সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। আমার হোটেল রুমে দুটি জানালা। সকালে জানালার কাঁচ গলে উজ্জ্বল মিষ্টি আলোর ঝলকানি মনের ভেতরে ভালোলাগার আবেশ তৈরি করল। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’ কবিতাটা মনে পড়ে গেল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কবিতা আওড়ালাম।
নেলসনে আজ আমার দ্বিতীয় দিন হলেও এটা প্রথম সকাল। নেলসনের বিখ্যাত সিটি সেন্টারের একপাশের লাগোয়া রাস্তার সঙ্গেই আমার হোটেল। ছোট সুন্দর আর ছিমছাম এই হোটেল ঠিক করে দিয়েছে ইয়াসিন হাসান। ইয়াসিন রাইজিংবিডির স্পোর্টস বিভাগের প্রধান। এসব কাজে সে সিদ্ধহস্ত। কাল রাত প্রায় ৩টায় ঘুমিয়েছিলাম। তারপরেও সকাল ৮টায় ঘুম ভেঙে গেল। গতকাল সারাদিন জার্নিতে কেটেছে। তবুও অল্প; তবে ফ্রেশ ঘুমে আগের দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কাল রাতেই ভেবে রেখেছিলাম কোনো একটা স্পট ঘুরে দেখা উচিত। কাছে পিঠে কোথায় যাওয়া যায়- ভাবতে ভাবতে শাওয়ার সেরে নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম নেলসনে পৃথিবীর সেরা সমুদ্র সৈকত আছে- ওখানে যাব। নাহুনানুই সমুদ্র সৈকত।
তৈরি হয়েও ঘণ্টাখানেক রুমে সময় ব্যয় করলাম অফিসের কাজে, আগামীকাল দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচের জন্য মাঠে কিছু কাজের তদারকি করার ছিলো। বিকালে একবার মাঠে যেতে হবে। কখন যাব নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের জিএম মি. ক্রিস স্মিথের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলাম। এই ভদ্রলোকই আমাকে নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণপত্র দিয়েছিলেন।
ক্যামেরার ব্যাটারিতে চার্জ আছে কি-না চেক করেই নাস্তার টেবিলে চলে গেলাম। আমার নাস্তা হয়ে গেলো পাখির মতোই। টুপটাপ মুখে খাবার দিয়েই বের হলাম। সঙ্গে নাস্তার টেবিল থেকে একটা নিউজিল্যান্ডের ফ্রেশ আপেল, আর একটা সেদ্ধ ডিম ক্যামেরার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম; সঙ্গে পানির বোতলও। এখানে পানির দাম বেশি। কিনতে চাইলে ডলারের কথা ভাবলে কষ্ট লাগে। অথচ এক লিটার দুধের দাম পানির দামের চেয়েও সস্তা- আশ্চর্য না!
হোটেল থেকে বেরিয়ে সিটি সেন্টারের সামনে বাস কাউন্টারে চলে এলাম। বাসের শিডিউলে দেখা গেল ১৩ মিনিট পর বাস আসবে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি বলেই এক মিনিটও দেরি হলো না বাস আসতে। অটোমেটিক ডোর ওপেন হতেই ঢুকে পড়লাম বাসে। চালক ইন্ডিয়ান- দেখেই বুঝলাম। চেহারায় ইন্ডিয়া–বাংলাদেশের ছাপ। তাকে বললাম, আমি নাহুনানুই বিচে যেতে চাই। ভদ্রভাবে সেও বলল– ‘ওকে, নিশ্চিন্তে বসো। আমি নামিয়ে দেব।’
নিউজিল্যান্ড পুরোটাই দ্বীপ রাষ্ট্র। দক্ষিণ–পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র এটি। বিশ্বের মানচিত্রে নিউজিল্যান্ডকে অস্ট্রেলিয়ার খুব কাছাকাছি মনে হলেও আদতে এটি অস্ট্রেলিয়া থেকে দুই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে তাসমান সাগরে অবস্থিত। এই সময়ে নিউজিল্যান্ডে মূলত ইউরোপিয়ানদের বসবাসই বেশি। বাস স্টপেজে নেমে রাস্তা পার হয়ে ৩ মিনিটের মতো হেঁটে একদম সৈকতের বালিতে নেমে পড়লাম। আমার আগেই চ্যানেল টোয়েনটি ফোরের স্পোর্টস রিপোর্টার রুদ্র এসে হাজির। যাক, ঘোরাঘুরির মন ওর মধ্যেও আছে দেখে ভালো লাগছে। সঙ্গী পেয়ে গেলাম। একা একা অচেনা একটি দেশে সমুদ্র সৈকতে আসলে কিছু করার থাকে না। তাছাড়া এখন তো ছবি তোলাও একটা বড় উপলক্ষ। ঘুরতে গেলে ছবি না তুললে সেটা আবার কেমন ঘুরে বেড়ানো!
রুদ্র আমাকে দেখেই বলল, ‘ভাই, আপনি আসছেন ভালোই হলো। শুধু বিচের ছবি তুলছিলাম, কিন্তু নিজেরটা তুলতে পারছিলাম না। এই নেন আমার মোবাইল, আমি ওই যে ওখানে যাচ্ছি। আপনি আমার কিছু ছবি তুলে দেন।’ ওর মোবাইল আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি বুঝলাম ওর অনেক ক্ষুধা লেগেছে; ছবি তোলার ক্ষুধা। এতোক্ষণ আছে, কিন্তু ছবি তুলতে পারেনি- হা হা হা!
আমি ছবি তুলছি আর মুগ্ধ হয়ে দেখছি সৈকতের সৌন্দর্য। পৃথিবীর যে কেউ এই সৈকতের প্রেমে পড়তে বাধ্য। ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস। সামনে স্বচ্ছ আর গভীর নীল পানি আমাকে বিমোহিত করেছে। এতো নিরিবিলি বলার অপেক্ষা রাখে না! নিভৃতে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছেন আগতরা। আমার কাছে তো এরা সবাই বিদেশি। চকচকে সাদা বালিতে রৌদ্রবিলাস করছেন অনেকে। কেউ বই পড়ায় মনোযোগী। শিশুরা সৈকতে খেলছে যে যার মতো। বেশ দূরে এখানে-ওখানে জোড়ায় জোড়ায় কাপলরা চাদর বিছিয়ে স্বল্প বসনে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন। পৃথিবীর দিকে তাদের ফিরে তাকানোর সময় নেই।
সৈকতের এক পাশে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজনের একটা জাপানি বা চাইনিজদের দল দেখলাম। সবাই মার্শাল আর্টের সাদা পোশাক পরে আসনে বসেছেন। একজন বৃদ্ধের সামনে সবাই চোখ বন্ধ করে মাথা কিছুটা উঁচু রেখে দুই হাঁটুতে হাতের কব্জি রেখে বসেছেন। মনে হচ্ছে ধ্যানে মগ্ন। বৃদ্ধ তাদের দলপতি বা গুরু। একটু এগিয়ে গেলাম। কোনো ভাবান্তর নেই। এতোটাই মগ্ন, মনে হলো পৃথিবীর বাইরে চলে গেছে! কখন ফিরবে ইহজগতে আপাতত বোঝা যাচ্ছে না।
আমি হাঁটছি, দেখছি চারদিক। রুদ্রকে দিয়ে নিজের ছবি তোলালাম। ক্ষুধা আমারও আছে বৈকি! অনেকগুলো ছবি নিজের ক্যামেরায় তুললাম স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সৈকতটি একেবারে ছোট না। কিন্তু সেই তুলনায় লোকজন অনেক কম। একটু পরপর তাসমান সাগরের বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। নীল জলের ফেনিল সফেদ ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ছে পায়ের কাছে। শতশত সি-গাল ওড়াউড়ি করছে। ডাকাডাকি করে যাচ্ছে বিরতিহীন। পাঁচ-ছয় বছর বয়সী বাচ্চারা মা–বাবা ছাড়াই পানিতে নেমে যাচ্ছে, আবার দৌঁড়ে উঠে আসছে। কোনোরকম ভয় এদের মধ্যে কাজ করছে না। ওদের কাছে সাগর বা পানি ভয়ের কিছু না; খেলার জায়গা, বেঁচে থাকার জায়গা। গভীর সমুদ্রে একটি ছেলে একটি মেয়ে সার্ফিং করছে। মূলত অনুশীলন করছে ওরা। ভাই-বোন হতে পারে। অন্তত চেহারা তাই বলে। কিন্তু এরকম ভারি শরীর নিয়ে মেয়েটি কীভাবে সার্ফিং অনুশীলন করছে বোধগম্য হলো না। শখ হতে পারে।
এর মধ্যে পাশে কোত্থেকে যেন সমবেত কণ্ঠে হুহ–হাহ-ইয়াহ শব্দ কানে এলো। পেছনে ঘুরে তাকালাম। বিচের পাড়ে শুরুতে যেসব জাপানিদের ধ্যানমগ্ন দেখেছিলাম তারা জেগে উঠেছে। এবার পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা। এই দল মার্শাল আর্ট অনুশীলন করছে। অনুশীলনের আগে বিক্ষিপ্ত মন কেন্দ্রীভূত করতেই ধ্যানের আয়োজন। মন্দ নয় ব্যাপারটি। জীবনে সবকিছুতেই একাগ্রতা আর নিষ্ঠা থাকা জরুরি।
হঠাৎ আমাদের সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে ১৪-১৫ বছর বয়সী একটা মেয়েকে দৌঁড়ে যেতে দেখলাম। হাফ প্যান্ট পরা। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে গায়ের টি শার্ট খুলে ফেলল। সেটি ছুড়ে ফেলে শার্টের নিচের পোশাক পরেই দৌড়াতে থাকল। এ রকম পোশাকে এরা ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত। প্রায় আধা কিলোমিটার দৌঁড়ে সে একেবারে সাগরের নির্জন একটি জায়গায় গিয়ে পানিতে নামতে শুরু করলো। মূল বিচ ফেলে মেয়েটি অত দূরে কেনো গিয়ে নামলো বুঝতে পারলাম না আমরা। আমরা ভাবছিলাম এভাবে একা একা পানিতে নেমে যাচ্ছে অথচ বিন্দুমাত্র ভয় নেই! একটু আগেই বলেছি সাগর এদের কাছে আনন্দে বেঁচে থাকার স্থান।
বিচের পরিবেশ শান্ত। তিনজন যুবককে দেখলাম বিচে রানিং করছে। এরা শরীর সচেতন বোঝা যায়। রানিং, সুইমিং সঙ্গে ভিটামিন ডি শরীরে মেখে নেওয়া। জীবন থেকে অসুখ দূরে সরিয়ে এই জাতিকে সুখে অবগাহন করিয়ে চলেছে তাসমান সাগরের এই নাহুনানুই সৈকত। আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম এখানে। রুদ্র বলল, ‘ভাই ক্ষুধা লাগেনি আপনার?’ আমি সায় দিলাম। দুজনে বিচ থেকে উপরে উঠে হাত-পা ধুয়ে বালি পরিষ্কার করে নিলাম।
এ দেশের সরকার বিচের একটু উপরে অনেক বড় জায়গা জুড়ে সবুজ বাগান করে রেখেছে। বাগানের মধ্যে সারি দিয়ে গোসলের স্থান, বাথরুম। বাচ্চাদের খেলার জন্য দোলনাসহ আরও কতকিছু! বাবা–মা বিচে নামলে যেন বাচ্চারা এখানে খেলাধুলা করতে পারে সেই ব্যবস্থা আর কি। আমরা ফ্রেশ হয়ে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’ লেখা একটি খাবারের দোকানে বসলাম।
ফিশ অ্যান্ড চিপস অর্ডার করলাম দুজনে। সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্কস- ফানটা। পিপাসায় মনে হচ্ছিল বের হয়ে যাবে জানটা। খাবার দিতে একটু সময় লাগবে। রুদ্র ইন্টারনেট দেখে খবর নিয়ে আমাকে বিরবির করে বলল, ‘ভাই, বিকাল ৭টার পর এই হোটেলে ফেরার বাস বন্ধ হয়ে যায়। এখন তো সাড়ে ৭টা বেজে গেছে।’ আমি বললাম, ‘খাওয়ার পর কিছুটা এনার্জি পাবেন। বাসে তো ১৫ মিনিটের রাস্তা। আমরা হেঁটে যেতে পারি।’ কারণ দিনের আলো তো রাত প্রায় সাড়ে ৯টা পর্যন্ত থাকে। রুদ্র আবার ইন্টারনেট দেখে বলল, ‘হেঁটে গেলেও এক ঘণ্টা লাগবে।’ পরে আমরা অবশ্য কিছুটা হেঁটে গিয়েছিলাম। পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় ট্যাক্সি কল করতে হয়েছিল।
কীভাবে যাব- সেই আলোচনার মধ্যেই খাবার এসে গেল; গরম গরম। বিচের পাড়ে রাস্তার সঙ্গেই দোকান। আমরা দোকানের বাইরের অংশে বসেছি। খাবারের আশায় কয়েকটা সি-গাল আমাদের আশেপাশে কাকের মতো ঘোরাঘুরি করছে। দোকানের বাইরে চারটা টেবিলের উপর লেখা রয়েছে- ‘সি-গাল, দে আর অ্যাগ্রেসিভ, ডু নট ফিড দেম!’
খাবার শেষ করে আমরা বিদায় বেলায় বৃদ্ধ অথচ শক্ত সামর্থ্য এবং হ্যান্ডসাম দোকানীকে জানালাম তোমাদের এই বিচ দারুণ শান্ত আর শান্তির জায়গা। তিনি হাত উঁচিয়ে আমাদের থামালেন। বললেন, ‘দিস ইজ প্যারাডাইজ ফর আস!’