দ্বীপটির মূল আকর্ষণ এর অনন্য ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর বাড়িঘর আর ব্রেথটেকিং ক্যালডেরা। এখানকার বাড়িঘরগুলো প্রকৃতপক্ষে পোসকাফো (গুহাঘর) ধরণের, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই এই ধরণের গুহাঘর নির্মাণ করে এখানকার অধীবাসীরা।
সান্তরিনি অনেক ছোট একটা দ্বীপ, এর আয়তন প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি, যা আমাদের সেইন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে প্রায় দ্বিগুণ। এই দ্বীপের দুটি বড় ও জমজমাট শহর হচ্ছে ‘ফিরা’ ও ‘ওইয়া’। এই দ্বীপের একমাত্র এয়ারপোর্ট ‘থিরা’ আমাদের কক্সবাজার এয়ারপোর্টের চেয়েও ছোট। সান্তরিনিতে যাওয়ার জন্য এথেন্স থেকে ফেরিতে সময় লাগে ৫-৮ ঘণ্টা, ফেরিতে যেতে যেতে এজিয়ান সাগরের নীল পানি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, তবে নীল পানি দেখে অভিভূত হয়ে একঘণ্টার বেশি সময় কাটানো অত্যন্ত বোরিং। কারণ হাইড্রোলিক ফেরি হওয়ায় বাইরের বাতাস অথবা ডেকে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা যাওয়ার সময় মিলান থেকে এয়ারে সরাসরি চলে যাই সান্তরিনি এবং ফেরার সময় ফেরির টিকেট করি এথেন্সে যাওয়ার জন্য।
এয়ারপোর্ট নেমেই শহরগুলোতে যাওয়ার জন্য রয়েছে বাস সার্ভিস, ট্যাক্সি, এছাড়া প্রাইভেট ট্রান্সফার। বলাবাহুল্য ইউরোপে ট্যাক্সিভাড়া আর ট্রান্সফার সার্ভিস অত্যাধিক বেশি, তাই সান্তরিনিতে বাসে চলাফেরা করাই বেশি সাশ্রয়ী। তবে ফেরার সময় পোর্টে আসতে আমরা হোটেল ট্রান্সফার সার্ভিস নিই, টেনশন ফ্রি ভাবে সময়মতো পোর্টে পৌছানোর জন্য। এছাড়া পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য আমাদের কক্সবাজারের মত চার চাকার বাইক পাওয়া যায়, যা বেশ সাশ্রয়ী।
আমাদের হোটেলটি ছিল ইমেরোভিগলি নামে একটি স্থানে, যা ওইয়া আর ফিরা শহরের মাঝখানে। সান্তরিনিতে কোনটা বাড়ি আর কোনটা হোটেল তা বোঝা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এবং কোনো বাড়িতে ঢোকার দরজা বা গেট বুঝতে গেলে গোলক ধাঁধাঁয় পড়তে হয়। বাস থেকে নেমে গুগল ম্যাপ দেখে দুই মিনিট হেটেই পৌঁছে যাই আমাদের হোটেলে। হোটেলের নেমপ্লেট, রূম সবকিছুর দেখা পেলেও, কোথায় যে রিসিপশন, কোথায় যে প্রবেশপথ কিছুই বোঝার উপায় নেই, গুহাবাড়িগুলোর এমনই অবস্থা। অনেক খোঁজাখুঁজি আর ফোন আলাপের পর বুঝতে পারি কোনদিক দিয়ে ঢুকতে হবে। রুমে ঢুকে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি, পুরো বার্বিডল একটা রুম। এমেনিটিস, সার্ভিস, আর রুমের কোয়ালিটি অনুযায়ী রুমের প্রাইস তুলনামূলক অনেক কম সান্তরিনিতে।
সান্তরিনিতে আলাদা করে কোনো দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার কিছু নেই, সান্তরিনি দ্বীপটাই অসম্ভব সৌন্দর্যের মাধুর্য্যে পরিপূর্ণ। এখানে আছে অনেকগুলো বীচ। বীচগুলোর একেকটার মাটির রং এক এক রকম হওয়ায় এগুলো পরিচিত ব্ল্যাক বিচ, রেড বিচ, হোয়াইট বিচ নামে। ওইয়া অনেক বেশি জনপ্রিয় একটি স্পট যেখানে আছে পৃথিবী বিখ্যাত পোস্টকার্ড ভিউ ‘থ্রি ডোমস’। ছোটবেলায় পোস্টকার্ডে সান্তরিনির সাদা বিল্ডিং আর নীল গম্বুজের এই ছবি দেখে ভাবতাম কোনো শিল্পীর কল্পনায় আঁকা ছবি, কিন্তু বড় হওয়ার পর জানলাম আসলেই এমন একটা জায়গা বাস্তবে আছে। এই কথা শুধু আমার না, ওইয়াতে থ্রি ডোমস এর স্পটে দাঁড়িয়ে দেখি চার-পাঁচ বছরের ছোট এক বাচ্চা তার মাকে বলছে ‘মাম্মি, মাম্মি, ইটস রিয়্যাল, মাম্মি ইটস রিয়্যাল, আই থট ইটস অনলি আ পিকচার, বাট ইটস রিয়্যাল মাম্মি, ইটস রিয়্যাল’। ছেলেটার উৎসাহটা দেখার মত ছিল, সে যেন নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা।
আগে থেকেই স্টাডি করে আসায় আমরা খুব অল্প সময়ে থ্রি ডোমস সরাসরি খুঁজে পাই কিন্তু এই থ্রি ডোমের স্পট খুজে পাওয়াটা কঠিন এক কাজ। তবে সেখানে এত বেশি লোকজনের ভীড়, এক মিনিটও দাঁড়ানো যায়না, তাই অনেক সকালে না গেলে সেখানে আরাম করে ছবি তোলা সম্ভব নয়। ওইয়াতে পর্যটকের চাপ অনেক বেশি, সন্ধ্যার সময় সূর্যাস্ত দেখার জন্য লোকজনের মেলা বসে যায়, জায়গা পাওয়া যায়না, এমন একটি অবস্থা। তাই আমরা আরাম করে সূর্যদয় দেখার জন্য সন্ধ্যার আগে আগেই রুমে ফিরে আসি।
রূপকথার রাজ্যে জীবনের কিছু সময় কাটাতে চাইলে ঘুরে আসতে হবে অপরূপ সৌন্দর্যের মাধুর্যে ভরপুর পৃথিবী বিখ্যাত সান্তরিনি দ্বীপে। সূর্যদয়, সূর্যাস্ত ছাড়াও, রাতের সান্তরিনির সৌন্দর্য চোখ ফেরানোর মত না। ভালো ভিউ পাওয়া যায় এমন হোটেল নিলে হোটেল রুমে বসেই পুরো শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এছাড়া বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে রাতের শহর দেখা আর আকাশে যদি বড় একটা পূর্নিমার চাঁদ থাকে, তাহলেতো কথাই নেই।
এখানকার স্থাপত্যের রং কেন সাদা আর নীল হলো তার পেছনে ব্যাখ্যাটা জানার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু জানতে পারিনি। তবে গ্রীসের পতাকার রং এর সাথে মিলিয়ে অথবা রং এর অপ্রতুলতাও কোনো কারণ হতে পারে। কারণ যাই হোক, সান্তরিনির শুভ্র স্নিগ্ধ ঘরবাড়ি, নীল রং এর ডোম আর সাগরের কোল ঘেষে প্যাবেলস্টোনের উঁচু নীচু সিড়িযুক্ত রাস্তাগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে যে কাউকেই মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতে হবে।