সাগরের উন্মত্ত জলরাশির স্পন্দনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার উচ্ছ্বাস আর বালুকাবেলায় রোদ্দুরের সোনালি আলিঙ্গন। বসতিগুলো যেন প্রত্যহ গেয়ে যায় জীবনের গান। এ গানের সঙ্গে ঐকতানে বাজে সাগরতলের জীববৈচিত্র্যের সুর। নৈসর্গিক কার্নিভালের এমন আয়োজনের দেখা মেলে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে।
বালি দ্বীপের ভৌগলিক অবস্থান
ইন্দোনেশিয়ার বালি প্রদেশের এই দ্বীপটি জাভা থেকে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার পূর্বে এবং বিষুব রেখা থেকে প্রায় ৮ ডিগ্রি দক্ষিণে অবস্থিত। জাভা ও এই দ্বীপের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বালি প্রণালী। দ্বীপটির বিস্তৃতি পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ১৫৩ কিলোমিটার এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১১২ কিলোমিটার। প্রশাসনিকভাবে ৫ হাজার ৭৮০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত এই দ্বীপ।
‘বালি’ নামকরণের ইতিহাস
রাজা শ্রী কেশরী ওয়ারমাদেওয়া ৯১৩ সালে এই দ্বীপের নাম দিয়েছিলেন ‘বালি’। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ বলি থেকে এসেছে যার অর্থ ত্যাগ, পুনর্জন্ম বা উৎসর্গ। এই শব্দটি এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত বিভিন্ন শিলালিপিতে পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে একটি দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চল সানুরের ‘ওয়ালি দ্বীপা’ শব্দ খোদাইকৃত ব্লাঞ্জং স্তম্ভ। এই শিলালিপির কাজটি করা হয়েছিল ৯১৪ সালে রাজা ওয়ারমাদেওয়ার শাসনামলে।
ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন ভিসা পাওয়ার উপায়
বালি দ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার প্রথম শর্ত ইন্দোনেশিয়ার সিঙ্গেল বা মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা নেওয়া। এই ভিসার আবেদনের জন্য যা যা প্রয়োজন হবে, তা হলো-
ভিসার মেয়াদ, ফি এবং আবেদন জমা
এই ভিসার মেয়াদ একক প্রবেশে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের জন্য বৈধ থাকে। ভিসার ফি ১০ হাজার ৫০০ টাকা। আবেদনের সব কাগজপত্রসহ ঢাকার ইন্দোনেশিয়া দূতাবাসের কনস্যুলার সার্ভিস কাউন্টারে জমা করতে হবে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত আবেদন জমা নেওয়া হয়। ইমেইল ঠিকানার ([email protected]) মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া যায়।
বালি দ্বীপ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে রৌদ্রজ্জ্বল দিনগুলোতে বালি দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়। এই মৌসুমের ব্যাপ্তি এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত, তবে জুলাই ও আগস্টে পর্যটকদের ভিড় সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এ সময় হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে যাবতীয় ভ্রমণ পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করতে হয়।
বালিতে আর্দ্র ঋতু থাকে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। ক্রিসমাস এবং নিউ ইয়ার ছাড়া বাকি সময়গুলোতে এখানে পরিব্রাজকদের চাপ কম থাকে। তাই নিরিবিলিতে সমুদ্র বিলাসে যেতে হলে এই মৌসুমটাই ভালোভ
পর্যটকদের জন্য বালি দ্বীপের সেরা আকর্ষণ
বাতুর পর্বত
বালির উত্তরের এই সক্রিয় আগ্নেয়গিরিটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। গোটা বালির জন্য এই পর্বত আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হওয়ায় দর্শনার্থীরা ভ্রমণের সময় বাতুর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। পর্বতের পাদদেশে ভ্রমণের সময় পাওয়া যাবে বালিনিজ সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে তেগালালং রাইসের সিঁড়ি, তির্তা এমপুল মন্দির, এন’জুং বালি এবং পিংগান সানরাইজ স্পট।
আগুং আগ্নেয়গিরি
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৩১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই আগ্নেয়গিরি সমগ্র বালির সর্বোচ্চ স্থান। এর জন্য একে ‘মাদার মাউন্টেন’ নামেও ডাকা হয়। আশপাশের সবুজে পরিবেষ্টিত অনন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে একদমই বোঝার উপায় নেই যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এই জায়গাটি।
বালির বিখ্যাত মন্দির পুরা বেসাকিহ আগুংয়ের ঢালে একদম উঁচুতে অবস্থিত। পর্বতের দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশকে সংযুক্ত করে মন্দিরে ওঠার পথটি খোলা থাকে শুষ্ক মৌসুমে। পথটা বেশ দুর্গম হলেও এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে সূর্যোদয় ট্র্যাক। এই পথ দিয়ে রাত ১০টায় রওনা করলে ঠিক সূর্যোদয়ের সময় চূড়ায় পৌঁছা যায়।
তানাহ লট
দ্বীপের খুব কাছাকাছি অবস্থিত এই জায়গাটি মূলত একটি শিলা দ্বীপ। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে প্রাচীন হিন্দু তীর্থস্থান মন্দির ‘পুরা তানাহ লট’। ইন্দোনেশিয়ার সাংস্কৃতিক বিশেষত্বের পাশাপাশি দ্বীপটি ফটোগ্রাফির জন্য সেরা। পাথুরে এই দ্বীপে প্রবেশের জন্য খরচ করতে হয় ৬০ হাজার রুপিয়া; বাচ্চাদের জন্য ৩০ হাজার রুপিয়া রাখা হয়। মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য দর্শনার্থীদের যেতে হয় সমুদ্রের ধার দিয়ে গড়ে ওঠা বালিনিজ দোকানগুলোর মধ্য দিয়ে। দুর্গম শিলার খাঁজগুলোতে পর্যটকদের জন্য রেস্তোরাঁর ব্যবস্থা আছে।
বালির প্রসিদ্ধ খাবার
খাবারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে স্যাটে’র কথা। গ্রিল করা মাংসের এই খাবারটি পরিবেশন করা হয় সাধারণত সুগন্ধযুক্ত চিনাবাদাম সসের সঙ্গে। এই মাংস শুধু মুরগি কিংবা গরুতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এতে খরগোশ এমনকি সাপ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়।
ভারী খাবারের মধ্যে বহুল পরিচিত সুগন্ধি সেদ্ধ ভাতের নাসি ক্যাম্পুর। এতে থাকে মাংস, সামুদ্রিক খাবার, শাকসবজি, টোফু এবং সাম্বাল।
ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী বকসো এখানকার সবচেয়ে সুস্বাদু মিটবলগুলোর একটি। ইন্দোনেশিয়া থেকে উদ্ভূত এই খাবারের প্রধান উপাদান গরুর মাংস বা মুরগির মাংস এবং সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মশলা। মিটবলের সঙ্গে সাধারণত রাইস নুডলস এবং শিম থাকে। বালির বিখ্যাত মিষ্টান্ন হচ্ছে বুবুর কাকাং হিজাউ। এই মিষ্টিটি বানানো হয় মুগ ডাল, নারকেল দুধ এবং পাম চিনি দিয়ে।
বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ যাওয়ার উপায়
আকাশপথে বাংলাদেশ থেকে বালির ট্রিপগুলো শুরু হয় ফিরতি টিকিটসহ ৬৩৪ মার্কিন ডলার (৭৩ হাজার ৮৫৪ টাকা) থেকে। কিন্তু এগুলোতে ট্রানজিট এবং সময় দুটোই বেশি। আর সর্বোচ্চ ভাড়া ১ হাজার ৪৪ মার্কিন ডলার (১ লাখ ২১ হাজার ৬১৪ টাকা), যেখানে সবচেয়ে কম সময়ে বালিতে পৌঁছা যায়।
সবচেয়ে কম খরচের ট্রিপটি ভারতের ৩ প্রদেশে এবং সিঙ্গাপুরে ১টি ট্রানজিট নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার ডেনপাসার বিমানবন্দরে গিয়ে শেষ হয়। এ যাত্রায় বালিতে যেতে সময় লাগে সাড়ে ৪৩ ঘণ্টা।
আর সর্বোচ্চ খরচে সবচেয়ে দ্রুতগামী ফ্লাইটটি শুধু মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছায়। এখানে সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৮ ঘণ্টা।
বালি দ্বীপ ভ্রমণের যাবতীয় খরচ
আবাসন বাবদ এখানে বাজেট রাখতে হবে জনপ্রতি ২ লাখ ২৭ হাজার থেকে ১৩ লাখ ৪০ হাজার রুপিয়া। ‘১ ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া = ০ দশমিক ০০৭৩ বাংলাদেশি টাকা’ হিসাবে এই বাজেট ১ হাজার ৬৫৭ থেকে ৯ হাজার ৭৭৮ টাকার সমতুল্য।
বালির স্থানীয় পরিবহনে যাতায়াতে প্রতিদিন খরচ হতে পারে জনপ্রতি ৪৭ হাজার থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার রুপিয়া বা ৩৪৩ থেকে ১ হাজার ৬৬ টাকা।
তিন বেলা খাবারের জন্য গড়পড়তায় হিসেব করতে হবে প্রতিদিন ১ লাখ ৩২ হাজার থেকে ৩ লাখ ৩১ হাজার রুপিয়া, যা ৯৬৪ থেকে ২ হাজার ৪১৬ টাকার সমান।
সব মিলিয়ে একজনের জন্য এক সপ্তাহ ধরে বালি দ্বীপ ভ্রমণের জন্য বাজেট রাখতে হবে প্রায় ২৯ লাখ ৩৪ হাজার থেকে ৮২ লাখ ৩৯ হাজার রুপিয়া। এটি বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২১ হাজার ৪০৯ থেকে ৬০ হাজার ১১৮ টাকা।
ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা
পর্বতপ্রধান এই দ্বীপে যাদের প্রথম উদ্দেশ্য পর্বতারোহণ তাদের কিছু ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এগুলো হলো-
– আরোহণ শুরু করার আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নেওয়া।
– স্লিপ এবং পতন রোধ করতে ভাল ট্র্যাকশনসহ সঠিক হাইকিং জুতা পরা।
– পানি, শুকনো খাবার এবং প্রাথমিক চিকিৎসার কিট সঙ্গে রাখা।
– এখানে পর্বতারোহণে গাইড নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। দুর্গম যাত্রার প্রতিটি মুহূর্তে গাইডের নির্দেশাবলী এবং পরামর্শ অনুসরণ করা আবশ্যক।
– এ ছাড়া আগ্নেয়গিরির আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণের আগে স্থানীয় লোকজন বা নিউজ আউটলেটগুলোর মাধ্যমে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জেনে রাখতে হবে। এর জন্য হোটেল বা রিসোর্টের কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যেতে পারে।
– এ ছাড়াও এই জায়গাগুলোতে পর্যটকদের সচেতনতার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা চিহ্ন বা সূচকে ব্যবস্থা রাখা হয়।
– এমনকি আসন্ন অগ্ন্যুৎপাতের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারিভাবে সতর্কতা জারি করা হয়। যে কোনো জরুরি অবস্থায় নিরাপত্তার জন্য এই সতর্কতাগুলোর যথাযথ অনুসরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ ভ্রমণে আক্ষরিক অর্থেই বিসর্জন হতে পারে শহুরে জীবনের অস্থিরতার। ক্লান্ত জরাজীর্ণ মনের বলিতে পুনর্জন্ম ঘটতে পারে এক প্রশান্ত আত্মার। তবে এর জন্য আকাশ, সাগর আর পাহাড়ের মেলবন্ধনটাকে দুচোখ ভরে দেখতে হবে বেশ কিছুটা দিন। সাগরতলের জীবন বাদ দিয়ে শুধু স্থলভাগের ওপরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলোও দু-এক দিনে দেখে শেষ হবে না।’মাদার অফ মাউন্টেন’ দর্শন আর নাসি ক্যাম্পুর স্বাদ নেওয়ার জন্যই প্রয়োজন হবে আলাদা প্রস্তুতির।