ঈদুল ফিতরের দীর্ঘ ছুটিকে উপলক্ষ করে অনেকেই দেশের বাইরে ঘুরতে চলে যান। এয়ারলাইন্স এবং ট্যুর কোম্পানিগুলো এই ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে দেশ ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে ঈদের ছুটিতে বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা। করোনা মহামারির জন্য মাঝের প্রায় দেড় বছর সীমিত ছিল বিদেশে পরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু গত এক বছর ধরে আবারো সরব হয়ে উঠেছে দেশ-বিদেশের পর্যটন শিল্পগুলো। চলুন, ঈদের ছুটিতে সেরা কয়েকটি দেশ ভ্রমণের ব্যাপারে জেনে নেয়া যাক।
ঈদের ছুটিতে ভ্রমণের জন্য সেরা কয়েকটি দেশ
ভারত
পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় ভারতের প্রদেশগুলো বাংলাদেশি ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের তালিকায় সব সময়ই শীর্ষ স্থানে ছিল। বিশেষ করে কলকাতা, জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচলের মানালি ও শিমলার মত জনপ্রিয় স্থানগুলো বছর জুড়ে প্রতিটি ছুটিতে লোকারণ্যে পরিণত হয়।
কলকাতার সাথে সরাসরি পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছাকাছি এই সবৃহৎ শহরটি হতে পারে ছুটি কাটানোর দারুণ একটি উপায়। এর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ফোর্ট উইলিয়াম, হাওড়া ব্রিজ ও চির নির্ঘুম সড়ক পার্ক স্ট্রিট-এ কোন এক বিকেল অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকতে পারে।
মানালির সোলাং ভ্যালিতে ক্যাম্পিং ও অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট্স, রাফটিং, আর পাহাড় ট্রেকিং এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার যোগান দিতে পারে। প্রাচীন ভারত ও বৃটিশ সভ্যতার রসায়ন দেখতে হলে হারিয়ে যেতে হবে শিমলাতে।
আর জম্মু কাশ্মীরের পাহাড় চূড়ার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো প্রকৃতির প্রেমের পাশাপাশি অনুভূতি দেবে আধ্যাত্মিকতার।
কলকাতার ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ভারতের যে কোন প্রদেশেই ভ্রমণ করা যায়। সরাসরি বাসে ৯০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০০ টাকায় পৌঁছে যাওয়া যায় প্রাচীন শহর কলকাতায়। অতঃপর হিমাচল ও জম্মু-কাশ্মীরের ভাড়া বাবদ খরচ পড়তে পারে প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
কলকাতার নিউমার্কেট, মারকুইস স্ট্রিট পার্ক, রফি আহমেদ রোড ও সদর স্ট্রিট-এর হোটেলগুলোতে খাওয়া-দাওয়া এবং রুম ভাড়া প্রায় ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা। হিমাচল ও জম্মু-কাশ্মীরে থাকা-খাওয়া সব মিলিয়ে জনপ্রতি একদিনের খরচ সামলাতে হবে চার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মত।
ভুটান
ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য পুনাখা, পারো অথবা রাজধানী শহর থিম্পু হতে পারে দারুণ একটি জায়গা।
পায়ে হেটেই ঘোরা যাবে থিম্পুর সিটি ভিউ পয়েন্ট, ক্লক টাওয়ার, মেমোরিয়াল চর্টেন, থিম্পু নদী, পার্লামেন্ট হাউস ও থিম্পু জং।
পুনাখার পুনাখা জং, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও ফোক হেরিটেজ মিউজিয়াম দেখতে দেখতে পুরো একটা দিন ফুরিয়ে যাবে। তবে রাফটিং না করলে পুনাখার মজার পুরোটাই বাকি থেকে যাবে।
থিম্পু, ভুটান (ছবি: সংগৃহিত)
ভুটানের সর্বোচ্চ রাস্তা পারোর চেলে লা পাস। এখান থেকে অপরূপ জলমহরি পর্বতের দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। ফেরার পথে টাইগারস নেস্ট, রিনপুং জং, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, কিচু ও পারো মনস্ট্রি, পারো চু ঘুরে দেখা যেতে পারে।
ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা রুট ব্যবহার করে প্রবেশ করতে হবে থিম্পুতে। স্থলপথে গ্রুপ করে গেলে ৪ থেকে ৫ দিন ঘোরাঘোরিতে জনপ্রতি খরচ হতে পারে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়ার জন্য গুণতে হবে প্রায় ২,৭০০ থেকে ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত।
নেপাল
ঈদের দীর্ঘ ছুটিটা এশিয়ার বিখ্যাত হিমালয়ের সাথে কাটাতে হলে যেতে হবে নেপালে। হিমালয়ের অন্নপূর্ণা সার্কিট, পোখারা, হিমালয়ের উপরে সূর্যোদয় দেখার জন্য নাগরকোট,
হিমালয়ের চূড়ায় পৌঁছতে এখানে অভিযাত্রীদের সঙ্গী হবে উত্তর-পশ্চিম নেপালের অন্নপূর্ণা সার্কিটের ভূবন ভোলানো দৃশ্য। নাগরকোট দেখাবে হিমালয়ের শিয়রে মন্ত্রমুগ্ধ সূর্যোদয়।
কাঠমান্ডু, নেপাল (ছবি: সংগৃহিত)
আর বাঞ্জি জাম্পিং, রাফটিং, কায়াকিং ও প্যারাগ্লাইডিং-এর জন্য পোখারা ঘুরতে না গেলে নেপাল ভ্রমণের ১৬ আনাই বৃথা।
কাঠমান্ডুর এয়ারপোর্টে অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে প্রবেশ করা যায় নেপালে। প্রথমবারের মত নেপালের পর্যটক হলে ভিসার প্রয়োজন নেই। তবে একই বছরে আবার ভ্রমণে গেলে একাধিক ভিসার আবেদন করতে হয়।
ভুটানের মত এখানেও স্থলপথে যেতে হলে ভারতের ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন হয়। ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা হয়ে নেপালের পোখারায় পৌঁছতে ট্রেন ও বাসে খরচ পড়বে প্রায় ৩,৫০০ টাকা। থাকা-খাওয়ায় জন্য প্রত্যেকের গুণতে হবে দিন প্রতি প্রায় ২,৫০০ থেকে ৩,৫০০ টাকা পর্যন্ত।
সিঙ্গাপুর
ছবির মত এই দ্বীপদেশটি পর্যটকদের জন্য যেন নিজের সমস্ত সৌন্দর্য্য উজাড় করে দিয়েছে। এখানকার মূল আকর্ষণগুলো একটি হচ্ছে মেরিনা বে স্যান্ড্স। এর ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট খাল। এছাড়া এর আর্টসায়েন্স মিউজিয়াম এবং স্কাইপার্ক অবজারভেশন ডেক বেশ জনপ্রিয়। এই ডেক থেকে চোখে পড়ে ডাবল হেলিক্স ব্রিজ, মালয়েশিয়ার জোহর প্রণালী এবং ইন্দোনেশিয়ার স্পাইস দ্বীপমালা। এছাড়া সিঙ্গাপুরের বিস্ময়ের স্বাক্ষর ধরে রেখেছে বিশ্বের বৃহত্তম দৈত্যাকার নাগোরদোলা সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার।
আন্ডারওয়াটার অ্যাকোয়ারিয়াম-এর ডলফিন ছাড়াও সেন্তোসা দ্বীপের মুল আকর্ষণ হলো মার্লিয়ন নামের অর্ধেক সিংহ ও অর্ধেক মাছের ভাস্কর্যটি।
এছাড়া সিঙ্গাপুরের বাইরে থেকে আগত যে কাউকে হতবাক করে দিতে যথেষ্ট এর দশ তলা জুয়েল চ্যাঙ্গি বিমানবন্দরটি।
জুয়েল চাঙ্গি এয়ারপোর্ট, সিঙ্গাপুর (ছবি: সংগৃহিত)
সিঙ্গাপুরে যেতে হলে ঢাকাস্থ কনস্যুলেট অনুমোদিত ভিসা এজেন্টের মাধ্যমে ভিসা নিতে হবে। ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম আকাশপথ আর তাতে খরচ হবে নূন্যতম ৩৫,০০০ টাকা।
মোস্তাফা সেন্টারের কাছে মিনি বাংলাদেশ নামক স্থানটিতে বেশ কিছু বাজেট হোটেল আছে। থাকা-খাওয়া সব মিলিয়ে সিঙ্গাপুরের ভেতরে খরচ হতে পারে নূন্যতম ৩,০০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২১,৮০০ টাকা।
থাইল্যান্ড
ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে ঘুরতে হলে সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি হলো থাইল্যান্ডের পাতায়া সমুদ্র সৈকত। প্যারা গ্লাইডিং এর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি এখানে আরো জনপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে আন্ডারওয়াটার অ্যাকুয়ারিয়াম, বিগ বুদ্ধা, ও স্যাঙচুয়ারি অফ ট্রুথ।
রাজধানী শহর ব্যাংককে আছে গ্র্যান্ড প্যালেস ও ভাসমান বাজার। আর ফুকেটের বাঞ্জি জাম্পিং থাইল্যান্ড ভ্রমণে এক দারুণ মাত্রা যোগ করবে।
পাতায়া সমুদ্র সৈকত, থাইল্যান্ড (ছবি: সংগৃহিত)
থাইল্যান্ড ভ্রমণের ক্ষেত্রে মাস দুয়েক আগে থেকে বিমানের টিকেট কেটে রাখা উচিত। রিটার্ন টিকেট সহ বিমান ভাড়া পড়তে পারে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। গ্রুপ করে গেলে হোটেল খরচে বেশ ক্ষাণিকটা সাশ্রয় মিলবে। আবাসন ও খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বাজেট রাখতে হবে। গ্রুপ ভ্রমণ মোটের উপর ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যেতে পারে।
মালয়েশিয়া
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের চূড়া অথবা লঙ্কাউইয়ের সমুদ্রের আন্ডারপাস রাস্তা; এর যে কোনটিতে কাটানো সময় ঈদের ছুটিটাকে করতে পারে জীবনের সেরা মুহুর্তগুলোর একটি। এরকম বেশ কিছু বিস্ময়কর জায়গাতে পরিপূর্ণ রেইনফরেস্টের দেশ মালয়েশিয়া। নৌকা নিয়ে অবলীলায় হারানো যেতে পারে গা ছমছমে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের লেকে।
২২,০০০ থেকে ২৭,০০০ টাকায় যাওয়া-আসা সহ পাওয়া যাবে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার প্লেন টিকেট। থাকা-খাওয়া সহ ঘোরাঘুরিতে একেক জনের দিনপ্রতি নূন্যতম ৫,০০০-১০,০০০ টাকার বাজেট হিসেবে আনতে হবে।
টুইন টাওয়ার, মালয়েশিয়া (ছবি: সংগৃহিত)
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়া বলতে ভ্রমণপিপাসুরা বোঝেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য বালি সমুদ্র সৈকতকে। সমুদ্র প্রিয় মানুষদের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে এখন পর্যন্ত নিজের অবস্থানটি ধরে রেখেছে এই ইন্দোনেশিয়ান প্রদেশটি।
অন্যান্য আকর্ষণীয় জায়গার মধ্যে অন্যতম বাটাম দ্বীপ। এর দক্ষিণ উপকূলের বেয়ারল্যাং নামক ঝুলন্ত সেতুগুলো এক অদ্ভূত মোহনীয় আবেশ তৈরি করে দর্শনার্থীদের মধ্যে।
ইন্দোনেশিয়ার জন্য মুলত কোন ভিসার দরকার পড়ে না; শুধুমাত্র ত্রিশ দিনের এক্সেমশন ভিসা নিতে হয়।
এখানকার মুদ্রার দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম। স্বভাবতই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা এখানে তেমন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। মাস দুই আগে প্লেনের টিকেট ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে ব্যবস্থা করা যায়। ১৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা খরচ করলে খাওয়া-দাওয়া সহ ভালমানের হোটেলের বন্দোবস্ত করা যায়।
জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া (ছবি: সংগৃহিত)
শেষাংশ
করোনা মহামারির স্থবিরতা কাটতে না কাটতেই দ্রুত হারে বেড়েছে ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার ধুম। লক ডাউনের জড়তায় পর্যুদস্ত ভ্রমণপিপাসুরা যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। সেই সাথে পর্যটনের উপার্জনের খাতায় যোগ হয়েছে বিস্ময়কর কতগুলো সংখ্যা। এই সংখ্যাগুলো বিরাট অবদান রেখেছে কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির পুনরায় এর নিজস্ব স্পন্দনে ফিরে আসাতে। দেশ-বিদেশের দর্শনীয় জায়গাগুলো আবারো পূর্ণতা পাচ্ছে বহু জাতির পদচারণায়।