1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২০ পূর্বাহ্ন

লাংকাবি : যেখানে প্রকৃতি মিশেছে আপন মহিমায়

  • আপডেট সময় শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪

কুয়ালালামপুর থেকে পেনাং হয়ে লাংকাবি। জর্জটাউনের বোর্ডিং পাস পার হয়ে সুপার ফার্স্ট ফেরি যখন সমুদ্রের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে, একপাশে শহর আর অন্য পাশে সবুজ পাহাড়। এরই মাঝ দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু।

দুপুর আড়াইটায় টানা রোদের মধ্যে যাত্রা শুরু হলেও ঘণ্টাখানেক পরে রোদের তাপ কিছুটা কমল। এবার সুযোগ মিলল ছাদে যাওয়ার।

বলা হয় পাহাড়, সমুদ্র আর সমতল ভূমির চমৎকার এক দেশ মালয়েশিয়া। দ্বিতীয়বারের মতো সেটা নিজ চোখে দেখলাম। প্রথমবার এ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সাবাহ গিয়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে সাংবাদিক হিসেবে আমাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল।

পেনাং থেকে লাংকাবি যেতে সময় লাগল সাড়ে তিন ঘণ্টা। ফেরি থেকে নামতেই চোখে পড়ল বিশাল আকৃতির ঈগল মূর্তি। টুইন টাওয়ার দেখলে যেমন কুয়ালালামপুর বোঝা যায় এটা দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে এটা লাংকাবি। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এখানে প্রবেশমুখে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ওয়েলকাম টু লাংকাবি।

মালয়েশিয়ার অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কিছুটা কম। তবে যতটা শুনেছি ততটা নয়। আসলে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালো অবস্থানে গেছে খুব কম বাংলাদেশি। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণির। গুটিকয়েক বাংলাদেশি বৈবাহিক সূত্রে কিংবা ব্যবসায়িক সূত্রে এখানে অবস্থান করে নিয়েছেন। এঁদেরই একজন বোরহান। যিনি বৈবাহিক সূত্রে এখন এখানকার নাগরিক। অল্পতেই বোঝালেন এই দ্বীপে তাঁর ক্ষমতা। জানালেন লাংকাভিতে যত ট্যাক্সি চলে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন তাঁরই শ্বশুর।

আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা ক্ষমতাধর বোরহানের হাত থেকে মুক্ত হয়ে জাকির নামে এক ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম। আগে থেকেই তাঁর বাংলোতে থাকার সিদ্ধান্ত ছিল। তবে সাক্ষাতে জানালেন, সে সুযোগ মিলছে না। বাংলাদেশ থেকে আসা বড় মাপের একজন ভিআইপি ২৯ তারিখ পর্যন্ত দখল করে রাখবে বাংলো। অগত্যা হোটেল খোঁজা। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করলেন জাকির ভাই।

সমুদ্রতীরের এই হোটেলটি প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হয়ে গেল। হোটেলের নাম এ বি। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল সমুদ্রসৈকত। লবি হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই পরিচয় হলো কয়েকটি বাঙালি পরিবারের সঙ্গে, যাঁরা ঈদের পর ছুটি কাটাতে এসেছেন এখানে। শুনলাম, জাতীয় দলের ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদ সেদিন সকাল পর্যন্ত এই হোটেলেই ছিলেন। পরিচয় হলো বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ এক প্রকৌশলীর সঙ্গে। সপরিবারে যিনি এসেছেন এখানে।

হোটেলে সার্বক্ষণিক কাছে পাবেন বিপুল, জাকির, হাসান নামে বেশ কিছু বাংলাদেশি তরুণকে, যাঁরা এখানে পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে কাজ করে আসছেন। বলে রাখা ভালো সমুদ্রতীরবর্তী হোটেলে না উঠলে লাংকাবি আসাটাই আপনার বোকামি মনে হবে।


যখন তৃতীয় তলার সি-ভিউ হোটেলের রুমে প্রবেশ করলাম তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। তর আর সইছে না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে সস্ত্রীক আমি সমুদ্রে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, সেই সেন্ট মার্টিনের স্মৃতিমাখা যাত্রা শেষে আমরা আবার সমুদ্রে। ভীষণ, ভীষণ ভালো লাগছে।

আন্দামান সমুদ্রের লাংকাবির যে সৈকতে আমরা নামলাম সেখানকার ঢেউটা একেবারে টলমলে। অনেকটা সেন্ট মার্টিনের মতো মনে হবে আপনার। তবে সেন্ট মার্টিনের পানিটা আরো স্বচ্ছ। মালয়েশিয়ানরা এই সমুদ্র আর সৈকত নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্ব করে। কারণ আমার ঘুরে দেখা জহুর বাহরু, পেনাং, মালাক্কা, এমনকি সাবাহ, সারওয়াক এর সমুদ্রেও খুব একটা ঢেউ নেই। নেই লম্বা সমুদ্রসৈকতও। এখানে বেড়াতে আসা বাংলাদেশিরা অকপটেই স্বীকার করলেন এই সমুদ্র এবং সৈকত আমাদের কক্সবাজারের কাছে কিছুই না।

তবে এটা অনেক পরিকল্পিত, যার কারণে এখানকার চারপাশ খুবই সুন্দর। পরিকল্পনার ছোঁয়া লাগলে আমাদের কক্সবাজারও এর সৌন্দর্যকে হার মানাবে বলে মন্তব্য তাদের। কক্সবাজারের উত্তাল ঢেউ, বিশাল সৈকত কোনোটাই নেই এখানে। তবে এখানে যেটা আছে তা হচ্ছে নীল জলরাশির মাঝে আকাশ, পাহাড় আর সমুদ্রের দারুণ একটা সমন্বয়। পরিকল্পনা আর পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া সমুদ্রসৈকতের কোণায় কোণায় খুঁজে পাবেন।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামল। বন্ধ হয়ে গেল স্পিড বোট, ব্যানানা বোট, প্যারাসুটসহ অন্যান্য জলযান। এই মুহূর্তে সমুদ্রের মাঝে সূর্য ডোবা দেখতে ইচ্ছে করছে। আবারও মনে পড়ে গেল প্রিয় মাতৃভূমির অকৃত্রিম সুন্দর কুয়াকাটার কথা। অবহেলা আর অযত্নে যে কুয়াকাটা আজ বিলীন হতে বসেছে।

মালয়েশিয়ার সৌন্দর্য খুঁজতে লাংকাবি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বলা যায়, দেশটির সবখানেই সৌন্দর্যের ছোঁয়া লেগে আছে। তবে আমার দেখা লাংকাবির সৌন্দর্য সম্পূর্ণ অন্যরকম। অনেকের মতে,  মালয়েশিয়ার স্বর্গ ৯৯ দ্বীপের এই লাংকাবি।

ভোর ৬টা। লাংকাবিতে আমাদের দ্বিতীয় দিন। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধুই নীল জলরাশি। সিনাং বিচে আছড়ে পড়া ঢেউ এর শো শো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দেশি বিদেশি পর্যটকরা এরই মধ্যে সান বাথের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অপেক্ষা না করে আমরাও নেমে গেলাম সমুদ্র তটে। তবে বেশিক্ষণ থাকা হলো না কারণ পাহাড় দেখতে যেতে হবে। হোটেলের লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাস আমাদের পৌঁছে দিল ঘাটে। সেখানে সারি সারি অনেকগুলো স্পিডবোট বাঁধা। একটা বোটে উঠে পড়লাম, কিন্তু হঠাৎ করে নদীর মাঝে থেমে গেল বোট।

আঙুল উঁচিয়ে দর্শনার্থীদের একটা কিছু দেখানোর চেষ্টা করছেন বোটচালক। একটু খেয়াল করেই বুঝলাম এটাই সেই মেইডেন প্রেগনেন্ট ওম্যান, রাতে সবাই মিলে যাকে নিয়ে অনেক গবেষণা চলেছে। ভালো করে পাহাড়টি দেখলে মনে হয় একজন গর্ভবতী নারী শুয়ে আছেন। আর সে কারণেই এমন নাম।

যদিও এই পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। ম্যাট তেজা নামে এক পরদেশী প্রেমে পড়েন মামবাং সেরি নামে এক রাজকুমারীর। ওই পাহাড়েই মামবাং সেরি বাচ্চা প্রসব করেন। তবে বাচ্চাটি কম সময়ের ব্যবধানে মারা যায়, যা তারা মেনে নিতে পারেনি। পরবর্তীকালে ওই দম্পতি পাশের একটি লেকে বাচ্চাটিকে ভাসিয়ে রেখেছিলেন।

ডায়াং বান্তিং এর ওই লেকটিও ‘লেক অব দ্য প্রেগনেন্ট মেইডেন’ নামে পরিচিত। এই দ্বীপে যখন আমাদের বোট এসে থামল তখন ১০টা বেজে ৪০ মিনিট, এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো লেকটা ঘুরে দেখার জন্য। ফিরে আসার সময় মনে হলো দ্বীপটি ঘুরে দেখার জন্য এক ঘণ্টা সময় যথেষ্ট নয়। তবে লাংকাবি এসেছেন আর এই ট্যুরে যাঁরা আসেননি তাঁরা অনেক কিছুই মিস করেছেন।

কারণ খরচের তুলনায় মাত্র চার ঘণ্টার এই ট্যুরটি আপনার জন্য চমৎকার একটি বিনোদন হবে। উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে কুমারী গর্ভবতীর লেকে যেতে আপনাকে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে। কারণ যে কোনো মুহূর্তে পা ফসকে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। প্রায় ১০ মিনিটের পথ হেঁটে আমরা লেকের নিচে নামলাম যেখানে হাঁটা-চলা ও গোসলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।

লেকের বর্ণনাটা একটু না দিলেই নয়। চারপাশে পাহাড়বেষ্টিত একটি লেক। চমৎকার এই স্থানটিতে দেখতে দেখতে কেটে গেল এক ঘণ্টা। বলা যায় ফিরে না আসার একটা ইচ্ছা নিয়েই সেখান থেকে রওনা হলাম পরবর্তী স্পটে যাওয়ার জন্য।

স্পিড বোট চলল ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো। দুই পাশে জঙ্গল আর মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ পানির শান্ত সমুদ্র। যেখানে বোর্ডটি থামল সেটা সত্যিই মনে রাখার মতো একটি দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে সামুদ্রিক ঈগল উড়ছে আর পানি থেকে খাবার খাচ্ছে।

বেশ কিছু ছবি তোলার পর সেখান থেকে আবারও প্রস্থান। এবার পৌঁছালাম বেরাস বাসাহ নামে স্বচ্ছ পানির কোরাল দ্বীপে। এখানে এসে গোসল করার লোভ সামলানো মুশকিল। তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ ওপরে সাপ আর নিচে উঁচু নিচু কোরালের আঘাতে পা কেটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাদা বালুর (হোয়াইট স্যান্ড) এই দ্বীপে সবকিছু ঘুরে দেখার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে এক ঘণ্টা। চমৎকার কিছু সময় কাটানোর পর এবার ফেরার পালা। তবে সত্যি বলতে ফিরতে  ইচ্ছে করে না। সবুজ প্রকৃতির মাঝে থাকতে ইচ্ছে করে যতক্ষণ পারা যায়। প্রকৃতির কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা মনে পড়ে গেল। ইচ্ছে করল তাঁর “Tintern Abbey”, কিংবা “I Wandered Lonely as a Cloud” কবিতার অংশ বিশেষ আবৃত্তি করি :

আমরা ফিরে এলাম হোটেলে, তবে মন পড়ে থাকল সেই পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে। নীল জলরাশির মধ্যে ভেসে বেড়ানোর এই মুহূর্তগুলো আমার স্মৃতিতে থাকবে চিরস্মরণীয় হয়ে। হোটেলের রুমে ফিরে আর ঘুমের সঙ্গে পেরে ওঠা গেল না। তিন ঘণ্টার লম্বা একটা ঘুম দিয়ে যখন উঠলাম, তখন সান্ধ্য সমুদ্র স্নানের সময় পেরিয়ে গেছে।

তবু সৈকত ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে রাত ১০টা। সবশেষ দিন দুই আগে বাঙালি খাবার পেটে পড়েছিল। অগত্যা আবারও সেই খাবারের সন্ধানে বের হলাম। একটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট থেকে গাড়ি পাঠাল আমাদের নিতে। শুধু আমাদের জন্য নয়, লাংকাবিতে এই রেস্টুরেন্টের কাস্টমার সেবারই অংশ এটি। ডাল, আলু ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, ভাজি, সবজি, মুরগি, গরুর গোশত সবকিছুই ছিল খাবারের মেন্যুতে।

রাত ২টার দিকে ফিরে গেলাম সৈকতে। নিরাপত্তাবিষয়ক নিশ্চয়তা হোটেল থেকে আগেই পেয়েছি। লাংকাবির রাতের সমুদ্র অন্যরকম। একদিকে নীরবতা, অন্যদিকে নীল সমুদ্রের মাঝে সবুজ পাহাড়। চাঁদের আলোতে যা আরো ঝলমলিয়ে উঠেছে। রুমে ফিরব তার আগে আবৃত্তি করলাম আমাদের সেই পরিচিত কবিতা :

‘লাংকাবির অসমাপ্ত সফরের শেষ দিনে ঘুম ভাঙল দেরিতে। হোটেলবয় বিপুল, জাকিরদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম ফেরার উদ্দেশে।  ঈগল স্কয়ারে কিছু ছবি তুলে বিদায় জানালাম লাংকাবিকে। মনে মনে বললাম আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে কোনো একদিন। তোমার ৯৯টা সৌন্দর্যের বড়জোর নয়টা আমি দেখেছি।

পরেরবার এসে যে সুন্দর ও দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখা হয়নি সেগুলো দেখব। মন ভরে উপভোগ করব। অনেক সময় নিয়ে আসব। বিদায় লাংকাবি। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিয়ে এভাবেই বিদায় নিলাম।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com