শহর ছেড়ে প্রায় ৮০০০ কিলোমিটার দূরে পাড়ি দেওয়ার কথা যখন ভাবলাম, তখন প্রথমেই মনে এল দেশটার ইতিহাস আর অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা! হ্যাঁ, স্বাধীনতা লাভের জন্য যে দেশটাকে এত দীর্ঘ লড়াই লড়তে হয়েছিল, আমাদের গন্তব্য এবার সে দেশেই—দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে দেশটায় পা রাখতেই বুঝলাম এখানকার মানুষদের আতিথেয়তা আর উষ্ণ আপ্যায়নে মুগ্ধ না হওয়ার জো নেই! আমাদের প্রথম গন্তব্য জোহানাসবার্গ। মাত্র এক রাতের ছোট্ট লে-ওভার স্টে। তবুও, এই স্বল্প সময়ে রোমাঞ্চ আর আনন্দের যে অমলিন অনুভূতি লাভ করলাম তা ভোলার নয়।
ক্যাব ড্রাইভার এরিক আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শহর ঘোরাতে। শুরুতেই নেলসন ম্যান্ডেলা স্কোয়ারে নেলসন ম্যান্ডেলার মূর্তি দর্শন। স্কোয়ারের ঠিক মাঝখানে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সেলফি তুলে আবার রওনা দিলাম পরের গন্তব্যে। এগোতে এগোতে চোখে পড়ল খাবারের সারি! নিজেকে কী আর স্থির রাখা যায়! ছোট রেস্তরাঁ থেকে বিলাসবহুল পাব থেকে হ্যান্ড রোলড আইসক্রিম—সব পাবেন সামান্য দূরত্বেই। রাস্তার দু’ধারে একাধিক হাই ফ্যাশন স্টোর। হাতে বানানো অসাধারণ সব গয়না আর ডিজ়াইনার পোশাকের কালেকশনে মুগ্ধ হওয়ার জোগার। যাত্রার শুরুটাই এত মধুর যে বাকি দিনগুলোর উত্তেজনার আঁচ তখন থেকেই পেতে শুরু করলাম! আমাদের পরের গন্তব্য লোসি গেম রিজ়ার্ভ। গাড়িতে করে পোর্ট এলিজ়াবেথ থেকে সোজা গেম রিজ়ার্ভের উদ্দেশ্যে চলা শুরু।
গেম লজের কাছে পৌঁছে দেখলাম চোখের সামনে অনন্ত ধূ ধূ প্রান্তর। প্রথমে মনে হল এ কোথায় এসে পড়লাম! মোটেও পছন্দ হল না। কিন্তু লজের ভিতরে ঢোকার পর মনে হল এ তো এমন এক কল্পরাজ্য যা শুধু বইতেই পড়েছি। কাঠের প্যানেল দেওয়া ঘর, চারদিকে ফায়ার প্লেসের ব্যবস্থা, উডেন বার… আর সবকিছু ছাপিয়ে বিস্তৃত প্রাঙ্গণের সামনে খোলা বসার জায়গা। কটেজগুলোও দারুণ। পুরনো আমলের মেঝে, উঁচু উঁচু সিলিং, মেহগনি কাঠের বিছানা, কাঠের ট্রাঙ্ক সবই আছে। ঘরে ঢোকার সময় ওখানকার অ্যাটেনডেন্ট আমাদের বলে দিলেন, ‘‘রাতে হায়নার ডাক শুনতে পাবেন। আর বারান্দায় তালা দিয়ে রাখবেন। বলা যায় না, আপনাদের স্বাগত জানাতে চলে এল হয়তো!’’ চেক-ইন করে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেললাম। মাথার উপর চড়া রোদ।
কিন্তু সেই রোদ উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়লাম সাফারিতে। ৪x৪ জিপে করে চললাম জঙ্গল অভিযানে। জেব্রা, জিরাফ, হাতি, নানারকমের পাখি ছাড়াও আলাপ হল একদল সিংহের সঙ্গে। সহযাত্রীদের সঙ্গেই ছোটখাটো পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল। খোলা আকাশের নিচে জঙ্গলের মধ্যিখানে জমে গেল পিকনিক। ফলমূল, পানীয়, মাংস-সহযোগে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া। গল্পগুজবের মাঝেই সূর্য ঢলে পড়েছে। আমি ও আমার মেয়ে দু’জনেরই বেশ ঠান্ডা লাগছিল। ভাগ্যিস, কম্বলের ব্যবস্থা ছিল। নাহলে লজে ফিরতে ফিরতে জমেই যেতাম বোধহয়! লজে ফিরেই গরম দুধ খেলাম। এবার বেশ আরামবোধ করছি। আর এরপরেই দক্ষিণ আফ্রিকান ওয়াইন আর ডিনার। নিরামিশাষী হওয়ায়, লজের শেফ নিজেই দায়িত্ব নিয়ে মেনু প্ল্যানিং করে দিয়েছিলেন।
তাজা ফল ও সবজি-সহযোগে আমাদের জন্যই উনি বানিয়ে দিলেন মোসাকা ডিশ (moussaka dish)। খাবারের স্বাদ এখন মুখে লেগে আছে। সেদিন রাতে ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও পরেরদিন সকালেই আবার আমরা তৈরি সাফারির জন্য! ঝলমলে রোদ, নির্মল বাতাস আর ঠান্ডা আবহাওয়া—গরম জামায় মুড়ে নিয়ে চললাম নতুন কিছু দেখার উদ্দেশ্যে। সকালে সাফারিতে অনেক চেষ্টা করেও দেখা পাচ্ছিলাম না রাইনোসরাসের। কিন্তু প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষার পর অবশেষে তিনি ধরা দিলেন চোখের সামনে। সাফারি শেষে প্রাতরাশের পালা। ইতিমধ্যেই দেখা হয়ে গিয়েছে জেব্রার দলের সঙ্গে। বাকি দিনটা আলস্যে কাটিয়ে দিলাম। পরেরদিন আমাদের গন্তব্য নাজ়নার (knysna) উদ্দেশ্যে।
গেম রিজ়ার্ভ থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টার ড্রাইভ। সঙ্গী অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আসার পথে কিছুটা বৃষ্টি হলেও মোটের উপর বেশ ভালভাবেই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। দু’কামরার ভিলাতে বেশ পুরনো আমলের রুম হিটার। সেদিন হেটোলেই কাটিয়ে দিলাম। পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙল সূর্যোদয়ের রঙিন অনুভূতি মেখে। কী অপূর্ব সে দৃশ্য! প্রায় আধ ঘণ্টা বাকরুদ্ধ হয়ে সে দৃশ্য দেখলাম! তবে নাজ়নায় রোমাঞ্চও কম নয়। আমার স্বামী ও মেয়ে বাঞ্জি জাম্পিং করবে বলে জেদ ধরেছিল। হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় মানুষদের থেকে কিনে ফেললাম বেশ কিছু হস্তশিল্পের জিনিস, কাঠের দাবা, ট্রাইবাল গয়না ইত্যাদি। টিকিট কেটে ঢুকলাম বাঞ্জি জাম্পিং করতে! প্রথমে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। নীচে তাকালে তো অসীম সবুজ আর সবুজ। আমাদের বাঞ্জি জাম্পের জন্য প্রস্তুত করা হল। তারপরের অভিজ্ঞতা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। জাম্প শেষে মনে হল, ‘সত্যিই করলাম তো!’ রোমাঞ্চের অবশ্য এতেই ইতি নয়। সন্ধেতে আমাদের পরিকল্পনা ছিল ক্রুজ় রাইডের। সঙ্গে জলের ধারে ডিনার। পরেরদিন রওনা দিলাম কাঙ্গো কেভস আর অস্ট্রিচ ফার্মের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথেই কিনে ফেললাম অস্ট্রিচ ব্যাগ। তবে এরপরের গন্তব্যটা বোধহয় আমার কাছে সবচেয়ে উপভোগ্য।
এবার যে ওয়াইন চেখে দেখার পালা! গাড়ি ছুটিয়ে চললাম স্টেলেনবশ (stellenbosch)-এর দিকে। জায়গার চারদিকে ভিনইয়ার্ড। এখানেই ঘাঁটি গাড়লাম আমরা। আমাদের হোটেলের ঠিক সামনেই ভিনইয়ার্ড। আর চারপাশে অমলিন সবুজের বিস্তার। ডিনারের আগেই চলল ওয়াইন টেস্টিংয়ের পালা। ডেসার্ট ওয়াইন, ফ্রুট ওয়াইন ইত্যাদি চেখে দেখলাম। হোটেলের ওয়াইন সেলার ঘুরে দেখলাম। সে দেশের কত অসংখ্য রকমের ওয়াইনের সারি সেখানে! ডিনারের পরে ফায়ারপ্লেসের ধারে নিজেকে সেঁকে নিতে নিতে একবার রোমন্থন করে নিলাম ভ্রমণের স্মৃতিগুলো। এখানকার একটি ভিনইয়ার্ডে আছে মিনি ব্রিউয়ারি। সেখানে বিয়ার চেখে দেখতে ঢুঁ মারলাম। এই প্রথম আমি লাইট ও ডার্ক বিয়ার খেলাম।
তবে সত্যি বলতে, বিয়ারের তুলনায় ওয়াইন নিয়েই আমার আগ্রহ বেশি। তাই, অল্প চেখে ঝুকে পড়লাম পাশের ওয়াইনারিতে। জেসি ডে লা য়্যু (JC de la rue) ওখানকার অন্যতম সুদৃশ্য ওয়াইনারি। এখানে রয়েছে আউটডোর টেরেস রেস্তরাঁও। মিনি প্রসেসিং ইউনিট দেখতে দেখতে বুঝতে লাগলাম ওয়াইন তৈরির খুঁটিনাটি। ওয়াইন ছাড়াও খেলাম স্যালাড, পাস্তা ও ডেসার্ট। আর এরপরে প্রায় পাঁচ রকম শ্যাম্পেন চেখে দেখার পালা! মুগ্ধ আমি লোভ সামলাতে না পেরে বেশ কয়েক বোতল কিনেও ফেললাম। দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণের একবার শেষ ধাপ হল কেপ টাউন। বেশিরভাগ সময়টা শপিং করে কাটিয়ে দিলেও কেপ টাউনের অন্যতম সেরা অভজ্ঞতা এখানকার পেঙ্গুইন কলোনি। পেঙ্গুইনদের মজার কাণ্ডকারখানা দেখে ক্যাসিনোয় ঢুকে পড়লাম। লেডি লাক সঙ্গ দেওয়ায় একটু বড়লোক হয়েই ফিরলাম। তাই কপালে জুটল উপরি আরও কিছু শপিংয়ের সুযোগ! ট্রিপ শেষে মনে হল, আরও কত কিছুই তো দেখা বিক রয়ে গেল! হয়তো আর একবার এই টানেই চলে আসব এ দেশে!