নদী, পাহাড়, সমুদ্র আমাকে সবসময়ই রোমাঞ্চকর- নতুন প্রেমিকার মতো। ভ্রমণ একটা ওষুধ, যা মনকে সুস্থ রাখে। যখনই সুযোগ পাওয়া যায় ঘুরে বেড়ানোর তখনই নদী, পাহাড় ও সমুদ্রে চলে যাওয়ায় হয়। ট্রাভেল বাংলাদেশের পাঠকদের আজ এক ভ্রমণপিপাসুর সাজেক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হবে তারই ভাষ্যে।
সাজেক মেঘ-পাহাড়ের রাজ্য! যেখানে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘের সমুদ্রে সাঁতার কাটা যায়। গল্প শুনেছি, উপলব্ধিও করেছি। তবে, যাওয়া হয়নি। পার্বত্য অঞ্চলের সব জায়গায় মোটামুটি ঘুরে বেড়িয়েছি। সাজেক যাব যাব করেও ব্যাটে-বলে মেলেনি। তাই সাজেকের উদ্দেশে খাগড়াছড়ি চলে গেলাম। বন্ধু ইকতারুলের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। সে বলল, বন্ধু, তুই আজ রাতটা খাগড়াছড়ি থাক। কাল আমি আসছি, একসঙ্গে সাজেক যাব। মজার ব্যাপার হলো, ইকতারুল মাসের ১৫ দিনই সাজেক থাকে। সকালে খাগড়াছড়ির শাপলা মোড় থেকে দীঘিনালার উদ্দেশে রওনা করলাম ।
দীঘিনালা থেকে নাম এন্ট্রি করে সকাল ১০টার এস্কর্টে সাজেকের পথ ধরলাম। সাজেক যাওয়ার একটাই সময়- সকাল ১০টা। আর্মির পাহারায় একসঙ্গে সব গাড়ি সারিবদ্ধভাবে যায় সাজেকের পথ ধরে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে চলছে আমাদের চাঁদের গাড়ি। কখনও আকাশের দিকে উঠতে থাকে তো আবার কখনও নিচে নামতে থাকে। মাঝে মধ্যে পাহাড়ের বাঁকে খুব সামনের পথও দেখা যায় না। মনে হয়, এই বুঝি পাহাড়ের খাদে পড়ে যাচ্ছি।
সাজেক যাওয়ার এই জার্নিটা ঠিক রোলার কোস্টার রাইডের মতো অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর। সারাজীবন আপনাকে মনে রাখতে বাধ্য করবে। সাজেক যাওয়া-আসার পথে আপনি দেখতে পাবেন হাজাছড়া ঝর্ণা। আসলে ঝর্ণার আসল রূপ হলো বর্ষায়। সাজেক বর্ষায় অন্য এক রূপ নেয়। চারদিকে যেন সবুজের মিছিল। কখনও বৃষ্টি, কখনও মেঘের ভেলায় ভাসানো পাহাড়। এ যেন প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য! সাজেকে যাওয়ার পথে পথে পাহাড়ি বাচ্চাদের দাঁড়িয়ে হাত নাড়ানো আর মুখে ‘আই লাভ ইউ’ শুনে কেমন যেন একটা উৎসব মুখর পরিবেশ মনে হবে আপনার।
অনেক শিশু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে পর্যটকদের কাছ থেকে চকোলেট পাওয়ার আশায়। তবে, এই চকোলেট কুড়িয়ে নিতে গিয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুপুর ১২টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বহুল কাঙ্ক্ষিত সাজেক। রুইলুই রিসোর্টের বারান্দায় গিয়ে মনটা একদম জুড়িয়ে গেল। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদকে আলিঙ্গন। বর্ষায় একটু বৃষ্টির ছোঁয়া। শীতে গরম চায়ে কুয়াশার ধোঁয়া… সেখানে বসে বসে প্রকৃতি দেখার অসাধারণ একটি জায়গা এই রুইলুই রিসোর্ট। এই রিসোর্টে রাতযাপন করতে চাইলে আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়াই ভালো।
ফ্রেশ হওয়ার জন্য গোসল করতে গিয়ে মনে হলো, আমরা প্রতিনিয়ত কত পানিই না অপচয় করি! আর এখানে পানির বড়ই অভাব। এক হাজার ৫০০ লিটারের দাম ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। তার চেয়ে কষ্টের কথা, প্রায় এক হাজার ফুট নিচ থেকে পানি আনতে হয়। তাই খুব সীমিত পানি খরচ করে গোসল করে চলে গেলাম ছিম্বাল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য। এখানে খাবারের অর্ডার একটু আগে থেকেই করে রাখতে হয়। তবে, দাম একটু বেশি। কারণ নিচ থেকে তাদের খাবারের কাঁচামাল আনতে হয়। খাবারের স্বাদ এবং পরিবেশ ভালো।
বিকেলে চলে গেলাম সাজেকের জিরো পয়েন্ট হেলিপ্যাডে। এখানে বসে রুইলুই পাড়া উপভোগ করার সেরা জায়গা। চারদিকে সবুজ, উঁচু-নিচু পাহাড় দূরে কংলাক পাড়া সবই জানি চোখের সামনে। কিছুক্ষণ পরেই সূর্য হেলে পড়ল পশ্চিম আকাশে। রক্তিম একটা অবয়ব যেন ধারণ করল রুইলুই পাড়াজুড়ে।
কিছুক্ষণ গল্প-আড্ডা-গান শেষে চলে গেলাম ছিম্বাল রেস্টুরেন্টে। সেখানে আগে থেকেই বারবিকিউর ব্যবস্থা করা ছিল। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুইলুই পাড়ায় হাঁটতে বের হলাম। একটা কথা বলাই হয়নি, সাজেকে বিদ্যুৎ নেই। আছে সোলার এবং জেনারেটরের ব্যবস্থা। রাতে পুরোই নিস্তব্ধ। চারদিকে অন্ধকার, এ যেন এক অন্য জগৎ। তবে, চাঁদমগ্ন রাত হলে তো কথাই নেই। হোটেলের বারান্দায় কাটানো সেই রাতের কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে। সফরসঙ্গী ইকতারুল, অয়ন, রনি ভাইয়ের সাজেকের অভিজ্ঞতার কথা শোনা এবং কিছুক্ষণ পরপর ইকতারুলের কণ্ঠে গান সবই ছিল মনে রাখার মতো। ফ্রেয়া স্টার্কের কথাটা খুব মনে পড়ে গেল, ‘নতুন কোনো শহরে একাকী ঘুম থেকে জাগা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দের অনুভূতি!’
ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয় দেখার জন্য চলে গেলাম কংলাক পাড়ায়। রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়ার সমন্বয়ে সাজেকের অবস্থান। রুইলুই পাড়া থেকে দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। যাওয়ার পথে চোখে পড়ল কমলা বাগান। এ ছাড়া আছে পাহাড়ি কলা আর আনারসের গাছ। কংলাক পাহাড় সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় এক হাজার ৮০০ ফুট। কংলাক পাহাড় হলো রাঙামাটির ছাদ। উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে
রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত। এখানে ১৫-২০টি পরিবার বসবাস করে। তারা সবাই পাংখোয়া আদিবাসী। কংলাক পাহাড় থেকে আর সামনে না যাওয়াই ভালো। কারণ অপহরণের আশঙ্কা থাকে।
পাকা পেঁপের জুস আর কলা খেয়ে ক্লান্তি দূর করে চলে এলাম হোটেলে। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে ১০টার আর্মির এস্কর্ট ধরে খাগড়াছড়ি চলে এলাম দুই ঘণ্টা পর। আমরা যারা প্রকৃতির খুব কাছে যেতে পছন্দ করি তাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কারণে প্রকৃতির কোনো ক্ষতি যেন না হয়। প্রকৃতি যেন তার নিজের মতোই সুন্দর থাকে সেই দায়িত্ব আমাদের সবার। পলিথিন, পানির বোতল কিংবা চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এম এম আরিফুল ইসলাম