মাগাজ়িনের পাতায় এই লাইনগুলি পড়ে তখন আমার উদাসী মনে এক বেদুইন টান। ছোটবেলা থেকেই ঠাম্মার কাছে গল্প শোনা আমার ছিল সব থেকে প্রিয় শখ। কত সব জায়গা ঘুরে আশা যেত সেই গল্প গুলোর মধ্যে দিয়ে! তাই হয়তো মা আমায় আদর করে পাখি বলে ডাকত.. আমি বরাবরই অসম্ভব ভ্রমণ পিয়াসী, অবশ্য আমরা বেশিরভাগ বাঙালিরাই তাই। প্রতি বছর নতুন নতুন জায়গা দেখাই আমার ভাল থাকার রসদ। ভারতের খুব নিকটবর্তী দেশ ভুটানের ব্যাপারে বেশ কয়েক জনের কাছেই শুনেছিলাম। ঠিক করলাম, সে বছর মে মাসের প্রচন্ড গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে ভুটানের পাহাড়ি শীতলতাকেই অবগাহন করব। সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতেই আমার এই লেখনী ধরা।
কেউ বলে এই জায়গাটি মায়াবী, আবার কেউ বলে এটি রহস্যময়ী, সে যে যেভাবেই বর্ণনা করুক না কেন, হিমালয়ের কোলে এই ছোট্ট আকর্ষণীয় দেশটি আখিরে কিন্তু মনে বেঁধে ফেলে সকলেরই!
সুদূর চেন্নাই শহর থেকে বাগডোগরা বিমান বন্দর এ নেমে শিলিগুড়ির মত ব্যাস্ত শহরে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় এগারোটা। সেখান থেকে ভুটানের গেটওয়ে ফুন্টশোলিং পৌঁছতে লেগে গেল আরও চার ঘণ্টা। বেলা তখন তিনটে, গাড়ি থেকে নেমেই একটা হিমেল বাতাস ও শান্ত পরিবেশে মনটা জুড়িয়ে গেল। মে মাসের গরমেও কিন্তু ফুন্টশোলিং এর হওয়ার মধ্যে ছিল এক সিন্ধ শীতলতা। সেই শীতল হাওয়ার পরশে মুহূর্তের মধ্যে মনটা যেন ফুরফুরে হয়ে উঠল, কেটে গেল দীর্ঘ পথের সমস্ত ক্লান্তি।
হোটেলে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়লাম শহরটাকে ঘুরে দেখতে। ভারী সুন্দর শহর, অজস্র ছোট বড় রেস্তোরা ও কাফে এবং নানান রকমারি দোকান পাট। শহরের মধ্যস্থলে দেখতে পেলাম একটি অপরূপ গুম্ফা মন্দির, নাম Zangto Pelr। Lhakhang। এটি ১৯৯০ সালে Dasho Aku Tongm। নামক একজন প্রখ্যাত সুরকার গড়ে তুলেছিলেন। এর স্থাপত্য কীর্তি অতুলনীয়। এই বুদ্ধিস্টস মন্দিরে রয়েছে ওদের গুরুদেবের বিভিন্ন রকমের মূর্তি।
একজন ইন্ডিয়ান বুদ্ধিস্ট মাস্টার, যিনি তিব্বতে প্রথম বুদ্ধিসম প্রচার করেছিলেন এবং বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রি স্থাপনা করেছিলেন, ওনার স্বর্গীয় বাসস্থান হল ফুন্টশোলিংয়ের এই মন্দিরটি। ওনার আটটি অভিব্যক্ত মূর্তির উপস্থিতি এই মন্দিরটিকে করে তুলেছে ফুন্টশোলিংয়ের সবচেয়ে ধার্মিক এবং জনপ্রিয় স্থান।মন্দির দর্শন করে বের হতেই গায়ে লাগল একটি তীব্র দমকা হওয়া, আকাশে তখন গভীর কালো মেঘের ঘনঘটা! একটু এগোতেই শুরু হয়ে গেল মুষল ধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টি এড়াতে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম সামনের একটি মোমোর দোকানে। দোকানে একজন ভুটিয়া মহিলা মিস্টি হেসে আমাদের আপ্যায়ন করল। এখানকার মোমো খুব প্রসিদ্ধ তাই চিকেন মোমোই অর্ডার করা হল, বেশ খেতে! মন একদম ভরে গেল।
পাহাড়ি বৃষ্টি, তাই একটু পরেই থেমে গিয়ে আকাশ একদম ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল, কালো মেঘের চিহ্নমাত্র ছিল নেই। এটাই পাহাড়ের বৈশিষ্ট। এরপর আবার পায়ে হেঁটে শহরের চারপাশটা ঘুরে দেখলাম, প্রচুর পসরার সমাহার, অল্পবিস্তর কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে এলাম। আস্তে আস্তে পাহাড়ে সন্ধ্যে নেমে এল এবং পাহাড়ের চড়াই উৎরাইয়ে জ্বলে উঠতে লাগল অজস্র বৈদ্যুতিক আলো। হোটেলের বারান্দা থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার জোনাকি জ্বলছে, সে এক ভারী সুন্দর অনুভূতি।
রাতের খাবার পর্ব তাড়াতাড়ি শেষ করে শুয়ে পড়তে হল, পরের দিন সকাল সকাল আবার বেরোতে হবে। ফুন্টশোলিং প্রবেশ করতে ভিসা না লাগলেও ভুটানের বাকি জায়গায় যেতে হলে ফুন্টশোলিংয়ের ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমতি নিতে হয়। পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গরম জল দিয়ে স্নান সেরে আটটার মধ্যে জলখাবার খেয়ে ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে ভিসা নেওয়া হল।পৌনে নয়টার সময় আমাদের ভ্রমনের প্রদর্শক ও ড্রাইভার এসে পৌঁছে গেছে। ভুটানে রেজিস্টার্ড পথপ্রদর্শকের সাথেই ভ্রমণ করতে হয়। অতএব, পুরো সফরের সঙ্গী হবে এই দুই স্থানীয় বাসিন্দা। এখানকার লোকজন খুব হাস্যময়ী ও বিনয়ী এবং অন্যান্য দেশের মত এই দেশের পসার ও সমৃদ্ধির মাপকাঠি কিন্তু GDP (Gross Domest।c Product) নয়, বরং GNH বা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস। সেই জন্যই বুঝি ভুটানের আরেক নাম “ কিংডম অফ হ্যাপিনেস “! অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে ভ্রমণপথপ্র দর্শকে সঙ্গী করে রওনা হলাম ভুটানের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র পারোর দিকে।
ফুন্টশোলিং থেকে পারো যেতে প্রায় ছয় ঘন্টা লাগে। বেশ খানিকক্ষণ চলার পর আমরা একটা ছোট্ট রেস্তরায় এসে দাড়ালাম, সেখানে খাওয়া হল বাটার চা (সুজা চা) ও বেশ কয়েক প্লেট গরম গরম মোমো! এই বাটার চা এখানকার এক বিশেষত্ব, এটি বানানো হয় চা পাতার সাথে দুধ, বাটার ও নুন দিয়ে। হ্যাঁ, ঠিক ই পড়েছেন, চিনি নয় নুন! খেতেও বেশ মজাদার লাগে।
ফুন্টশোলিং থেকে পারোর সফর বড়ই মনোরম। রাস্তার ধারে, পাহাড়ের গায়ে অজস্র নাম না জানা ফুলের সমাহার। কোথাও আবার সারি সারি ফুটে থাকা রডোডেনড্রন এর দল স্বগর্বে পাহাড়ী হাওয়ার তালে তালে মাথা দুলিয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। গাড়ির স্টিরিওতে তখন বেজে চলছিল একের পর এক সব ভুটানি লোক সঙ্গীত, মানে না বুঝলেও গান গুলো যেন মনটাকে ভীষণ আনন্দে ভরে তুলছিল।
জানলা দিয়ে বাইরে অপলক চোখে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে কত স্রোতস্বিনী ঝরনা, যেনো কোনও নদী বক্ষে মিলিত হবার আকুল তাগিদ। গাড়ির জানলার কাচ নামিয়ে বুক ভরে স্বাস নিলাম, বিশুদ্ধ অক্সিজেন! বলাই বাহুল্য, চেন্নাই এর মত জনবহুল জায়গায় এ বড়ই দুষ্প্রাপ্য। পারো যাবার রাস্তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, তবে এখানকার গাড়ি চালকরাও খুব দক্ষ। পাহাড়ের পথে মাঝে মাঝেই বহু রঙিনপতাকা উড়তে দেখা যায়। গাইড কে জিগ্যেস করে জানা গেল এগুলো প্রেয়ার পতাকা। তবে এগুলো ভগবানের কাছে প্রার্থনার জন্য নয়, বরং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন এই পতাকা গুলো হাওয়ায় শান্তি, সমবেদনা, শক্তি, জ্ঞান ও মঙ্গলকামনা সকল বিশ্ববাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। অন্যান্য দেশে যখন অতুচ্চ সব অট্টালিকা, হার্ডিং আকাশে উঠছে, এরা কিন্তু তখন ও আকাশে শান্তি ও মঙ্গলকামনা ভাসাচ্ছে! কি আলাদা মানসিকতা না ?
অবশেষে প্রায় বিকেল নাগাদ আমরা পারো পৌঁছলাম।
পারো শপিং এর জন্য দারুন! তাই বিকেলটা এখানকার লোকাল মার্কেট ঘুরে দেখে নিলাম। এখানকার হস্তশিল্পের দোকানপাট অত্যন্ত ভাল। ভুটানে সব রকমের পোশাক চললেও প্রশাসনিক কিংবা ধার্মিক কেন্দ্রে এখানকার ট্রেডিশনাল পোশাকই পড়তে হয়। ভুটানি মেয়েদের ট্রেডিশনাল পোশাকের নাম “ কিরা” ও ছেলেদের পোশাকটির নাম “ঘো”। এগুলি হাতে বুনতে সময় লাগে প্রায় দু মাস, অতএব দামটাও বেশ চড়া। এই শহরে আরো রয়েছে বহু আকর্ষনীয় রেস্তোরা ও কাফে। ঠিক হল, রাতে খাবারের জন্য যাওয়া হবে একটি খাঁটি ভুটানিস রেস্তোরায়। এখানকার দুটি জনপ্রিয় স্তানীয় খাবার হল “ এমা দাত্শী “ ও “ কেওয়া দাত্শী “। এমা মানে লংকা এবং দাত্শী অর্থাৎ চীস, অতএব এই পদ হল ঝাল লাল লংকা ও চীস সস দিয়ে তৈরি। আবার কেওয়া (আলু) দাত্শী তৈরি আলু, চীস সস ও অবশ্যই লাল লংকা দিয়ে। বোঝাই গেল, এখানকার স্তানীয়রা বেশ ঝাল পছন্দ করে। দুটি পদই গরম গরম সাদা ভাত ও স্টীমড asparagus এর সাথে পরিবেশিত হয়। খাদ্যরসিক বাঙালীদের শুনতে অবাক লাগলেও এগুলো খেতে কিন্তু বেশ সুস্বাদু!
টাইগার নেস্ট রিসর্ট নামক একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্তা হয়েছিল। এটি পারো টাউন থেকে কিছুটা দূরে হলেও, পাহাড়ে ঘেরা এই হোটেলের অবস্থান কিন্তু অসাধারণ। এক্কেবারে রুম থেকেই দৃশ্যমান অতি প্রখ্যাত টাইগার নেস্ট মনাস্ট্রি।
পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরেই শুরু হল পারো সাইট সীইং, প্রথম দেখার জায়গা হল Ta Dzong। Dzong মানে কেল্লা, যেখানে প্রশাসনিক এবং ধার্মিক কাজকর্ম দুটোই হয়। এই Ta dzong, R।npung বা Paro dzong এর উপর, মাংদে নদীর পাড়ে অবস্থিত।বলা হয় এটি বানানো হয়েছিল R।npung dzong কে তিব্বত ও ভারতের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য।
17th শতাব্দীতে এই Dzong কে জাতীয় মুসিউমএ পরিণত করা হয়। বলা হয়, এই গোলাকার কেল্লাটি নাকি কেবল পাথর ও কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছিল, একটিও পেরেক তাতে ছিল না। তবে শোনা যায় ১৭১৪ সালের টানা ১৫ দিনের ভূমিকম্পে বাকি কেল্লাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এই Ta Dzong ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত।
এইখানে অবস্থিত জাতীয় মুসিউমএ রয়েছে ১৫০০ বছরের পুরোনো বহু হস্তনির্মিত বস্তু, “Thangka”- বুদ্ধর জীবনী বর্ণিত সিল্ক কাপড়ে ভুটানিস ট্রেডিশনাল পেন্টিং, মুখোশ ও আরও অনেক ঐতিহাসিক সামগ্রী। মুসিউমএ ঢোকার জন্য প্রবেশপত্র লাগে ৫০ NU, ভুটানের মুদ্রা Ngultrum, অবশ্য ভারতীয় মুদ্রা এখানে সর্বত্রই চলে। এই মুসিউম থেকে কিছু দূরেই অবস্থিত R।npong (পারো) Dzong। ১৬৪৬ সালে Shabdrug Ngawang Namgyal নামক ভুটানের প্রথম আধ্যাতিক গুরু এই Dzong গড়ে তুলেছিলেন। পারো শহর থেকে এই Dzong এর সংযোগ একটি সুদৃশ্য কাঠের সেতু দ্বারা। এই সেতুতে হাঁটতে হাঁটতে চারিপাশের অপরূপ দৃশ্য এবং এর ধারে গড়ে ওঠা অতি সহজ সরল জীবন নজরকারা।তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে কখন যেন সেতুর উপর দাঁড়িয়েই পড়েছি, হঠাৎ একদল ক্ষুদে সন্যাসীদের কোলাহলে সম্বিত ফিরল। এই Dzong এ Tshechu নামে একটি উৎসব উৎযাপিত হয়, যেখানে বিভিন্ন ভুটানিস শিল্পীরা লোকসংগীত ও মুখোশ নৃত্য দ্বারা ধার্মিক গল্প তুলে ধরে। শুনলাম রঙ ঝলমলে এই দৃশ্য নাকি চমৎকার লাগে|
ভুটান ভ্রমণে একটি পুরো দিন বরাদ্দ রাখতেই হবে টাইগার নেস্ট মনেস্ট্রির জন্য। এই মনেস্ট্রি পারোর একটি অনবদ্য পর্যটন কেন্দ্র।এই বুদ্ধিস্ট ধার্মিক কেন্দ্র বানানো হয়েছিল ১৬৯২ সালে।এটি একটি গুহাকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছিল যেখানে এদের অন্যতম গুরু R।npoche প্রথম ধ্যানে নিবৃত হয়েছিলেন এবং এটিই ভুটানে বুদ্ধিজমের সূত্র। কথায় বলে, তিব্বত থেকে তাদের গুরু এক বাঘিনীর পিঠে চড়ে এই স্থানে এসেছিলেন, ফলে এই জায়গার নামকরণ হয়েছিল টাইগার নেস্ট। এখন এই মনেস্ট্রিতে রয়েছে চারটে মন্দির ও সন্যাসীদের থাকবার জায়গা।
এই মনেস্ট্রির উচ্চতা প্রায় ৯০০ মিটার, খাড়া পাহাড়ের এক প্রান্তে এটি অবস্থিত।পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ এবড়ো খেবড়ো পথ, পায়ে হেঁটেই এই মনেস্ট্রিতে পৌঁছতে হয়। যাওয়া আসা এবং ওখানে ঘুরে সব দেখতে হলে প্রায় সাত ঘন্টা অনায়াসেই লেগে যায়। চলার শুরুতেই নিচে পাওয়া যায় লাঠি, সেটাকে সঙ্গী করে যাত্রা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সেখানে মাঝপথ অবধি টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চড়েও ওঠার ব্যবস্থা আছে।
তবে কষ্ট হলেও, টাইগার নেস্টের এই ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা ভ্রমণ পিপাসুদের তালিকা থেকে একদমই বাদ দেবার নয়। এর চারিদিকের পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। টাইগার নেস্টের কাছাকাছি চলে এলে অবস্য পথটা ততটা খাড়া নয়। রাস্তার দুধারে হাওয়ায় উড়ছে অগুনিত প্রেয়ার পতাকা। প্রকৃতি যেন এখানে আসা সকল মানুষের মন ভরিয়ে দিচ্ছে এক অপরিসীম ভাললাগায় এবং অপার শান্তিতে; ক্ষনিকের জন্য হলেও মনটা যেন চালিত হচ্ছে এক অপার্থিব দুনিয়াতে।
এমন একটি অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার পর বিকেলে হোটেলেই ব্যাবস্থা ছিল অত্যন্ত আরামদায়ক ‘হট স্টোন বাথ ‘ এর, একান্ত জরুরিও ছিল বটে।
পরবর্তী গন্তব্য স্থল হল ভুটানের রাজধানী থিম্পু। পারো থেকে থিম্পু যেতে সড়কপথে এক থেকে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগে। বলাই বাহুল্য, রাস্তার দুধারের সৌন্দর্য অপূর্ব, তার উপর রাস্তার দুপাশে অজস্র নাম না জানা নানা রকম ফুলের সমাহার, একেই হয়তো স্বর্গ বলে। থিম্পুর পথেই পড়ল S।mtokha dzong, এটি ১৬২৯ সালে নির্মিত হয়েছিল। কথিত আছে এটি ভুটানে গড়ে ওঠা প্রথম dzong। ভুটানের যে কোন dzong এই ঢুকতে হলে সম্পূর্ণ লম্বা ঝুলের পোষাক পরে ঢুকতে হয়। স্থানীয়রা অবশ্য তাদের ঐতিহ্যগত পোশাক পরেই ঢোকে। আর তার সাথে একটি চাদর পরে যার নাম “কাবনী “। সেই চাদর আবার সমাজের নানা স্তরের মানুষের জন্য নানা রঙে বিভক্ত, যেমন সাধারণ মানুষের জন্য সাদা, MP দের জন্য নীল, মন্ত্রীদের জন্য কমলা এবং ভুটানের রাজার জন্য বরাদ্দ হলুদ “কাবনী “।
বিকেলে পায়ে হেঁটে থিম্পু শহরটা ঘুরে দেখলাম। এখানে একটি অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল; সমস্ত ভুটানে এবং এমনকি এর রাজধানীতেও কোন ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। এখানকার ট্রাফিক পুলিশ বাঁশি বাজিয়েই যাত্রী নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্য এভাবেই আগে সব জায়গায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হতো, কিন্তু ভুটানে সেই ঐতিহ্য আজও চলছে। এখানকার লোকজন খুব সুন্দরভাবে সেই নিয়ম মেনেও চলে। সত্যি ভাবাই যায় না!!
পরদিন প্রাতঃরাশ সেরে বেড়িয়ে পড়লাম থিম্পুর নূতন নূতন জিনিস দেখার আগ্রহ নিয়ে। প্রথমে পৌঁছলাম বুদ্ধপয়েন্টে, যেটা নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধ্যানরত বুদ্ধ। এটি পুরোটাই ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি এবং গোল্ড প্লেটেড।এই বিশাল মূর্তি শহরের যে কোন প্রান্ত থেকেই দেখা যায়। এর নীচেই রয়েছে একটি বিশাল ধ্যান কক্ষ এবং চারপাশে রয়েছে কয়েক হাজার ছোট ছোট বুদ্ধ মূর্তি। দেখে মনে হয় যেন ওখানে বসেই উনি সারা বিশ্বের ওপর নজর রাখছেন। এরপর দেখলাম Nat।onal Memor।al Chorten, যেটা বানানো হয়েছিল তৃতীয় Druk Gyalpo র স্মৃতিচারণে এবং বিশ্বের শান্তির প্রতি নিবেদন করা হয়েছিল। এটি একটি অতি সুন্দর সাদা স্তুপা যার মাথায় রয়েছে একটি বৃহৎআকার সোনালী রঙের সর্পিল মুকুট। ভুটানের অন্যতম ভাস্কর্য ও চিত্রকলা এই স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে অনায়াসে প্রকাশ পায়। এই মেমোরিয়ালের প্রান্তের মধ্যে লক্ষ্য করলাম অনেক বয়স্ক ও বয়স্কা মানুষদের ভিড়। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম এরা নাকি সারাদিন এখানেই থাকেন আবার ছেলে মেয়েদের অফিস শেষে তাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যান। আরও শুনলাম যে এখানে সব অফিস কাচারী বিকেল পাঁচটার মধ্যে ছুটি হয়ে যায় যাতে সবাই পরিবার পরিজনের সাথে সময় কাটাতে পারে।
এরপর গেলাম ফোক হেরিটেজ মিউজিয়ামে, যেখানে ভুটানের দেশীয় এবং গ্রামীণ জীবন যাপনের স্বাদ পাওয়া যায়। একসময় চলার পথে গাড়ি থামিয়ে আমাদের টুর গাইড যখন আমাদের নাবতে বলল, তখন মনে হল চোখের সামনে যেন স্বর্গ দেখছি। জায়গাটির নাম Sangayang po।nt, চারিধারে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা, পুরো থিম্পু উপত্যকাটাই এই পয়েন্ট থেকে দৃশ্যমান। দেখা যায়, ভুটানের রাজপ্রাসাদও। অন্যান্য অট্টালিকার ন্যায়, ভুটান রাজপ্রাসাদটিও অত্যন্ত সাধারণ, আড়ম্বরহীন। এখানকার সব অট্টালিকাই ভুটানের ঐতিহ্য মেনেই বানানো হয়। যদিও ভেতরে সমস্ত রকম আধুনিকতা থাকতেই পারে।
মধ্য থিম্পুতে অবস্থিত Changangkha monastry 12th century তে গড়া। এই মনেস্ট্রি এক ধর্মীয়ও তীর্থস্থান। সদ্যোজাত শিশুদের মা / বাবারা এই মন্দিরে বাচ্চাদের নামকরণের জন্য নিয়ে আসেন। বলা হয় শিশুদের অসুস্থতার সময়ও তাদের নিয়ে আসা হয় এই মন্দিরে। মন্দিরের বারান্দায় আবর্তিত সারি সারি প্রেয়ার হুইল এবং এখানকার এক তীব্র আলৌকিক আভাতে এমনিতেই শরীর ও মন দুইই ভাল হয়ে যায়।
এরপর গেলাম Mot।thang Tak।n preserve এ, যেখানে দেখা যায় ভুটানের জাতীয় পশু “Tak।n”। এটি দেখতে বেশ অদ্ভুত, এটির মাথাটি ছাগলের মতো আবার শরীরটা অনেকটা গরুর আদলে গড়া।
থিম্পু শহরের উত্তরপ্রান্তে ওনগ্চু নদীর পাড়ে অবস্থিত এই Dzong এর নাম Tasch।chho Dzong, 1216 সালে স্থাপিত এই Dzong এ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মশাস্র সঞ্চিত রাখা হয়। ফলে এর আরেক নাম “Fortress of rel।g।ous glory” ( ধার্মিক গরিমার দুর্গ )|এই কেল্লার প্রশাসনিক কেন্দ্র পর্য্যটকদের জন্য বন্ধ। সিড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকার পথে রয়েছে ওদের সব তত্ত্বাবধায়কদের আলেখ্য। Dzong এর ভেতরটা বড়ই নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে কেবল শোনা যায় পায়রাদের কোলাহল আর Dzong এর ঘন্টার ধ্বনি।এই Dzong এর ছাদে অপূর্ব সব মান্ডালার কারুকার্য দেখা যায়। সামনে এক বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি এবং অনেক প্রদীপ ও ধূপকাঠি ; প্রসাদ হিসেবে রয়েছে দুধ, চিপস, চকোলেট ফল ও মিস্টি । ঠিক যেন মানুষের খাবার।
পরের দিন ছিল ভুটান ভ্রমণ সূচীর শেষ গন্তব্যস্থল পুনাখা। থিম্পু থেকে পুনাখা যাওয়ার পথে পরে দচুলা পাস। 3100 মিটার উঁচু এই পাহাড়ি পাস এ রয়েছে 108 টি স্তুপা যেটা 2003 সালে ভুটান রানীর মার আদেশে নির্মিত হয়েছিল। ভারতের সাথে যুদ্ধে মারা যাওয়া ভুটানি সৈনিকদের স্মৃতিচারণে বানানো হয়েছিল এই স্তুপাগুলি।
ভুটানের প্রাক্তন রাজধানী পুনাখায় অবস্থিত পুনাখা Dzong, নিঃসন্দেহে এই দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয়। Dzong এর wh।te ওয়াশদ ওয়াল এর উপর বেগুনি রঙের জাকারান্দার ঝোপ, পুরো জায়গাটাকে একটি ভিন্ন রকমের উন্মাদনায় ভরে তোলে। দুই নদী মো চু এবং পহ চু এর সঙ্গমস্থলে স্থাপিত এই Dzong যেন এক পরম সুখের স্থান। ভুটানের সব রাজাদের অভিষেক হয় এই Dzong এ এবং এটি সন্ন্যাসীর শীতের নিলয়ও বটে।
এক ঘন্টার হাঁটাপথ এবং একটি লম্বা ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পৌঁছোলাম Khamsun Yulley Namgyal Chorten এ। পুনাখা উপত্যকার উপরে অবস্থিত এই স্তুপা গড়া হয়েছিল চারতলা প্যাগডোর আদলে এবং এর চারপাশে দেখা যায় আরও অনেক ছোট ছোট স্তুপা। এই স্তুপাগুলো আধ্যাত্বিক সংরক্ষণ ও শান্তির প্রতীক। সাম্প্রতিক হলেও, ‘থান্ডার ড্রাগন’ এর এই দেশ কিন্তু তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাস্কর্য বজায় রেখেই এই স্তুপা গুলি নির্মাণ করেছে।
ওই উঁচু পাহাড়, অফুরন্ত শ্যামলিমা, শীতল বাতাস ও একদল ক্ষুদে সন্ন্যাসীদের সরল নিষ্পাপ হাসি চেয়ে দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল, হয়তো বা একটু ঈর্ষা বললেও ভুল হবে না। শুধু কি এখানেই পাওয়া যায় এত সুখ? এত সহজ সরল জীবন? আমার চোখ দুটি হয় তো পড়ে ফেলেছিল আমাদের চিরহাস্যময়ী ভ্রমণসঙ্গী সেরাব। হঠাৎ বলে উঠল,
“ম্যাডাম, সুখী হওয়া বড় সহজ, তবে সহজ হওয়াটাই যে বড় কঠিন।”
বড় গভীর সেই ফিলোজ়ফি! মনের কোনও এক কোণে জীবনের মত নিবন্ধিত হয়ে রয়ে গেল সেই একটি লাইন।