ছুটির দিনে বিদেশবিভুঁইয়ে কার মনটা বাসার চার দেওয়ালে বন্দী থাকতে চায়। ঘরকুনো সংসারী মানুষগুলো চান হয়তো! কিন্তু আমার মতো ছন্নছাড়া মানুষগুলো নিশ্চয় বন্দী থাকতে চান না। সুযোগ পেলেই তারা বেরিয়ে পড়েন। যেমন আমি গত আগস্ট মাসে এক শুক্রবার দুপুরে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে রওনা হলাম মেঘের দেশে। আমাদের বাসা থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যেই এই মেঘের সমুদ্র। আকাশ জোড়া মেঘটুকু শেষবেলার দিকে সেখানে নেমে আসে মাটির কাছাকাছি। ওপরে পর্বতশৃঙ্গ আর নিচে সফেদ মেঘের সমুদ্র। কল্পলোকের খুব কাছাকাছি এই সৌন্দর্য।
গাড়ি ভরা বেবিফুড, চিপস, পানি ও জুস। এর পাশাপাশি গান—বাংলার গান। সালালাহ তখন অন্যতম ব্যস্ত একটি শহর। প্রচুর অতিথি এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার ও বাহরাইনসহ আশপাশের অন্যান্য দেশগুলো থেকে। আর ওমানের অন্যান্য শহরগুলো থেকে তো আছেই। সেই সঙ্গে ব্যাপক ট্রাফিক জ্যাম আর দুর্ঘটনা। ভয়ংকর মন খারাপ করা একেকটা দুর্ঘটনা। রাস্তায় সাধারণ সময়ের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি ট্রাফিক। তারা সবাই খারীফ ভিজিটর।
আমি আমার স্বপ্নেও চিন্তা করিনি আমি আমার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশ আসব। বেড়াতে যাব এই চিন্তাও করিনি। তারপরও স্বামীর কর্মসূত্রে আমি এখন ওমানে। ওমানের রাজধানী থেকে অনেক অনেক দুরে থাকি। ইয়েমেন সীমান্তের কাছাকাছি সালালাহ নামক এক অঞ্চলে।
তিনদিকে পাহাড় আর একদিকে আরব সাগরের বেষ্টনীতে এই সুন্দর দোফার বা জুফার অঞ্চল। মরুভূমির বুকে একটুকরো মরূদ্যান। জুনের মধ্যভাগ থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত এখানে খারীফ—যার অর্থ মনসুন অথবা বর্ষাকাল। পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে বহু লোকজন এই সময়টা গাট্টিবোঁচকা বেঁধে সালালাহ চলে আসেন।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে যে বৃষ্টি একেবারেই হয় না তা কিন্তু নয়। প্রতি বছর কখনো না কখনো আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টিতে ওয়াদি বা ঢল নামে। কিন্তু খারীফের মতো আয়োজন করে বর্ষাকাল অন্য কোথাও নেই। তো এই বৃষ্টি দেখে আরবরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সানরুফ-মুনরুফ দিয়ে, জানালা দিয়ে গলা বের করে বৃষ্টির গুঁড়ি অনুভব করে। বৃষ্টির গুঁড়ি বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি-এটাই খারীফের বৈশিষ্ট্য। তাই অন্যান্য জায়গায় তাপমাত্রা যখন ৪২-৫২ সেলসিয়াস, তখন সালালায় ২০-২৫ সেলসিয়াস। শুধুমাত্র বৈচিত্র্যময় এই খারীফটুকু সালালাহকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো থেকে একেবারেই আলাদা করে ফেলেছে। মরুভূমির বুকে এক টুকরো স্বর্গোদ্যান এই সালালাহ।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পরশে পাহাড়ের ধূসর অঞ্চলে প্রাণের ছোঁয়া জাগে। সুবিস্তৃত পাহাড়রাজি সবুজের এক বিশাল চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলবে। এই নয়নাভিরাম সবুজের সঙ্গে কিছুর তুলনা মেলে না। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদগুলো পাতা ছাড়বে। ঘাসের বুকে সাদা সাদা নাকফুলের সমান ফুল ফুটবে। কী যে অনিন্দ্য সে সৌন্দর্য!
বৃষ্টির পানি বুকে ধরে রাখতে রাখতে একসময় ঝরনা হয়ে নেমে আসে। অনেকগুলো ঝরনা নামে এই অঞ্চলে। আইন মানে ঝরনা। পাহাড়ের বুক চিরে অনেক ধারায় বের হয় এই স্রোতস্বিনী ঝরনাগুলো। কী যে দারুণ।
আরব পরিবারগুলো সকালের খাবারটা সেরেই পরিবারপরিজন নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে পৌঁছে যান পাহাড়গুলোতে, সবুজের সেই অবাধ ভুবনে। মাথার ওপর ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে বারিধারা। ঠান্ডা ঠান্ডা হিম ধরানো একটা বাতাস বইতে থাকে সারাক্ষণ। কেউ কেউ তাঁবু টানিয়ে, পাটি বিছিয়ে খারীফের এই মনোলোভা সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করতে থাকেন। এরই মধ্যে কাঠ জ্বালিয়ে একটা ছাগল পোড়ানো শুরু করে দেয় হয়তো। এই মাংস পোড়া খাওয়া এদের বহু বহু পুরোনো আদিম সভ্যতার একটুকরো অংশ যা এখনো বিদ্যমান। চামড়া পরিষ্কার করে জবাই করা পশুটিকে লবণ মেখে পোড়ানো হয় সাধারণত। খুব অল্প আরবই আছেন যারা তাতে মসলা মেশান। পোড়া পোড়া সেই মাংস সবাই মিলে গোল হয়ে বসে খান।
আরেকটা মজাদার খাবার হলো মেশকাক। উটের মাংস ছোট কিউব করে কেটে তা লবণ দিয়ে পোড়ানো হয় শিকে গেঁথে। কখনো অর্ধসেদ্ধ কখনো বা পূর্ণ সেদ্ধ। কী মজা করে যে তারা খায়। আর অবশ্যই ফ্লাক্স ভরা থাকবে কাওয়া নামক তিতা তিতা কফি, সঙ্গে খেজুর। এক কামড় খেজুর মুখে পুরে সেই গরম ধোঁয়া ওঠা তিতা কফি চালান করে দিতে হবে গলার ভেতর। তারপর আয়েশ করে খেজুরটুকু চিবিয়ে নিতে হবে। যেকোনো আরব পরিবারের জন্য এই পানীয় অপরিহার্য। সৌহার্দ্যময় আরব জাতি আশেপাশে যারা বসেছেন তাদের সঙ্গেও খুব সহজেই ভাগ করে নেন তাদের খাবারটুকু। বাচ্চাগুলো খুব আনন্দের সঙ্গে খেলাধুলা করতে থাকে। দুর থেকে দেখতে মনে হবে আমি যেন স্বর্গের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
প্রকৃতির বুকে রূপ ছড়ানোর গল্পটুকু কতটুকু বলতে পারব জানি না। ধূসর আকাশের তলে দিগন্তবিস্তৃত সবুজের গালিচা। তাতে মৌমাছি খেলা করে। ফড়িং উড়ে বেড়ায় গাছে গাছে। সবুজের বুক চিরে ফুটে থাকে সাদা ফুল। খুব ছোট—যেমন আমার নাকের নাকফুল। হলুদ ফুলগুলো ফুটে ওঠে একটু লম্বা ডাঁটার গুল্মে। একটা ঘ্রাণ মাতাল করে রাখে চারিদিক। অল্প একটু আলোর ছোঁয়ায় তা হয়ে ওঠে খুব ঝলমলে। তার ওপর আলোর নাচনে আর মৌমাছির এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর তালে মন হারিয়ে যায় আমাদের দেশের হরিৎ বরণ সর্ষে খেতের মাঠে। কী এক সম্মোহন! চারদিকের সবুজ পাহাড় থেকে ঝুলে পড়ে লতাজাতীয় সবুজ শাখা প্রশাখা। আর তাতে মনে হবে পুরোটা পাহাড় যেন এক নকশিকাঁথার মাঠ। যাতে বেগুনি সুতোর বুনোনে কেউ নিজ হাতে একে দিয়েছে ফুলেল নকশা।
কেউ বুঝতে পারছেন কি অদ্ভুত তার রং বিন্যাস। মনের চোখটা বন্ধ করে একটু ভাবুন। হৃদয়ের পুরো মানসটুকু সবুজের ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তাতে ঝুলিয়ে দিই কিছু বেগুনরঙা নীল ফুল। বাতাসের দোলে সবুজের জমিনে হিল্লোল তুলে তা শোনায় খারীফের গান। খারীফের এই পুরো সময়টা মেঘের ঘন চাদরে ঢাকা থাকবে পাহাড়গুলো। একহাত সামনের জিনিসও দেখা যায় না। খুব সাবধানে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কুয়াশাঘেরা পাহাড় পাড়ি দিতে হয়। খারীফের পানি বুকে জমা করে রাখে কিছু গুল্ম। এই সবুজ ঘাসে গবাদিপশুর বছরের বাকি সময়টা কাটে।
খারীফ হলো জিয়নকাঠি। ধূসর মরুর বুকে যত সুপ্ত প্রাণ তা জেগে ওঠে ঝিরিঝিরি বারিধারার ছোঁয়ায়। মরুভূমির বুকে পুরো একটা প্রাণের বন্যা বইয়ে দেয় খারীফ। সবুজের বুকে বিভিন্ন রং নিয়ে খেলে চলে বিধাতা। তার অপূর্ব সৃষ্টি দিয়ে মানব কূলকে জানান তার সৌন্দর্যবোধ। তাইতো এত সৌন্দর্যপিপাসু দলে দলে আসেন সালালাহ। সালালা ঢোকার আগে আগেও খুব আলো ঝলমলে দিনটুকু হঠাৎ করেই ছায়াঘেরা হয়ে ওঠে। পুরো পথটা হঠাৎই মেঘে ঢেকে যায়। একহাত সামনের গাড়িটাও নজরে আসে না তখন। দিনরাত স্ট্রিট লাইট, গাড়ির ফগ লাইট, হেড লাইট সব চালু থাকে। গাড়ির জানালা, সানরুফ খুলে সবাই প্রাণভরে উপভোগ করে খারীফের সৌন্দর্য। এদের এই পাগলামিটুকু দেখতে খুব মজা লাগে।
আমরা সবুজ দেশের মানুষ। বর্ষায় আমাদের বান্দরবান, সিলেটের নয়নকাড়া সৌন্দর্য একরকম। আর সালালাহর সৌন্দর্য পুরোপুরি অন্যরকম। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে দেয় তার লাস্যময়ী কন্যাটিকে মন উদাস করা সবুজ উদ্যানে। যাত্রা করেছিলাম মেঘের দেশে, পরতে পরতে যেখানে মেঘ খেলা করে, কিন্তু পুরো যাত্রাপথই যেখানে মেঘের দখলে তখন মেঘের দেশের গল্প বরং আরেকদিন বলি।
এত আনন্দের মাঝেও আমার দেশের ঝুম বৃষ্টি আমাকে সব সময় মনে খোঁচা দিতে থাকে। আকাশ কালো হয়ে গুড়গুড় দেওয়ার ডাকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। পানির বুকে পানি নৃত্য করে। সারা দিন একটানা বৃষ্টি ঝরে পড়ে টিনের চালে। সেই মর্মর ধ্বনি তৈরি করবে এমন কারিগর কোথায়! মাটির বুক চিরে মন আকুল করা সোঁদা ঘ্রাণ বের হবে এমন মাটি কোথায়!
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে,
জানিনে, জানিনে!
কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’
এমন বৃষ্টি শুধু বাংলাদেশেই নামে, অমন সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা দেশ আর কোথাও নেই। তবু আমার মন খারাপের বিরান অঞ্চলে খারীফ আমার ভালোবাসা, আমার আনন্দ, আমার একপশলা ভালো লাগা।
মাহফুজা বেগম স্নিগ্ধা: সালালাহ, ওমান