রেশমি কাপড়, কালাই রুটি, হরেক রকমের সুস্বাদু আম কিংবা পদ্মা নদী। এই নামগুলো শুনলেই প্রথমেই যে স্থানের নাম মনে আসবে, সেটি হলো রাজশাহী। সেসব স্বাদ নিতে এবার রাতের ট্রেন ধরে চলে গিয়েছিলাম উত্তরের শিক্ষানগরীখ্যাত আম ও কালাইরুটির দেশ রাজশাহীতে। একদিকে বিস্তৃত পদ্মা, আর তার কোল ঘেষেই এই সিল্ক সিটি।
মূলত রাতের পদ্মা এক্সপ্রেসে চড়েই আমাদের যাত্রা রাজশাহীতে। সেখানে নেমেই চলে গেলাম আমরা পর্যটন মোটেলে। পর্যটন হলো আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় হোটেল চেইন। নর্থের বড় বড় প্রায় সব শহরেই আছে যার মোটেল। সেখানে গিয়েই রুমে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা।
প্রথমেই এ যাত্রায় ছুটে যাওয়া রাজশাহীর বিখ্যাত আম লিচু বাগানে। মোটেল থেকে অটো নিয়ে ছুটলাম প্রথমে কাশিয়াডাঙ্গা বাইপাস রেল গেইটে। সেখানে নেমেই খানিক পায়ে হেঁটে ঢুকে পড়লাম আম-লিচুর বাগানে। সেখানে পেট পুরে আম-লিচু খেয়ে আমরা পথ ধরলাম কর্ণাহারের মর্মরিয়া বাজারের পথে।
হাঁসের মাংসের জন্য এই স্থান বিখ্যাত। মূলত রাজহাঁস ও পাতিহাঁসের কালাভুনার জন্যই বিখ্যাত এই স্থান। দুপুরে দল বেঁধে লাঞ্চ করেই মোটেলে ফিরে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আবারো বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। মোটেল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বেই মূলত রাজশাহীর বিখ্যাত টি বাঁধ।
রাজশাহী শহরজুড়ে পদ্মা নদী ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বাঁধ। তেমনই একটি বাঁধ হচ্ছে টি-বাঁধ। মূলত ইংরেজি অক্ষর টি এর আকৃতি অনুসারে তৈরি হয় এটি। বিভাগীয় শহর রাজশাহীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রের স্থান দখল করেছে জায়গাটি।
সকালে সূর্যোদয়ের সময় পাখির কলকাকলি ও দখিনা হাওয়া যে কারও মনকে চাঙা করে তুলবে। গোধূলি লগ্নে রক্তিম সূর্য নদীর পানিতে পড়ে অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। স্থানীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটি বহুল পরিচিত ও বেশ জনপ্রিয়ও বটে। আমরাও লোভ সামলাতে না পেরে এই শেষ বেলায় নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম পদ্মার বুকে।
পদ্মা ঘুরে এবার রাতের রাজশাহী দেখার পালা। অটো রিকশা নিয়ে প্রথমের চলে গেলাম সাহেব বাজারে। রাজশাহীর মূল কেন্দ্রবিন্দুই যেন এই সাহেব বাজার। সেখানে চা খেয়ে প্রায় ১০টি রিকশা ঘণ্টা হিসেবে রিজার্ভ করে বেড়িয়ে পড়লাম রাতের রাজশাহী দেখতে।
রাজশাহী বিখ্যাত তার সুন্দর রাস্তা আর ল্যাম্পপোস্টের জন্য। আর ল্যাম্পপোস্টের রুপ আরো বেশিই যেন ধরা দেয় রাতের আঁধারে। রুয়েট, রাজশাহী ভার্সিটি সব ঘুরে, ফ্লাইওভার, বাইপাস, আম চত্ত্বর ঘুরে চললাম আমরা উপশহরে। কারণ ঠিক ওখানেই আজ রাতে আমাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ডিনার।
রাজশাহীর আরেক বিখ্যাত খাবার কালাইরুটির সঙ্গে মরিচ ও বেগুন ভর্তা। যদি এর সঙ্গে গরুর বট বা হাঁসের মাংসও এখন খাওয়া হয় হালের ক্রেজ হিসেবে। এই উপশহরেই আছে, কালাই বাড়ি, কালাই ঘর, কালাই হাউজ নামে বেশ কিছু দোকান।
তুলনামূলক বিখ্যাত এসব হোটেলেই দেখা পাবেন কালাই রুটির। চাল ও মাষকলাইয়ের ময়দার সংমিশ্রণে তৈরি হয় কালাই রুটি। এই রুটিতে যে পরিমাণ মিনারেল থাকে তা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ডিনার শেষ করেই আমরা মিষ্টি পান মুখে পুড়ে ছুটলাম সিএন্ডবি মোড়ে।
এই রাতেই সেখানে পাওয়া যায় বিখ্যাত রানা মিষ্টি। আর যাই হোক রাজশাহী ঘুরতে গেলে এই মিষ্টি অন্তত মিস করবেন না। এরপর ঘরে ফেরা। পরদিন সকালেই উঠে নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লাম সপুরা সিল্ক মিলের পথে।
সিল্ক আর রাজশাহী নামেই যেন একে অপরের পরিপূরক। কয়েক দশক থেকে থেকে চলে আসছে এই পরিচিতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচি ও ফ্যাশন বদলে গেলেও অমলিন সিল্কের ঐতিহ্য। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সপুরা সিল্ক মিলস হলো রাজশাহীর আরেকটি মাস্ট ভিজিট প্লেস।
সেখানে যেমন দেখতে পাবেন কীভাবে তৈরি হয় সিল্ক কাপড়। তেমেই কিনতে পারবেন পছন্দ অনুযায়ী। এই অঞ্চলে রেশম উৎপাদনের সূচনা ঘটে ১৩ শতকে। তখন এটি বেঙ্গল সিল্ক বা গঙ্গা সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে রেশম উৎপাদন শুরু করে।
রেশম বা সিল্ক একধরনের প্রাকৃতিক প্রোটিন তন্তু, যার কয়েকটি ধরন বস্ত্রশিল্প তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এক ধরনের রেশম পোকার গুটি থেকে এ ধরনের সুতা পাওয়া যায়। বিশেষ ব্যবস্থায় রেশম পোকা চাষের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে এই সুতা প্রস্তুত করা হয়। রেশম পোকার গুটি চাষের পদ্ধতিকে সেরিকালচার বলা হয়।
তবে সিল্ক এতো দামি কেন? মূলত ১ কেজি রেশম উৎপাদন করতে, ১০৪ কেজি তুঁত পাতা ও ৩০০০ রেশম মথ লাগে। একই সঙ্গে অন্যান্য তন্তুর সঙ্গে তুলনা করলে রেশম তৈরি হয় পরিবেশ ও প্রকৃতি উপর নির্ভর করে। রেশম যে শুধু রাজশাহীতেই চাষ ও উৎপাদন হয় তা কিন্তু নয়, রাজশাহীর পর সর্বাধিক রেশম উৎপাদন হয় উত্তরের রংপুর ও দিনাজপুরে।
শুধু সিল্ক উৎপাদন নয়, একই সঙ্গে যদি চান নানা ধাচের ও নানা মানের সিল্ক কাপড় ও শাড়ি কিনতে তবে আপনারি জন্য সিল্কের স্বর্গ এই সপুরা সিল্কের সেলস আউটলেট। বিভিন্ন ডিজাইনের ও মানের শাড়ি পাবেন এখানেই। যদি চান তবে আপনার পছন্দের রং নির্বাচন করে সেই অনুযায়ী বানিয়েও নিতে পারবেন শাড়ি। ৩-৩০ হাজারের মধ্যেই পাবেন সিল্কের শাড়ি।
সপুরা সিল্ক মিলের আশপাশে আছে আরও বেশ কিছু সিল্ক শাড়ির শো-রুম। তুলনামূলক কম মূল্যেই পাবেন শাড়ি। তাই শুধুই সপুরা সিল্ক নয়, সময় পেলে সেসব শো-রুমগুলোও ঘুরে দেখতে ভুলবেন না। এই সিল্কের দেশে ঘুরাঘুরি করতে করতে দুপুর হয়ে যায়।
এবার পালা মোটেলে ফেরার। চটজলদি মোটেলে ফিরে লাঞ্চ করেই ধরলাম আমরা স্টেশনের পথ। কারণ বিকেল ৪টায় ট্রেন আমাদের ঢাকার পথে। বিকাল ৪টায় ছাড়া ট্রেন রাত ১১টায় নামিয়ে দিলো আমাদের কমলাপুরে আর এর মাধ্যমেই এবারের মতো ইতি আমাদের নর্থ ট্রিপের।
ইসতিয়াক আহমেদ