৩১ অক্টোবর হিমেল হাওয়ায় ছেলে-বুড়ো সবাই অধীর অপেক্ষায় থাকে কখন দিনের আলো শেষ হবে। একটু অন্ধকার নেমে আসতেই আমেরিকায় শুরু হয়ে যায় ভূতের নৃত্য। পৃথিবীতে যত ভূতপ্রেত আছে, সবাই যেন এই রাতেই চলে আসে লোকালয়ে। বিভিন্ন রঙবেরঙের ভূতুড়ে পোশাকে সজ্জিত এই সব জ্যান্ত ভূতেদের ট্রিট দিতে সকলেই যেন অস্থির। এটিই আমেরিকার জনপ্রিয় হ্যালোইন উৎসব।
যুগ যুগ ধরে আমেরিকা এবং ইউরোপের অধিবাসীরা ৩১ অক্টোবর রাতে হ্যালোইন উৎসব পালন করে আসছে। সারা অক্টোবর মাস জুড়ে এই অনুষ্ঠানের আমেজ লেগে থাকে সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে। এই উৎসবকে ঘিরে তাদের মাতামাতির শেষ নেই।
মূলত ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দের খ্রিস্টিয় ধর্ম থেকে ‘হ্যালোইন’ বা ‘হ্যালোউইন’ শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ ‘পবিত্র সন্ধ্যা’। শব্দটি স্কটিশ ভাষার শব্দ ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে এসেছ। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে ‘হ্যালোজ ইভ’ শব্দটি এক সময় ‘হ্যালোইন’-এ রূপান্তরিত হয়।
প্রায় দুই হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করতো কেল্টিক জাতি। নভেম্বরের প্রথম দিনটি তাদের নববর্ষ বা ‘সাহ-উইন’ হিসাবে পালিত হতো। এই দিনটিকে তারা গ্রীষ্মের শেষ এবং অন্ধকারের বা শীতের শুরু মনে করতো। তারা মনে করতো নতুন বছর শুরুর পূর্ব রাতটি পৃথিবীর জীবিত এবং মৃতের অবস্থানটি একটু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। পৃথিবী ও মৃত ব্যক্তিদের জগৎ এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। তখন মৃত ব্যক্তি ও তাদের আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। তারা যাতে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য মৃত আত্মাদের খুশি করতে সাউইন উৎসব পালন করতো তারা।
মৃত আত্মাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেল্টরা নানান রকম খাদ্য ও ওয়াইন উপঢৌকন হিসেবে দরজার বাইরে রেখে দিত। আত্মার খারাপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিভিন্ন রকম মুখোশ, পশুর খুলি ও চামড়া দিয়ে ভূতুড়ে সাজসজ্জায় নিজেদের সজ্জিত করতো। আত্মার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য রঙবেরঙের পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করা থেকে ঘরকেও এভাবে সাজাতো
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩ শতকে অধিকাংশ কেল্টিক অঞ্চল রোমান সম্রাটের অধীনে চলে আসে। তখন কেল্টিকদের সাউইন উৎসবের সঙ্গে রোমানদের একটি উৎসব যৌথভাবে পালন করা শুরু হয়। সাউইনের প্রাধান্য অবশ্য একটু বেশিই ছিল। অক্টোবরে পালিত হতো কেল্টিকদের সাউইন উৎসব। আর নভেম্বরের প্রথম দিনে পালিত হতো রোমানদের পোমোনা উৎসব।
অষ্টম শতকে খ্রিস্টান চার্চ ‘সাহ-উইন’ উৎসবকে ‘অল সেইন্ট’স ডে’ হিসেবে রূপান্তর করে। এটি ‘অল হালোস’ বা ‘সাধুদের দিবস’ নামেও পরিচিত, যেখানে সাউইন উৎসবের বেশ কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করা হতো। ১ নভেম্বরের সন্ধ্যার আগের সময়টিকে ‘অল হ্যালোস ইভ’ বলা হতো। সেখান থেকেই পরবর্তী সময়ে ‘হ্যালোইন’ শব্দের উৎপত্তি।
হ্যালোইনে ‘ট্রিক অর ট্রিট’য়ের জন্য দায়ী মধ্য যুগের ব্রিটেনের অধিবাসীরা। তাদের ‘সৌলিং’ ও ‘গাইজিং’ প্রথাই বর্তমানে ট্রিক অর ট্রিট হিসেবে প্রচলিত। অষ্টম শতকে চার্চ কর্তৃক পালিত ‘অল সেইন্ট’স ডে’ তে দরিদ্রের জন্য পিঠা বানানো হতো যাকে বলা হতো ‘সৌল কেক’। দরিদ্ররা যে পরিবারের কেক খেত, সেই পরিবারের মৃত মানুষের আত্মার জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হতো যাকে বলা হতো সৌলিং। আর ‘গাইজিং’ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যা মধ্যযুগে বাচ্চারা হ্যালোইনের সময় নানা রঙবেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে খাবার, ওয়াইন ও টাকার বিনিময়ে গান, কবিতা বা কৌতুক শোনানোর জন্য প্রস্তাব করতো।
উনিশ শতকের দিকে ব্রিটিশ, আইরিশ ও স্কটিশরা আমেরিকাতে বসতি স্থাপন করা শুরু করলে ধীরে ধীরে তাদের সেই সৌলিং ও গাইজিং সংস্কৃতি ট্রিক বা ট্রিট হিসেবে রূপান্তরিত হয়। হ্যালোইন উৎসবে দিনের আলো ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গেই ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। সবার গায়ে থাকে রাজ্যের অদ্ভুতুড়ে কস্টিউম। আর হাতে থাকে টর্চ। বাসায় বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে- ‘ট্রিক অর ট্রিট’। যদি কেউ ‘ট্রিক’ বেছে নিলে তাকে কিছু করতে হবে, না হলে ‘ট্রিট’ দিতে হবে। কেউই অবশ্য ট্রিক করতে দেয় না। সবাই ট্রিট দিয়ে দেয় চকলেট। আর সেই চকলেট নেওয়ার জন্য ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই ব্যাগ নিয়ে বের হয়।
আমেরিকায় এই উৎসবের সূচনা : উনিশ শতকের দিকে আমেরিকায় ইউরোপ থেকে প্রচুর লোক আসতে থাকে। আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীরা ছিল এই সংখ্যার দিক দিয়ে প্রচুর। ১৮৪৬ সালের দিকে আইরিশরা আমেরিকায় হ্যালোইন উৎসবকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। আইরিশ ও ইংলিশদের ঐতিহ্য থেকে আলাদা কস্টিউম ও ধারায় হ্যালোইন পালন করতে শুরু করে আমেরিকানরা। আামরিকায় এসে ধর্ম নিরপেক্ষ ও কমিউনিটি-নির্ভর উৎসবে পরিণত হয়। তখন তারা নেচে-গেয়ে, পার্টি করে ছুটির দিনটি পালন করত।
একসময় হ্যালোইনের দিনে রাস্তায় ব্যাপক গোলমাল হতো, হতো অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড। আর সেই কর্মকাণ্ডে ঠেকাতে ১৯৫০ সালে শহরের কর্তারা হ্যালোইন উৎসব নির্দিষ্ট করে দেন। সেই থেকে হ্যালোইন উৎসব ঘরের মধ্যে কিংবা ক্লাসরুমে পালন করা হতো। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবর্তিত হয়ে নতুন এক হ্যালোইন উৎসব চালু হয়েছে যার পেছনে খরচ হয় কোটি কোটি ডলার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম একটি ছুটির দিন হচ্ছে হ্যালোইন।
হ্যালোইন উৎসবে মেকআপ ও কস্টিউম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নানা রকম মুখোশ, বিভিন্ন ভৌতিক চরিত্রের পোশাক। যে যেমন খুশি তেমন সাজো। কারো কোনো বাধা নেই। কেউ হয় রাজকুমার, কেউবা রাজকুমারী, কেউবা প্রজাপতি বা উইনি দ্যা পুহ্-এর টিগার সাজাতেও ভালবাসে। আবার কেউ ভূতুড়ে পোশাকে যেমন: ডাইনী, পিশাচ, জলদস্যু সাজতে পছন্দ করে।
অনেকে বাড়ির সামনেটা ডেকোরেশন করতে ভালবাসে। মাকড়শার জাল বিছিয়ে, কঙ্কাল টাঙ্গিয়ে ভুতুড়ে একটা পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। হ্যালোইনের প্রস্তুতির অপরিহার্য অংশ হলো মিষ্টি কুমড়া। ছুরি দিয়ে কুমড়ার গায়ে চোখের আকৃতির ছোট গর্ত করে, ভেতরে বাতি জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় প্রতীকী দৈত্য, জ্যাক ও ল্যান্টার্ন।
ছোটদের এবার এই ভৌতিক উঠোন পেরিয়ে যেতে হবে ট্রিট নিতে। এভাবে সারা সন্ধ্যা ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি যায়, সংগ্রহ করে আনে ব্যাগ ভর্তি চকলেট। এই একটি দিন আমেরিকায় যেদিন বিনা দ্বিধায় যে কারো বাড়ির আঙ্গিনায় যাওয়া যায় আর অনায়াসে বাড়ির কড়া খটখটালেও কেউ আপত্তি জানায় না।
হ্যালোইন উৎসবের চেয়ে এখন অনেক বেশি ব্যবসায়িক কিংবা বাণিজ্যিক। বড়দিনের পর সবচেয়ে বেশি আয় হয় এই ‘হ্যালোইন উৎসব’ থেকে, যেটাকে ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়ে থাকে। বাজারে দেখা যায় হ্যালোইন কস্টিউম-এর দোকান। কোথাও ডাইনি, কোথাও জলদস্যু, ভ্যাম্পায়ার, স্পাইডারম্যান, জম্বি এবং ব্যাটম্যানের বিভিন্ন পোশাকের বিক্রি বেড়ে যায় এই উপলক্ষ্যে।
সার্বজনীন উৎসব হিসেবে হ্যালোইন উৎসব সারা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। দিন দিন এর বিস্তৃতি বাড়ছে। এই উৎসবকে ঘিরে সারা বিশ্বজুড়ে এই যে মাতামাতি তার মধ্যে বাণিজ্য যেমন রয়েছে, তারই মধ্যে শিশু-কিশোরদেরনিষ্পাপ আমোদও রয়েছে। বর্তমানে দিনটির ঘটা করে পালন করে ইউনিসেফও। তাদের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের অনেকেই এদিন ভূত সেজে ট্রিক অর ট্রিট খেলার ছলে সংগ্রহ করে তহবিল। আর সে তহবিল খরচ হয় অসহায় শিশুদের জন্য।