তিনজন মিলে থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে এলাম। সব মিলিয়ে পাঁচদিনের জার্নি। গত বছর বিজয় দিবসে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিলাম। যেকোনও ভ্রমণের ক্ষেত্রে খরচের বড় একটা অংশ চলে যায় যাতায়াতে। তবে চট্টগ্রাম থেকে ব্যাংকক যাওয়া-আসার জন্য বিমান ভাড়ায় আমাদের জনপ্রতি খরচ হলো ১৮ হাজার টাকা। যদিও সবসময় এমন ভাড়া থাকে না। রিজেন্ট এয়ারওয়েজে চড়ে গিয়েছিলাম আমরা, তাদের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ভাড়ায় ছাড় ছিল। তাই টিকিটের দাম কম পড়েছে। এত কম খরচে থাইল্যান্ড ঘুরে আসতে পারবো কখনও ভাবিনি।
দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে আগে থেকে বিমান ও হোটেল বুকিং করে রাখা ভালো। এতে খরচ যেমন কমে আসে, একইসঙ্গে হোটেল খোঁজার ঝক্কিও পোহাতে হয় না। এখন অনলাইনে টিকিট কেনা যায় সহজেই। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিয়ে গেলে ভ্রমণ উপভোগ্য হয় বেশি। তাই আমরা বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুক গ্রুপ থেকে তথ্য নিয়ে পাঁচদিনের জার্নির পরিকল্পনা গুছিয়ে নিয়েছিলাম আগেই।
আমরা ঠিক করেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে ব্যাংকক হয়ে ক্রাবি ও ফিফি আইল্যান্ড যাবো। সেখান থেকে ফুকেট, এরপর ফের ব্যাংকক হয়ে চট্টগ্রামে ফিরবো। ভিসা হাতে পাওয়ার পর থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রুটে ব্যাংকক থেকে ক্রাবি থাই লায়ন এয়ারে আর ফুকেট থেকে ব্যাংককে এয়ার এশিয়ার ফ্লাইটে যাতায়াতের জন্য বিমানের টিকিট কেটে রেখেছিলাম আগেই। এজন্য জনপ্রতি খরচ হলো ৪ হাজার ৭০০ টাকা। সব মিলিয়ে এই ট্যুরে বিমান ভাড়া বাবদ আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছে ২২ হাজার ৭০০ টাকা।
প্রথম দিন
চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের তিনজনের যাত্রা শুরু হলো। ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট উদ্দেশে সকাল ১০টায় বিমান ছাড়লো। দুই ঘণ্টা উড়ে পৌঁছে গেলাম ব্যাংককে। বিমানবন্দরটি অনেক বড়। এত বড় বিমানবন্দর এর আগে দেখা হয়নি। দেখে মনে হলো, এ যেন বিমানের পাইকারি বাজার! বিক্রির জন্য বিমানগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে রাখা হয়েছে।
বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সিম কিনলাম। সাতদিনের জন্য আনলিমিটেড ইন্টারনেট প্যাকেজ নিতে খরচ হলো ২০০ বাথ। সুকুম্ভিট এলাকায় দ্য মিক্স ব্যাংকক হোটেলে আগেই আমাদের বুকিং ছিল। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। মিটারে এলো ৫২৫ বাথ।
ব্যাংককে সুকুম্ভিট এলাকা পর্যটকদের থাকার জন্য বেশ জনপ্রিয়। সেখানে রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, স্ট্রিট ফুড, মানি এক্সচেঞ্জ, নাইট মার্কেটসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। হোটেলে থাকার জন্য জনপ্রতি গুনতে হলো ৫৭০ বাথ।
ব্যাংককে মোটরসাইকেল ভাড়া নেওয়া যায়। আমরা সেই সুযোগ হাতছাড়া করিনি। মোটরসাইকেলে সুকুম্ভিট এলাকা ঘুরেছি প্রায় একঘণ্টা। রাতজাগা শহরও উপভোগ করেছি। দিনের আর রাতের ব্যাংককের মধ্যে মেলা পার্থক্য। চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। রাতে যেন আলোর রাজ্য হয়ে ওঠে এই শহর।
ম্যাকডোনাল্ডসে রাতের খাবার খেয়েই হোটেলে ফিরেছি। কারণ, পরদিন ভোরে উঠেই আমরা যাচ্ছি ক্রাবিতে। প্রথম দিনে আমাদের মোবাইলের সিম কেনা, ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া, হোটেল সব মিলিয়ে ৫৮৫ বাথ খরচ হলো। এরমধ্যে খাবারের খরচ নেই। খাবারের খরচের হিসাব দিচ্ছি পরে।
দ্বিতীয় দিন
ঘুম থেকে উঠে রওনা দিই ডন মিয়াং বিমানবন্দরের উদ্দেশে। আগের রাতে ৪০০ বাথের বিনিময়ে ট্যাক্সি ক্যাব ঠিক করে রেখেছিলাম। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে উঠে বসলাম থাই লায়ন এয়ারে বিমানে। প্রায় একঘণ্টা উড়ে চলে গেলাম পাহাড়ি দ্বীপের নগরী ক্রাবিতে। ক্রাবি বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ক্যাবে চড়ে গেলাম আওনাং বিচের পাশে আমাদের বুকিং করা প্যারাডাইস হোটেলে। ট্যাক্সি ভাড়া এলো ৫০০ বাথ। হোটেলে দিতে হলো ৮৫০ বাথ।
হোটেলে চেক-ইনের পর আওনাং বিচ ধরে হাঁটলাম অনেকক্ষণ। এখানেও চাইলেই মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে চালানো যায়। ৩০০ বাথ খরচ করে আমিও ঘুরলাম।
চারপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ। প্রতিটি দ্বীপ একেক রকমের। দ্বীপের চারপাশে স্পিডবোট কিংবা লংটেইল বোটে চড়ে ঘোরা যায়। যদিও স্পিডবোটে খরচ একটু বেশি। অন্য একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা স্লিপিং আইল্যান্ড ও রেইলি বিচ ঘুরে দেখলাম। এজন্য জনপ্রতি খরচ হলো ৩৫০ বাথ। অবশ্যই ফ্রেশ ফ্রুটস, ডাব ও ফ্রুটস জুস খেতে ভুলবেন না।
রাতের আওনাং বিচ অন্যরকম সুন্দর। সৈকতের পাশে নাইট মার্কেট ও বিভিন্ন ধরনের ইভেন্ট চোখে পড়বে যতদূর চোখ যায়। এভাবেই কেটে যায় ক্রাবির রাত। দ্বিতীয় দিনের ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া, হোটেল, মোটরসাইকেল, বোট, ফেরি ভাড়াসহ সব মিলিয়ে খরচ হলো ১৪৩৫ বাথ।
পরের দিন আমরা যাবো ফিফি আইল্যান্ড। এজন্য রাতেই ফেরির টিকিট কিনেছি। জনপ্রতি ভাড়া ৩৫০ বাথ। ফেরি কর্তৃপক্ষ হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে যাবেন।
তৃতীয় দিন
ঘুম থেকে উঠে রওনা হলাম ফেরির উদ্দেশে। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৯টার ঘরে। ফিফি অ্যাইল্যান্ডের পথে যাত্রা শুরু হলো। যেতে যেতে চোখে পড়ার মতো অনেক দ্বীপ দেখেছি। এরমধ্যে একটি হলো চিকেন আইল্যান্ড। ঘণ্টা দুয়েক ধরে দেখলাম পাহাড় আর পাহাড়।
পংপাং হাউস নামের একটি হোটেলে উঠলাম। ভাড়া ৮০০ বাথ। রুমে গিয়ে একটু জিরিয়ে বের হলাম ঘুরতে। স্বচ্ছ নীলাভ জলে এবার কায়াকিং করার পালা। দুটো কায়াকের একটিতে আমি, অন্যটিতে আমার দুই সহযোদ্ধা। কায়াক ভাড়ার জন্য গেলো ২০০ বাথ। স্বচ্ছ এই নীলাভ শান্ত সাগর হঠাৎ অশান্ত হয়ে পড়লো। আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকায় অন্য কায়াক থেকে আমি অনেকদূর সরে পড়লাম। ঝড়ো হাওয়ায় প্রকৃতির কাছে হার মেনে একটি দ্বীপ ঘেঁষে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমাকে। চ্যালেঞ্জিং ও রোমাঞ্চকর ছিল ব্যাপারটা, তবে ভয় পাইনি।
আবহাওয়া অনুকূল হওয়ার পর ফিরে এলাম। অপেক্ষারত আমার বন্ধুরা আমাকে কাছে পাওয়ার পর জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত। দেখে খুবই অবাক হলাম। আর কিছুক্ষণ পর নাকি আমাকে উদ্ধারের জন্য টিম যেত। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকালে আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। এই ফাঁকে পরদিন ফিফি আইল্যান্ড থেকে ফুকেটে যাওয়ার ফেরির টিকিট কেটে ফেললাম। ভাড়া নিয়েছিল ৩৫০ বাথ।
এবার লং টেইল বোটে রওনা হয়ে মাংকি বিচ, ব্যাম্বো আইল্যান্ডসহ আরেকটি নাম না জানা দ্বীপ দেখলাম। স্নোর্কেলিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। স্বচ্ছ নীলাভ জলে দাপাদাপিও হলো আমাদের। এ যেন প্রাকৃতিক অ্যাকুরিয়াম! লং টেইল বোটের ভাড়া নিয়েছে ৪৫০ বাথ।
মায়া বে নামক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল প্রবল। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর ‘দ্য বিচ’ ছবির শুটিং হয়েছিল সেখানে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থাকায় যাওয়া হলো না। তাতে কী! প্রতিটি দ্বীপই আমার জন্য নতুন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এলো। ফিফি আইল্যান্ড জেগে উঠলো। চাকচিক্যময় আলোর ঝলকানি চারদিকে। বিভিন্ন ধরনের ইভেন্টে পুরা সৈকত যেন বিনোদনের আবাসস্থল। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, নেই কোনও বাধা-বিপত্তি। সবাই যার যার মতো উপভোগ করছে। রাতটা শেষ হয় এভাবেই। তৃতীয় দিনে কায়াক, বোট, হোটেল, ফেরি ভাড়াসহ সব মিলিয়ে খরচ হলো ১২৬৫ বাথ।
চতুর্থ দিন
রাত জাগলেও খুব ভোরে উঠলাম। সূর্যোদয় দেখতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০ ফুট উঁচু ভিউ পয়েন্টে যাওয়ার রাস্তাকে মনে হলো রোমাঞ্চকর ট্রেইল। যত ওপরে উঠছি ততই দৃশ্যমান চারপাশ। একেবারে উঁচুতে ওঠার পর অবলোকন পারলাম এই দ্বীপের প্রকৃত সৌন্দর্য। ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে চারপাশ দৃশ্যমান। দূর থেকে দ্বীপগুলোকে ভাসমান নৌকার মতো মনে হলো। যেন ফ্লোটিং আইল্যান্ড! এখানে ভোরের আলো আসে একটু দেরিতে। আকাশে মেঘ ছিল সাময়িক। সূর্যোদয় উপভোগ করে নিচে নেমে ফের পানিতে দাপাদাপি করলাম।
ফিফি আইল্যান্ডকে বিদায় জানিয়ে ফুকেটে যাওয়ার জন্য উঠে পড়লাম ফেরিতে। যদি থাইল্যান্ডে আবারও আসা হয়, তাহলে বাকেট লিস্টে থাকবে ফিফি আইল্যান্ড।
ফুকেটে পৌঁছাতে লাগলো দুই ঘণ্টা। সেখানে পাতং বিচের পাশেই দ্য সিম্পল বুটিক হোটেলে উঠলাম আমরা। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে থাকতেই সব হোটেল বুকিং করে রেখেছিলাম। হোটেল ভাড়া লেগেছে ১২০০ বাথ।
আমাদের পাতায়ায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পাতং বিচ অনেকটা পাতায়ার মতো। পাতায়ায় যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে, পাতং বিচেও সেগুলো মেলে। সন্ধ্যার পর পাতং যেন অন্য এক জগৎ। নাচ, গান, সুরের ঝংকার, খানাপিনা আর রঙ-বেরঙের আলোয় উৎসবের আমেজ। সন্ধ্যায় ফুকেট টাউনের দিকে গিয়ে পেলাম শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, স্ট্রিট ফুড। ঘুরতে ঘুরতে শপিং করে ফেললাম।
তবে ফুকেট গিয়ে পাতং বিচ সংলগ্ন কোনও মল থেকে কেনাকাটা না করাই ভালো। এজন্য বেশি উত্তম ব্যাংকক। পাতংয়ে শপিং করতে চাইলে ট্যাক্সি চালকদের বললে জুতসই জায়গায় নিয়ে যাবে তারা। আমরা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম ফুকেট টাউনের সিলভা মার্কেটে। পাতং বিচ এলাকার মার্কেটগুলোর তুলনায় অনেক সস্তা জিনিসপত্র। এখানে স্ট্রিট ফুড থেকে হকার্স মার্কেট, শপিং মল সব আছে। লোকাল থাই ফুড আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখলাম। চতুর্থ দিনে সব মিলিয়ে খরচ হলো ৯৭৫ বাথ।
পরদিন খুব ভোরে ফুকেট থেকে ব্যাংককের পথে আমাদের ফ্লাইট। হোটেলের রিসিপশনে বলে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে রাখলাম। ট্যাক্সিভাড়া জনপ্রতি ২৭৫ বাথ।
পঞ্চম দিন
ভোরে ফুকেট বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে একঘণ্টা জার্নির পর পৌঁছালাম ব্যাংককের ডন মিয়াং বিমানবন্দরে। ইন্দিরা মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেট কম খরচে কেনাকাটা করা যায় এখানে।
দেশে ফেরার জন্য আমাদের ফ্লাইট দুপুর ২টায়। আশপাশে ঘোরাঘুরি করে চলে গেলাম সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট। বিমানে চড়ে দুই ঘণ্টায় ফিরলাম চট্টগ্রামে। ২০০ বাথ খরচ হলো শেষ দিন।
এবার দিচ্ছি খাবারের খরচের হিসাব। খরচ নির্ভর করছে মেন্যুর ওপর। মোটামুটি ২০০ বাথ হলেই সেরে নেওয়া যায় দুপুর অথবা রাতের খাবার। আর নাশতার জন্য প্রতিবার ১৫০ বাথের মতো খরচ হবে। পাঁচ দিনে আমাদের খাওয়ার জন্য জনপ্রতি খরচ হলো ৩ হাজার ১০০ বাথ।
১ ডলারের বিপরীতে ৩০ বাথ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার সময় আমরা থাইল্যান্ডের মুদ্রা বাথ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। এতে সুবিধা হলো বিমানবন্দরে নেমেই মোবাইলের সিম কেনা ও ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করা সহজ হয়। সব খরচ যোগ করে পুরো ট্যুরের খরচ দাঁড়ালো জনপ্রতি ৩৯ হাজার ৮২০ টাকা।