হালে ইকোনমিক রেপুটেশন একটু পড়তির দিকে হলেও বৈচিত্রের দিক থেকে গ্রিসকে ১০০য় ২০০ নম্বর দেওয়া যেতেই পারে। চার সহস্রাব্দেরও বেশি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, উপকথা জড়িয়ে আছে গ্রিসের সঙ্গে। আর প্রকৃতি যেন বহু আদরে সাজিয়েছেন এই দেশকে। একদিকে সফেন সমুদ্রতট, অন্যদিকে পাহাড়ি উপত্যকা। আর দ্বীপপুঞ্জ তো আছেই। সাংস্কৃতিক আবেশে মোড়া গ্রিসকে কোনও রূপকথার রাজ্য বললে ভুল হবে না। ফেলে আসা ইতিহাস এবং বর্তমানকে আলিঙ্গনকে করে ইওরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুন্দরী গ্রিস।
এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টারের দূরত্ব খুব বেশি নয়। গাড়ি বা লোকাল ক্যাব তো আছেই, তবে এথেন্সের মেট্রো সিস্টেম বেশ উন্নতমানের। সপ্তাহে সাতদিনই চলে, তবে ৩০ মিনিট পর পর আসে। সিটি সেন্টার পৌঁছতে কমবেশি ৪০ মিনিট নেয়। সারাদিনের ধকলের পর হোটেলে একটু জিরিয়ে বেরিয়ে পড়ুন সাইটসিয়িং-য়ে। প্রথম দর্শনে এথেন্সের প্রেমে পড়ে যাবেন বা প্রাচীন শতাব্দীর ফেলে আসে ইতিহাসের আঁচ পাবেন, তা কিন্তু নয়। বরং বেশ ঘিঞ্জি মনে হয়।
চারদিকে কেবল চারতলা-ছ’তলা বাড়ি ভিড় করে আছে। আলাদা কোনও ক্যারেক্টার নেই। দেখলে মনে হয় যেন বহুদিন রং করা হয়নি। তবে এই ভিশুয়াল ডিস্ট্রাকশনে আটকে যাবেন না। কংক্রিটের শহরের মধ্যেও লুকিয়ে আছে টুকরো টুকরো সব অমূল্য রত্ন, যার আভাস পাবেন অ্যাক্রোপলিস, অ্যানাফিওটিকা, প্লাকা বা থিসিও অঞ্চলে। এখানে নিওক্লাসিকাল স্থাপত্যের ছড়াছড়ি। সরু সরু রাস্তার ধারে সাজানো নানারকমের ট্রেন্ডি আবার ট্র্যাডিশনাল ক্যাফে। দোকানে দোকানীরা হাজাররকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে। আর চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পাবেন অ্যাক্রপলিস, যাকে নিয়ে এত প্রাচীন কাহিনি, গল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে যাবে ছোট ছোট গ্রিক গির্জা। ভিতরে ঢোকার অনুমতি আছে। তবে অবশ্যই পোশাকআশাক উপযুক্ত হওয়া চাই। চার্চ, দোকানপাট পায়ে পায়ে দেখে সোজা চলে যেতে পারেন ল্যাকাভিটোস হিল। এখানে থেকে গোটা এথেন্স শহরেরে প্যানোরামিক ভিউ পাবেন। সূর্যের আলো পড়ে যার রূপ একেবারে অন্যরকম লাগে। কোলোনাকি থেকে হেঁটেই ওঠা যায়। ইভানগেলিসমোস মেট্রো স্টেশন থেকে ১৫ মিনিট দূরেই শুরু হয় উপরে ওঠার রাস্তা। পাহাড়ি পাকদন্ডি বেয়ে উঠকে মন্দ লাগে না। রাস্তা একটু প্যাঁচালো, তবে মসৃণ। অবশ্য ফ্ল্যাট পরবেন, ৩০ মিনিট হেঁটে ওঠা একটু কষ্টটকর হলেও, উপরে উঠে যা দেখবেন তা আপনার ক্লান্তি নিমেষ দূর করে দেবে।
শহরের বিভিন্ন প্রান্ত এখানে থেকে তো দেখা যায়, আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখতে পাবেন এজিনা দ্বীপ এবং পেলোপনিজ়। এখানকার সেন্ট জর্জ চার্চ অবশ্যই ঘুরে দেখুন। গ্রেকো স্তাপত্যশিল্পের অনন্য নমুনা। সুন্দর একটা ক্যাফে রেস্তরাঁও আছে এই চত্বরে। অসামান্য ভিউ দেখতে দেখতে আয়েস করে চুমুক দিন ধোঁয়া ওঠা কফিতে। এখানে থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারেন অ্যাক্রোপলিস। ট্যাক্সিও পাওয়া যায়, তবে নতুন কোনও জায়গা পায়ে হেঁটে দেখার যা আনন্দ, তা বোধহয় ট্যাক্সি চড়ে পাবেন না। অ্যাক্রোপলিস এথেন্স তথা গ্রিসের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
শহরের বুক চিরে উঠে গেছে উপরে। এখানেই আছে বিশ্বের অন্যতম কিছু প্রাচীন মন্দির, স্থাপত্য। ঢোকার মুখেই পাবেন অল ইনক্লুসিভ টিকিট কাটার সুযোগ। প্রাচীন এথেন্সের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত পার্থেনন, দ্য অ্যাগোড়া, দ্য রোমান ফোরাম, দ্য টেম্পল অফ অলিম্পিয়ান জ়িউস,দ্য কেরামিকোজ় এবং দ্য থিয়েটার অফ ডিয়নিসাস সবই দেখে নিতে পারবেন এই একটা টিকিটেই। ২০০৪-এর অলিম্পিকের ঠিক আগে সবকটা সাইটে যাতায়াতের সুবিধের জন্যে রাস্তা বানানো হয়েছিল। ফলে একটা থেকে আর একটা স্থাপতে যাওয়ার জন্যে বেশি কসরত করতে হয় না। তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে অ্যাক্রপলিস এতটা উপরে, যে বেশিরভাগ সময়ে এখানে লোক গিজগিজ করে। শান্তি, নিরিবিলিতে যদি গ্রেকো শিল্পের আস্বাদ পেতে চান, তা হলে ভোরবেলা বা বিকেল ও সন্ধের সন্ধিক্ষণে যাওয়াই ভাল। সঙ্গে একটা ম্যাপ বা গাইডবুক অবশ্যই রাখবেন।
অ্যাক্রপলিসের ঠিক নীচেই দ্য নিউ অ্যাক্রোপলিস মিউজ়িয়ম। ২০০৯ সালে এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সুইস আর্কিটেক্ট পিটার জ়ুমথর নির্মিত এই সংগ্রহশালায় দেখতে পাবেন অ্যাক্রোপলিসের সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন। প্রাচীন যুদের অনেক নিদর্শনের সাক্ষী হতে পারবেন। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে পচন্দ করেন, তাঁদের কাছে এই মিউজ়িয়ম অনবদ্য অভিজ্ঞতা বই কী!
হেলেনিক ফেস্টিভাল
যদি গরমের সময়ে এথেন্স যান তা হলে কখনওই হেলেনিক ফেস্টিভাল মিস করবেন না। পারফর্মেন্স আর্টসের ফেস্টিভাল হিসেবেই এটি সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। ওডইন অফ হেরোডস অ্যাটিকাস থিয়েটারে সারা পৃথিবী থেকে শিল্পীরা আসেন এখানে পারফর্ম করতে। এছাড়াও লিকাভিতস হিলস-এ মিউজ়িক কনসার্টও হয়। আর সাহিত্যের পাতায় পড়া গ্রিক ট্র্যাজিডির রিএনঅ্যাক্টমেন্ট যদি গ্রিসের রাজধানীতে বসেই দেখা যায় তার থেকে ভাল এক্সপিরিয়েন্স আর কীই বা হতে পারে?
কীভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে সরাসরি কোনও বিমান নেই। কলকাতা থেকে দোহা হয়ে এথেন্স যাওয়া যায়। সময় লাগে সাড়ে এগারো ঘণ্টা মতো। নিউ দিল্লি থেকে আবুদাবি হয়েও যেতে পারেন এথেন্স
কোথায় থাকবেন: ব্রাসিল স্যুটস হোটেল অ্যাপাটর্মেন্ট।
এক এক সময় লম্বা ছুটি কাটালে এক ধরনের ক্লান্তি কাজ করতে পারে। তখন চারপাশের রূপসী পাহাড় দেখলেও মনে কোনও তাপউত্তাপ হয় না। সোনালি সমুদ্রসৈকতে বসেও দেখবেন আপনি হয়তো প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ না করে, ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছেন। আর তারপরই ট্যুরের মধ্যে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছন, যেখানে গিয়ে মনে হয় আপনার থেকে সৌভাগ্যশালী পৃথিবীতে সেই মুহূর্তে আর কেউ নেই। স্যান্টোরিনি হল ঠিক তেমনই একটা জায়গা। রূপকথার রাজ্য বললে বাড়াবাড়ি হবে না। এথেন্স থেকে বিমানে এক ঘন্টার পথ স্যান্টোরিনি। তবে জলপথে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। নীল জলের বুক চিরে এগিয়ে চলবে আপনার ক্রুজ়।
উপরে খোলা নীল আকাশ আর নীচে অকূল জলরাশি। মনে হয় না বাস্তব জগতে আছে। কুয়াশা ভেদ করে ক্যালডেরা (ভলক্যানিক ক্রেটার) ঢুকতেই আস্তে আস্তে নজরে আসে সুন্দরী স্যান্টোরিনি। ভৌগোলিকদিক থেকে দেখলেও স্যান্টোরিনির ইতিহাস অত্যাশ্চর্য। আগে এখানে আগ্নিগিরি ছিল। এক্সপ্লোজ়নে আদি সভ্যতা নষ্ট হয় যায়। ল্যান্ড মাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। যা পড়ে রয়েছে তাকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন থেরা, আমাদের ভাষায় স্যান্টোরিনি। আশপাশের ছোট অঞ্চলের নাম থেরাসিয়া। খুব অল্প সংখ্যাক মানুষই থাকেন এখানে, মাঝের আগ্নিয়গিরির নাম নিয়া কামেনি। থেরা আর নিয়া কামেনির মধ্যে বয়ে চলা জলই ক্যালডেরা।
ক্রুজ় থেকে নেমে ছোট্ট নৌকো আপনাকে নিয়ে যাবে বন্দরে। এখানে থেকে খাঁড়া পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় মূল শহর ফিরা-য়। হেঁটে যাতে একটু সময় লাগে ঠিকই, কিন্তু চারপাশের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্তির অনুভূতি হয় না। অবশ্য হাঁটে সময় কম থাকলে গাঁধার পিঠে চেপে যেতে পারেন। বেশ মজার অভিজ্ঞতা। আর ফার্নিকুলার তো আছেই। চট করে পৌঁছে যাবেন। বন্দর শহর ফিরা সকাল থেকেই শশব্যস্ত। ভেনেশিয়ান আর সাইক্লাডিক স্থাপত্যশিল্প এখানে মিলেমিশে একাকার। খোয়া বাঁধানো রাস্তা জুড়ে দোকানপাট, ট্যাভেনার্স, হোটেল, ক্যাফে। চারদিকে দুধ সাদা বাড়ি।
শহরটা এমনভাবে তৈরি যেন মনে হয় একটার উপর একটা বাড়ি গাড় কাত করে পড়ে রয়েছে। অসংখ্য চার্চ আছে এই শহরে। ফিরোজ়া নীল গম্বুজ আর সাদা দেওয়ালের এই চার্চগুলো অদ্ভুত সুন্দর। রাস্তাগাট ঘুুরে দেখে নিন মিউজ়িয়ম অফ প্রিহিসটোরিক থিরা। আকোরোতিরি ধ্বাংশাবশেষ আছে এখানে। পট, পটারি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তো আছেই তবে সবচেয়ে আকষ৪ণ করে নীল বাঁদরের ফ্রেসকোস। তবে আদৌ কোনওদিন স্যান্টোরিনিতে নীল বাঁদর ছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে গবেষকমহলে। কেবলকার স্টেশনের পাশেই রেছে আর্কিওলজিকাল মিউজ়িয়ম। ইতিহাস ভাল লাগলে একবার ঢুঁ মেরে নিতে পারেন। ফিরা থেকে রেড বিচের বাস ছাড়ে।
আয়রন রিচ সেডিমেন্টারি পাথরের জন্যেই এই নাম। বালির রঙও এখানে লাল। স্নরকেলিংয়ের সুবিধ আছে এখানে। আর অলস সময় কাটাতে চাইলে বিচ চেয়ার আর ছাতা ভাড়া করে বসে যেতে পারেন। খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। তবে এখানে ইলেকট্রিসিটি আর জলের সুবিধ পাবেন না, তাই সঙ্গে স্যানিটাইজ়ার রাখা মাস্ট। ফিরা থেকে উত্তরে ২০ মিনিট হাঁটলে ছোট্ট শহর ইমেরোভিজিল। ভারী সুন্দর শহর। আলাদা একটা ছন্দ খুঁজে পাবেন। এখান থেকে সোজা চলে যান মায়াবি শহর ইয়া। বাস, ট্যাক্সি তো আছেন, আরামে যেতে চাইলে, গাড়ি ভাড়া করে নিন। এতে বেড়ানোর স্বাধীনতা থাকে। আর ইয়া যাওয়ার রাস্তা এতটাই সুন্দর যে মাঝে মঝ্যে থেকে লেন্সবন্দি করতে প্রাণ চাইবেই। আর যদি অ্যাভেঞ্চার পচন্দ করেন, তা হলে হাইকও করতে পারেন। দু’ঘণ্টার রাস্তা। শহরে ঢুকে গাড়ি পার্ক করে দিন। বাকিটা ঘুরে দেখুন পায়ে।
নতুন শহর কাছ থেকে জানার এর চেয়ে ভাল উপায় বোধহয় আর হয় না। লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করলে ইয়ার প্রেমে পড়বেনই। মনে হয় যেন ভগবান বহু যত্নে শহরটাকে তিল তিল করে বানিয়েছেন। কোনও অ্যাডভার্টাইজ়িং ব্যানার নেই, কোনও ইন্টারনেট ক্যাফে নেই, খোলা আকাশ দেখতে পাবেন। কোনও পাওয়ার লাইন আপনাকে ডিস্ট্র্যাক্ট করতে পারবেন না। রাস্তাঘাট ঝকঝক করছে। একেঁবেঁকে রাস্তা চলেছে, শেষ দেখতে পারেবন না। দুধারে সাদা বাড়িঘর। ছাদে হাজারো রং। রঙের ক্যালাইডোস্কোপে না মজে উপায় নেই। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এত রং একসঙ্গে এক ক্যানভাসে দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা নিজে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
হাঁটতে হাঁটতে খিগে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। হাজারটা ট্যাভেরনাস আছে এখানে। প্রত্যেকটা তেকেই দেকা যায় অসাধারণ ভিউ। বোলেনিস সস অবস্যই ট্রাই করে দেখুন। থেরাসিয়ার মাটিতে টোম্যাটোর উত্পাদন হয়। আর তাই এখানকার সস খেতে দারুণ। ইয়াতে সূর্যাস্তের অভিজ্ঞতাও অবিস্মরণীয়। ফিরতি পথে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে পারেন। দেখে নিতে পারেন ব্ল্যাঙ্ক বিচ আর ফার্মিং কমিউনিটি। ফার্নিকুলার বেয়ে যখন আপনি আবার বন্দরে ফিরবেন, সঙ্গে তাকবে একরাশ ভাললাহা আর মন খারাপেপ বিষন্ন সুর। এটাই স্যান্টোরিনির ম্যাজিক। একবার এলে বারবার ফিরে আসতেই হবে।