বাঙালিদের একদিকে যেমন দীঘা-পুরি-দার্জিলিং, তেমনই বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে প্রথম নাম আসে ব্যাংককের। আসলে, আজকাল সময়ের এতই অভাব যে, ছুটি কাটাতে গেলেও দিনক্ষণ, দূরত্ব এবং সর্বোপরি পকেটের দিকে নজর রেখেই পরিকল্পনা করতে হয়। আর ব্যাংকক, এই সবক’টি মানদণ্ডেই ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করায়, বিদেশ সফরে গেলে ব্যাংকক সবারই অন্যতম পছন্দ। রাতের আলোমাখা ব্যাংকক শহরের একটা আলাদা চার্ম আছে ঠিকই, তবে সকালের সোনালি আভায় সে একেবারে নতুন, যেন সত্যিই দেবদূতের দেশ। চাও ফ্রায়া নদীর বুকে নৌবিহার করতে করতে থাইনৃত্য সহযোগে থাইফুড খাওয়ার যে মজা, তা আর কোনও শহরে পাবেন না। তাই তো সময় পেলেই বারবার চলে আসি ব্যাংককে। এবারে অবশ্য ব্যাংককের পার্শ্ববর্তী ক্রাবি আর ফি ফি দ্বীপপুঞ্জই থাইল্যান্ড ভ্রমণের প্রধান গন্তব্য ছিল, তবে ফেরার পথে মন টানল। ক্রাবি বেড়িয়ে বাবা-মা এবং স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বিকালের বিমানে নামলাম ব্যাংককের ডন ম্যূয়াং বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে শহরে যেতে ট্যাক্সি ভাড়া করা যায়।
ঝাঁ চকচকে, মসৃণ রাস্তার দু’ধারে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সুবিশাল হোটেল এবং আধুনিক শপিং মলে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। যেন প্রথমবার এই শহরে পা রাখলাম। প্রথম দেখায় ব্যাংকককে একটি প্রাণহীন শহর বলে মনে হলেও, একটু সময় দিলেই জানতে পারবেন এদেশের প্রাচ্য ঐতিহ্যের কথা। মানুষজন অত্যন্ত ধর্মবিশ্বাসী। নজিরস্বরূপ শহরের প্রায় সব জায়গাতেই ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির। ট্যাক্সি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সোজা এক্সপ্রেসওয়ে ধরল। কয়েকদিন ক্রাবি আর ফি ফির শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে থেকে, হঠাৎ ব্যাংককের আলোর রোশনাই, কোলাহল ও কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে পড়ে একটু কাহিল হয়ে পড়েছিলাম সকলে। ঠিক করলাম আজ আর কোথাও যাব না। রাতে একটা বাংলাদেশি রেস্তরাঁয় খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরদিন শনিবার। ঠিক করলাম সারাদিন ছাতুচক বাজারে কাটাব।
বিশ্বের বৃহদাকার বাজারগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। প্রায় ২৭ একর জমির উপর মোটামুটি ১৫ হাজার দোকানপাট নিয়ে সপ্তাহান্তের হাট ছাতুচক। থাইল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক আসে বেচা-কেনা করতে। বলতে গেলে সবকিছুই পাওয়া যায়। অ্যান্টিক থেকে শুরু করে সেরামিকস, মাটি, কাঠ, ফুল, ফল, গাছ, জামাকাপড়, স্থানীয় স্যুভেনিওর কী নেই! বাস, ট্যাক্সি, আন্ডার-গ্রাউন্ড ট্রেন, স্কাই ট্রেন সবই আসে এখানে। তবে আমরা স্কাই ট্রেনেই যাব ঠিক করলাম। ‘নানা’ স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে শহর দেখতে দেখতে ‘মোচিত’ পৌঁছলাম সকাল ৭টা নাগাদ। সেখান থেকে ছাতুচক বাজার হাঁটা পথ। রাস্তাতেই জলখাবার সেরে শপিং শুরু করলাম। প্রথমেই কিনলাম বাজারের দু’টো মানচিত্র। এতবড়ো এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখতে গেলে মানচিত্র ছাড়া গতি নেই। সময়ের অভাব ছিল না। দোকানপাট ঘুরে, প্রচুর কেনাকাটা সেরে ট্যাক্সি চড়ে ফিরে এলাম হোটেলে।
ব্যাংককে ‘সিয়াম নিরামিত ব্যাংকক’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়, যার উল্লেখ রয়েছে গিনিস বুকেও। আসার আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম এবার এই শোটা দেখব। পরদিন হোটেলের ট্রাভেল ডেস্কই, গাড়ি থেকে টিকিট সমস্ত ব্যবস্থা করে দিল, মাথাপিছু ১৮০০ ভাট। অবশ্য বড় দল থাকলে প্রাইভেট বাসেও যাওয়া যায়। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম থিয়েটার প্রাঙ্গনে। ড্রাইভার জানালো যে, সে আমাদের হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে। ফটক দিয়ে ঢুকেই সামনে বিশাল বড় উঠোন। ৮ টায় শো আরম্ভ। আমরা চলে গেলাম ডিনার সারতে। এলাহি নৈশভোজ সেরে প্রেক্ষাগৃহে এসে ঢুকলাম। বিশাল হল ঘর। বিশ্বের বৃহত্তম স্টেজ প্রযোজনার মধ্যে এটি একটি। কী সুন্দর পোশাক-আশাক, কী উন্নত মানের সেট, নিঁখুত তার কারিগরি, সত্যিই তাক লেগে যায়। খুব সুন্দরভাবে থাইল্যান্ডের ইতিহাস ও সংস্কৃতি মঞ্চস্থ করল প্রায় একশোজন অংশগ্রহণকারী। মুগ্ধ হয়ে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ আমরা রওনা হলাম ভাসমান বাজার দেখতে।
এটিও থাইল্যান্ডের একটি বিষ্ময়। গাড়ি আগে থাকতেই বলা ছিল। থাইল্যান্ডের ভাসমান বাজারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘দমনেন সাদুয়াক’। প্রচুর পর্যটকের ভিড় হয় এখানে। রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে দাঁড়াল একটি খালের পাড়ে। বোঝার উপায় নেই কোথায় এলাম, চারিদিকে শুধু আম, কাঁঠাল, কলার জঙ্গল। সেখানে একটি মোটর চালিত নৌকা অপেক্ষা করছিল। তাতে উঠতেই আমাদের ছবি ক্যামেরা বন্দি করে রাখল একটি মেয়ে। বুঝলাম এটাও একধরনের ব্যবসা। ফেরার পথে এই ছবিই বিক্রি করবে তাঁরা। শুরু হল নৌবিহার। এ খাল, সে খাল দিয়ে ঢেউ তুলে ছুটে চলল আমাদের নৌকা। কিছুক্ষণ পরে নজরে এল, খালের দুই ধারে পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা, অধিকাংশই মহিলা। আমাদের নৌকার গতিও কমতে শুরু করেছে।
এখানে খাল বেশ চওড়া, আশেপাশে ছোট বড় নৌকায় পর্যটক ঠাসা। দেখলাম ছোট ছোট ডিঙি নৌকাতে চড়ে ফল, মিষ্টি, খাবার থেকে শুরু করে জামা কাপড়, সুভেনিয়র ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় জলরঙে আঁকা কোনও ছবি। এদের পাশ কাটিয়ে আমরা ধীর গতিতে এগিয়ে চললাম। দেখলাম এই ভাসমান বাজারের ধারেই বহু লোকের বসবাস। নৌবিহার শেষ করে খালের ধারে একটি মনাস্ট্রি ঘুরে দুপুরের মধ্যে ব্যাংককে ফিরে এলাম। সন্ধ্যেবেলা টুকটুকে চেপে পাতং ঘুরে চললাম চায়না টাউনের উদ্দেশ্যে। খেতে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের জন্য চায়না টাউন স্বর্গ! চতুর্দিকে নানাধরনের সুস্বাদু খাবারের স্টল, তাতে থিকথিক করছে খাদ্যরসিকদের দল।
সেইসব লোভনীয় দৃশ্য চাক্ষুস করে এবং মোটামুটি ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং সেরে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন গাড়ি ভাড়া করে চিড়িয়াখানা ও সাফারি দেখতে বেরলাম। চিড়িয়াখানা পৌঁছতেই ড্রাইভার হাতে পার্কের মানচিত্র ধরিয়ে দিল। নিজেদের গাড়িতেই সাফারিতে ঢুকলাম। বলা যেতে পারে আফ্রিকার গেম ফরেস্টের ক্ষুদ্র সংস্করণ। গাড়ি খুব ধীর গতিতে এগোতে লাগল। গাড়ির বাইরে পা রাখা মানা। আমি সামনের সিটে বসে, হঠাৎ চমকে উঠলাম। দেখি দু’টো উঁট এগিয়ে এসে মুখ বাড়িয়ে কাঁচের উপর কী যেন দেখছে। এরপর একে একে পেলিক্যান, জিরাফ, গন্ডার, হরিণের দেখা মিলল।
আর দেখলাম গোটা পনেরো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। খোলা জায়গায় একসঙ্গে এতগুলো বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। গাড়ির ভেতর বসেও টের পেলাম হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সাফারি শেষ করে বাকি চিড়িয়াখানাটা পায়ে হেঁটেই দেখলাম। বাঘের বাচ্চা কোলে তোলার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। সেদিনই ফেরার কথা কলকাতায়। রাতের বিমানে করে ভোররাতে ফিরলাম কলকাতায়। প্রথমবার তো নয়, তবুও কেমন যেন টান অনুভব করি এই শহরটার প্রতি। গতবার ফেরার সময় যে অপূর্ণতা মনে জমাট বেঁধেছিল, সেটা এবার ব্যাংককেই রেখে এলাম। মনটা বেশ তৃপ্ত লাগল। কী জানি, হয়তো দেবদূতেরই আশীর্বাদ!
কলকাতা থেকে সরাসরি বিমানে ব্যাঙ্কক পৌঁছানো যায়।
নভেম্বর থেকে মার্চ ব্যাংকক ভ্রমণের সেরা সময়।
সুতির জামা কাপড়, সুইমিং কস্টিউম, ইলেকট্রনিক জিনিস কেনার আদর্শ জায়গা।