1. [email protected] : Cholo Jaai : Cholo Jaai
  2. [email protected] : admin2024 :
বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩১ অপরাহ্ন

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘সন্দ্বীপ’ এখন স্বর্গদ্বীপ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

হিংস্র ঢেউ আর ভয়ংকর জলরাশি এর নাম বঙ্গোপসাগর। যার সাথে মিশে আছে লক্ষ মানুষের জীবিকা আর জীবনের গল্প। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে, বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্ব কোণে, মেঘনা মোহনায় অবস্থিত অতি প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপ। ছোট্ট এই দ্বীপে প্রায় চার লক্ষ মানুষের বসবাস।

নামকরণ: সন্দ্বীপের নাম নিয়ে মানুষের মুখ থেকে শোনা যায় নানা গল্প। কেউ বলেন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, বেসামাল বঙ্গোপসাগরের বুকে এই সুন্দরী জলকন্যা সর্বপ্রথম ছিল জনমানুষহীন। তাই সর্বপ্রথম এর নাম ছিল শূন্যদ্বীপ। কেউ বলেন চন্দ্রদেবতা সোমের নাম অনুসারে দ্বীপ রানি হয়েছে সোম দ্বীপ। কেউবা বলেন দ্বীপের মাটির উর্বরতার দিক বিবেচনা করে আদর করে নাম দিয়েছি স্বর্ণদ্বীপ।ভাষার বিবর্তনে পড়ে সব নাম পেরিয়ে আজ সে সন্দ্বীপ।

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সন্দ্বীপ। যেখানে সকাল হলেই রাখাল তার গরু নিয়ে চলে যায় দিগন্ত ভরা মাঠে। শিউলিতলায় ফুল কুড়াতে নামে শৈল্পিক কোনো ভুবন। যেখানে সন্ধ্যা নামলেই বসে জোনাকির হাট। বসন্তকালে কুলিলের ডাকে মুগ্ধ হয়ে যায় মন। যেখানে রাত নামলেই ডাব গাছে উঠে শৌখিন চোর। শীতের সকালে কুয়াশায় ভরে যায় চারদিক। রোদ পোহাতে বাড়ির উঠানে জমে বুড়া-বুড়ির আড্ডার আসর।

সন্দ্বীপে যেমনি রয়েছে নৈসর্গিক রুপ, তেমনি রয়েছে নদী, পুকুর, ও বিলে দেশীয় বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু মাছের ছড়াছড়ি। এছাড়া এখানে গরু-মহিষের দুধ, দই ও খেজুরের রস পাওয়া যায়। রয়েছে নানারকম শাক-সবজি ফসলের ক্ষেত। অপূর্ব সবুজের বেষ্টনী দর্শনার্থীর মন কেড়ে নেয়। এখানে শীতকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠে। জেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে পাখিরাও মাছ শিকার করে।দলবেঁধে পাখিদের উড়াউড়ি মন কেড়ে নেয়। গ্রামের সহজ-সরল ছেলে মেয়েরা দলবেঁধে হেটে চলে স্কুল কলেজে।

এ দ্বীপের অনেক কিছু হারিয়ে যায় নদী গর্ভে। নদীর এ করালগ্রাসের পরও এখনো বেশ সমৃদ্ধির পসরা সাজিয়েছে সন্দ্বীপ। ম্যানগ্রোভের দৃষ্টিনন্দন বেষ্টনি, বিশাল সবুজ চর, ঐতিহাসিক শুকনা দিঘী, গুপ্তছড়া ঘাটের বিশাল জেটি রাস্তা সহ সবুজের অসংখ্য পটে আঁকা দৃশ্য। দৃষ্টি জুড়ে সবুজ আর সবুজ, অসংখ্য পাখির কলতান, মিষ্টি বাতাস, সুবিশাল নীল আকাশ আর মাটির টান। ভালো লাগার এক অনন্য দৃশ্যপট তুলে ধরবে সবার দৃষ্টিজুড়ে। ইচ্ছে হবে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির সাথে মিতালি বেঁধে সবুজ স্নানে স্বপ্ন আঁকতে।

রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি সাহিত্যিক ঐতিহাসিক পর্যটক এসেছেন এখানে। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপ আসেন। ১৫৬৫ সালে ডেনিশ পর্যটক সিজার প্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারি মোজাফ্ফর আহম্মদের সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সন্দ্বীপে ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিতেই কাজী নজরুল ইসলাম তার মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তার চক্রবাক কাব্য গ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।

খ্যাতি: এক সময় সন্দ্বীপে নির্মিত হতো ভুবন জয় করা জাহাজ শিল্প। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি করা হতো জাহাজ। তখনকার সময়ে কম খরচে পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দর ও মজবুত জাহাজ নির্মাণ হতো সন্দ্বীপেই। তাই তুরস্কের সুলতান সন্দ্বীপের তৈরি জাহাজের প্রেমে পড়ে সন্দ্বীপ থেকেই কিনে নিয়েছিলেন জাহাজ। তা ছাড়াও নোনা জল থেকে আহরণ করা লবণ শিল্পের জন্য একটা সময় সন্দ্বীপ ছিল বিখ্যাত। শস্য সম্পদে সন্দ্বীপ ছিল আপন প্রাচুর্যে পূর্ণ। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধিশালী বন্দর হিসেবেও সন্দ্বীপ ছিল সমাদৃত। কালের আবর্তনে এসব একসময় হারিয়ে যায়। এই সব এখন শুধুই স্মৃতি।

নিউইয়র্ক সিটির ‘ব্রুকলিনে’ এত বেশি সন্দ্বীপী বসবাস করে যে, একে দ্বিতীয় সন্দ্বীপও বলা হয়ে থাকে। রক্তের সাথে মিশে আছে এই দ্বীপের মায়া,ভালবাসা। বৈদাশিক মূদ্রা অর্জনের জন্য এই দ্বীপের আলাদা খ্যাতিও রয়েছে। বাংলাদেশের মোট বৈদাশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ যোগান দিচ্ছেন এই দ্বীপের মানুষ এবং উপজেলা ভিত্তিক সন্দ্বীপ প্রথম। অতিথি পরায়ণের দিক দিয়ে এ দ্বীপের রয়েছে আলাদা সুনাম। এমনও নজির আছে, অচেনা পথিক খাবার পানি চাইলে, ডাবের পানি দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন এই দ্বীপের মানুষ। সন্দ্বীপ শিবের হাটের বিনয় সাহা’র মিষ্টির সুনাম বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে আছে। নানা জাতের পাখি, নারকেল গাছ, সুপারি গাছ আর মৌসুমি ফলের গাছে ভরা বাগান, পুকুর ভর্তি মাছ, প্রতিদিন সাগরের তাজা মাছ, শীতকালে রসের সমাহার এসব এই দ্বীপের অহংকার।

এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল সোলার প্যানেল ‘পুরবী’ এই দ্বীপে অবস্থিত। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এখান থেকে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন।

ব্যক্তিবর্গ: এই দ্বীপে জন্ম নিয়েছেন সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্তের মহাকবি আব্দুল হাকিম, কবি মিন নাথ, কবি বেলাল মোহাম্মদ, পাকিস্তানের প্রথম গন পরিষদ সদস্য রাজ কুমার চক্রবর্তী, ব্রিটিশ পার্লামেন্টরিয়ান সৈয়দ আব্দুল মজিদ, বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী আবু তোরাব চৌধুরী, বাংলাদেশ সিরামিক শিল্পের জনক ওবাইদুল হক, কমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও দৈনিক রুপালী পত্রিকার মালিক মোস্তাফিজুর রহমান, ভারতীয় উপমহাদেশের বাম রাজনীতির জনক কমরেড মোজাফফর আহমেদ, বাংলার চারন কবি শাহ বাঙ্গালি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক আবুল কাশেম।

বাংলাদেশের বিখ্যাত স্থাপনার নকশা প্রস্তুত কারি আলমগীর কবির, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক কবি আসাদ মন্নান, বিপ্লবী লাল মোহন সেন, দিলাল রাজা, বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী কাজী আব্দুল কাইয়ুম, এদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা সায়্যিদ আহম্মদ এই দ্বীপেরই সন্তান।

সব মিলিয়ে এই দ্বীপ আমাদের অহংকার। একবার গেলে বারবার ঘুরে আসতে মন চাইবে সবুজ শ্যামলে ঘেরা মায়াময় দ্বীপ ‘সন্দ্বীপ’ থেকে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 CholoJaai
Developed By ThemesBazar.Com