’দিকে দু’হাত ছড়ানো ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’-এর অতিকায় সাদা মূর্তি। কোরকোভারে পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় ৩০০ মিটার উঁচু, ১০০০ মেট্রিক টন ওজনের এই মূর্তিটি বসানো হয়েছিল ব্রাজ়িলের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে। স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন, দু’ হাত ছড়ানো যিশুর মূর্তিটি রিও শহরবাসীকে সব অশুভের হাত থেকে আড়াল করে রেখেছে। এক রৌদ্রজ্জ্বল ঝকঝকে দিনে কোপাকাবানা বেলাভূমির হাতছানি এড়িয়ে রওনা দিলাম কোরকোভাদের অভিমুখে।
ছোট্ট দু’কামরার লাল রঙের টয় ট্রেন উঠতে লাগল জঙ্গুলে পথ বেয়ে পাহাড়ের চূড়োর দিকে। পাশে পাশে চলেছে গাড়ি চলার পিচরাস্তা। দেখি পাহাড়ের গায়ে গাছে গাছে কাঁঠাল ফলে আছে। ছোট সরু একটা স্টেশনে এসে দাঁড়াল ট্রেন। সেখান থেকে ভলভো বাসে আরও কিছুদূর। কোরকোভাদো মূর্তির মূল চাতালে নেমে লিফট এবং চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে একেবারে মূর্তির পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। দু’হাত ছড়ানো বিশাল। মূর্তিটির স্থাপত্যে সূক্ষ্ম কারুকার্য তেমন নজরে পড়ল না। বিভিন্ন দেশ, ভাষা, পোশাকের অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়, চাতালের পাঁচিলে একবার গিয়ে দাঁড়ালেই চোখের সামনে খুলে যায় এক অনন্যসাধারণ দৃশ্য। দৃষ্টি চলে যায় বহুদূর। চোখ আটকে গেল অতলান্তিকের অতল সুলেখা নীলে। রিও শহর তার উজাড় করা সৌন্দর্য নিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠল একপলকে। অদূরে দেখা গেল রিও-র বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়াম, সুগার লোফ মাউন্টেন আর গুয়ানাবারা উপসাগর, যার ঘাটে ঘাটে বাঁধা আছে অজস্র ছোট ছোট রঙিন নৌকা।
একটা ছোট পাহাড়ের গায়ে কাবানাকোপা হস্টেলে আমরা চারদিনের অতিথি। ব্রেকফাস্টের সময় ‘নমস্তে’ শুনে চমকে উঠলাম। সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে এক মিষ্টি মেয়ে। আলাপ হল। নাম পাওলা জিরাল্ডো, কলম্বিয়ায় বাড়ি। আমি ভারতীয় এবং কলকাতাবাসী শুনে উচ্ছ্বসিত পাওলা আমাকে ‘হাগ’ করে গালে চুমু খেল। বলল, ক্যালকাটা ফেমাস সিটি। পাওলা বলতে লাগল, তোমার দেশের যোগশাস্ত্র ও আধ্যাত্মবাদের দর্শন আমাদের নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। ওদের দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতি আকাশছোঁয়া। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষজন। পাওলা, ওর বাবা অক্টিভিও আর মা বার্থা ওদের বাড়ির কাছে ভারতীয় যোগ ও দর্শনের ক্লাসে নিয়মিত যায়।
কোবানাকোপা হস্টেলে সবসময় একটা ফেস্টিভ মুড। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অধুনিক প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে এখানে। রাত বারোটা একটা পর্যন্ত সরগরম জায়গাটা। হস্টেলের পাশেই একটা বিরাট ন্যাশনাল পার্ক। পার্ক না বলে অবশ্য জঙ্গল বলাই ভাল। পার্কে ছোট ছোট দোলনা, ছোটদের খেলার নানারকম সাজ-সরঞ্জাম যেমন আছে, তেমন আবার একদিকে ঘন জঙ্গল। একদিন সকাল সকাল গিয়ে দেখি সামনের গাছটায় গিজগিজ করছে বেশ বড় সাইজের কাঠবিড়ালি। গাছের ডাল থেকে ঝোলা লম্বা ডোরাকাটা লেজ দেখে বেশ আশ্চর্য হলাম। কাঠবিড়ালির এত লম্বা লেজ? এর মধ্যে দেখি তারা লম্বা লম্বা লাফে গাছে গাছে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সন্দেহ হতে বাইনোকুলার চোখে ঠেকালাম। ওমা, ছোট ছোট মুখগুলো কেমন মানুষ মানুষ। যেন গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনেক বুজে মানুষের মুখ। কানের দু’পাশে আবার দু’গোছা ঝাঁটাকাঁটা কেশর। এবার চিনতে পারলাম। এরা দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত মারমোসেট বাঁদর। কেউ খাবারের টুকরো ছড়ালেই তরতর করে দলে দলে নেমে আসছে গাছ বেয়ে। কিন্তু কাছে যাওয়ার উপায় নেই। অমনি সরসর করে উঠে গিয়ে লম্বা লম্বা লেজ ঝুলিয়ে বসে পড়ছে গাছের ডালে।
পরদিন প্রাতরাশের পরই রওনা দিলাম কোপাকাবানা। বিচের আকর্ষণে, সারাদিন সমুদ্রকে উপভোগ করব বলে। ফুটপাথের সাদা-কালো মার্বেলের ঢেউ পেরিয়ে সোনালি উত্তপ্ত বালিতে পা রাখতেই দেখি বালুকাবেলা জুড়ে রংবেরঙের ছাতার মেলা। এক জায়গায় বালির বিচের উপর বিশাল এক নকল বালির কেল্লা। আবার কোথাও দু’হাত ছড়ানো ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’-এর বালু-ভাস্কর্য। খুব নিপুণ এবং নিখুঁত এই শিল্প। শিল্পীর পাশে একটি পয়সা ফেলার বাক্স। সার সার নারকেল গাছ সবুজ শীতল ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে বালির আঁচলে। স্পেশ্যাল কাট-এর ব্রাজিলিয় বিকিনি পরিহিত সুন্দরী রমণীরা সমুদ্রের ঢেউয়ের উল্লাসে মেতেছে। অতলান্তিকের বিশাল বিশাল নীল ঢেউ যেয়ে এসে সজোরে আছড়ে পড়ছে সাদা ফেনায়।
আর তার সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে কচিকাঁচা-বুড়োবুড়ির দল। কারওর কারওর পিঠ, হাত জুড়ে নানারকম ট্যাটু আঁকা। নৌবাহিনীর টুকটুকে লাল রঙের একটা হেলিকপ্টার মাঝে মাঝে গভীর চক্কর যাচ্ছে মাথার উপর। নজর রাখছে কেউ যাতে সমুদ্রের বেশি গভীরে গিয়ে বিপদে না পড়ে। কেউ কেউ বিকিনি পরেই চোখে রোদচশমা, পায়ে কেডস পরে, কানে ইয়ারফোন এঁটে হনহন করে হেঁটে শরীরচর্চা সেরে নিচ্ছে। এইসময় একটা মজার ঘটনা ঘটল। আমি ভারতীয় সাঁতার পোশাকে বসে আছি বালির উপর। মেপে নিচ্ছি ঢেউগুলোকে। হঠাৎ দেখি রোদচশমা পড়া সাদা চামড়ার এক সাহেব আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, “মাদাম, আর ইউ অ্যালোন? ডু ইউ লাইক তু সুইম উইথ মি?” আচমকা এমন বিচিত্র আমন্ত্রণে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দেখি উনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে একটু দূরে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলাম, “এই আমার পতি, পুত্র। আমি এখনই যোগ দেব ওদের দলে।”
“ওকে দেন, গুড বাই…” সাহেব হ্যান্ডশেক করে চলে গেলেন।
কলকাতা থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের কলকাতা-দুবাই, দুবাই-রিও কানেক্টিং ফ্লাইট আছে। অন্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটেও যেতে পারে।
রিও যাবার সবচেয়ে ভাল সময় ও দেশের শীতকালে, অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর, যখন অপমাত্রা ২৫ থেকে ২০০ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করবে। এ সময়টা খুবই আরামদায়ক।
ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিন অবশ্যই নিয়ে নিতে হবে যাবার আগে। রিও বেড়াতে গেলে মন-মাতাল করা সুগন্ধী কফি আনতে ভুলবেন না। ডাস্ট, বিনস দু’রকমই পাওয়া যায়।